25/01/2023
মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী অক্সিজেনের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে।দেহের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন সরবরাহ না হওয়া কিংবা কোষ থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড বের করে ফেলতে না পারার নামই মৃত্যু। অক্সিজেন পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে~২১% অাছে সেখান থেকে দেহে প্রবেশ করে নিঃশ্বাস- প্রশ্বাসের মাধ্যমে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড দেহ থেকে বের করে দেয়া হয়। বাতাসের নাইট্রোজেন কোষে যাওয়া চলবে না। এই কাজটি করে ফুসফুস (LUNGS)। সে বাতাসের অক্সিজেনকে রক্তে পৌঁছে দেয় এবং কার্বন ডাই-অক্সাইডকে রক্ত থেকে দেহের বাইরে বের করে দেয়। কিন্তু অক্সিজেন ফুসফুসের বায়ুথলী সংলগ্ন রক্তে পৌঁছালেইতো চলবে না, সেখান থেকে দেহের প্রতিটি কোষে পৌঁছাতে হবে। এ কাজটি করে হৃদপিণ্ড বা ♥ হার্ট (HEART)। হার্টের প্রতিটি সংকোচনের সাথে সাথে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে রক্তনালীর মাধ্যমে। হার্ট প্রথমত অক্সিজেন কম এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড সমৃদ্ধ রক্ত ফুসফুসে সরবরাহ করে। ফুসফুস রক্তকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ করে। তারপর হার্টের পাম্প ফুসফুস সংলগ্ন সেই অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্তকে আবার হার্টে ফিরিয়ে আনে। তারপর সেই অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্তকে সারা দেহের সকল কোষে পৌঁছে দেয়।
রক্তনালী একটি ক্লোজ - সার্কিট এর মতো। একটি বড় রক্তনালী শাখা - প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে দেহের প্রতিটি কোষে পৌঁছে একটি জালের মতো বিস্তৃত হয়ে আবার ছোট রক্তনালী তৈরী করে ক্রমান্বয়ে বড় হতে হতে শেষ পর্যন্ত দুটি রক্তনালীর মাধ্যমে আবার হার্টে ফিরে আসে। এভাবেই ফুসফুস থেকে সংগৃহীত অক্সিজেন ♥ হার্ট সমস্ত দেহকোষে পৌঁছে দেয় যার নাম " রক্ত সঞ্চালন " প্রক্রিয়া।
এই রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেননা ♥ হার্ট, লাংগস্ ভালো থাকলেও রক্ত সঞ্চালনে যদি কোন বিঘ্ন সৃষ্টি হয় তাহলেও কোষগুলো বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয় আবার এই রক্ত সঞ্চালন এর জন্য প্রয়োজন রক্তের চাপ তাছাড়া রক্ত সচল থাকবে না কিন্তু রক্তচাপ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হলে আবার ঘটবে বিপত্তি। আবার হার্টের স্বাভাবিক কর্মের জন্য তার নিজের শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ তথা রক্ত সঞ্চালন জরুরী যে কাজটি সে নিজেই করে এবং ফুসফুস যেহেতু বাতাস থেকে অক্সিজেন আনে তাকেও রক্ত সঞ্চালন করে অক্সিজেন সরবরাহ করে ♥ হার্ট । তাই প্রাথমিকভাবে জীবন রক্ষার জন্য হার্ট - লাংগস অতীব জরুরী। কিন্তু এদের নিয়ন্ত্রণ আবার কেন্দ্রীয়ভাবে মস্তিষ্ক বা ব্রেইন (BRAIN) করে। ফলে জীবনের জন্য এই তিন অঙ্গ একটু বেশিই গুরুত্বপূর্ণ। তবে দেহের যেকোন অঙ্গ বিকল কিংবা গুরুতর অসুস্হ্য হলেই এদেরকেও ব্যর্থ করে দিতে পারে এবং জীবনের অবসান ঘটাতে পারে। তবে মস্তিষ্ক অকর্মণ্য হয়ে গেলেও হার্ট-লাংগস কৃত্রিমভাবে সচল রেখে মানুষকে অনেকদিন জীবিত রাখা সম্ভব। এই অবস্থাকেই ব্রেইন-ডেথ (BRAIN-DEATH) বলা হয়। যখন ধরে নেওয়া হয় যে ঐ ব্রেইন আর কর্মক্ষম হওয়া সম্ভব নয় তখনই এধরনের দেহ থেকে প্রতিস্থাপনযোগ্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন -- চোখের কর্নিয়া, কিডনি, লিভার ইত্যাদি সংগ্রহ করে অন্য কোন ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। অবশ্য তার জন্য ব্রেইন-ডেথ হওয়া ব্যক্তির জীবদ্দশায় পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয়। যেটার একটি গৌরবময় উদাহরণ আমরা কিছুদিন পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখতে পেয়েছি। সারাহ ইসলাম নামের ২০ বছরের মেয়েটি দুরারোগ্য রোগভোগের সময় তার মৃত্যুর পরে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্যের দেহে সংযোজনের অনুমতি দিয়ে রেখেছিল। ফলে তার যখন ব্রেইন-ডেথ হয় তখন তার দুটি কিডনি ও দুটি কর্নিয়া চারজনের দেহে প্রতিস্থাপন করে দু' জনের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং দু'জনের অক্ষম কিডনির কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া হয়। এভাবেই সারাহ ইসলাম এই চারজন ব্যক্তির মাধ্যমে দীর্ঘদিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকবেন। তিনি বস্তুত অমর হয়ে রইলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি এরূপ প্রথম মহান দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তবে উন্নত বিশ্বে সারাহ র দেহ থেকে দু'টি ফুসফুস ও হার্ট নিয়ে অারও এক বা একাধিক ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা হ'তো। ভারতে ফুসফুস প্রতিস্থাপনের LUNG TRANSPLANT এর সুযোগ আছে। ভবিষ্যতে আমাদের দেশেও হবে। তবে তারজন্য চাই এমন মহতী ত্যাগ।
যা বলছিলাম, তাহলে বেঁচে থাকার জন্য যেমন ♥ হার্ট - লাংগস এর স্বাভাবিক এবং একত্রিত কর্মক্ষমতা প্রয়োজন তেমনি এদের একটির অক্ষমতায় অপরটিও অক্ষম হয়ে পড়বে। হার্ট যখন অক্ষম হতে থাকে CARDIAC FAILURE) তখন ফুসফুসের অভ্যন্তরে তরল/ পানি জমতে শুরু করে এবং ফুসফুস সঠিকভাবে অক্সিজেন বাতাস থেকে রক্তে পৌঁছাতে পারে না ফলে শ্বাসকষ্ট হয়, রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি হতে থাকে এবং চরম অবস্থায় মৃত্যু অনিবার্য। আবার ফুসফুস যখন অক্ষম (RESPIRATORY FAILURE) হতে থাকে (বিশেষ করে ধূমপান জনিত COPD রোগে বা অন্য কোন রোগে) তখন বায়ু থেকে অক্সিজেন রক্তে সরবরাহ করতে এবং রক্ত থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমন্ডলে সরাতে ব্যর্থ হয়। তখন ♥ হার্ট পর্যাপ্ত রক্ত ফুসফুসে সঞ্চালন করতে ব্যর্থ হয় এবং নিজেও অক্সিজেনের অভাবে দূর্বল হতে থাকে। সেটিকে সংশোধনের চেষ্টায় ♥ হার্ট তখন আরও জোরে জোরে পাম্প করতে চেষ্টা করে একসময় ক্লান্ত হয়ে অক্ষম হয়ে পড়ে,ফলে আবার হার্টের ব্যর্থতা দেখা দেয় (CARDIAC FAILURE)। এভাবেই একটির ব্যর্থতা অপরটির ব্যর্থতা ঘটিয়ে ফেলে।দুটি মিলে যা ঘটে তাকে CARDIO-RESPIRATORY FAILURE বা হার্ট- লাংগসের ব্যর্থতা বলা হয়। এবং মৃত্যুর কারন শেষপর্যন্ত এটিই যদিও হাজারো কারনেই এমনটি ঘটতে পারে তবে মৃত্যু মানেই ♥ হার্ট - লাংগস উভয়ের ব্যর্থতা তার কারন যাই হোক।
এতসময় ধরে যে বিশাল ভূমিকার অবতারণা করেছি তার মূলে একটি উদ্দেশ্য আর তা হচ্ছে ♥ হার্ট এবং লাংগস বা ফুসফুসের চিকিৎসা সমন্বিত বা INTEGRATED / COMPREHENSIVE হওয়া প্রয়োজন। চিকিৎসা শিক্ষা এবং প্রশিক্ষনেও বিষয়টি সেভাবেই গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন। আবার এদূটি অঙ্গে রোগের উপসর্গগুলোও একইরকম হতে পারে -- যেমন - বুকে ব্যথা, কাশি কিংবা শ্বাসকষ্ট। প্রধানতঃ এ তিনটিই হার্ট কিংবা লাংগসের রোগের কিংবা উভয়ের রোগের উপসর্গ। ফলে একজন রোগীর পক্ষে এটি অনুমান করা সহজসাধ্য নয়। সাধারণ চিকিৎসকের পক্ষেও অনেকসময় বুঝে ওঠা কঠিন। আবার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে একই ছাদের নিচে হৃদরোগের এবং ফুসফুসের রোগের বিশেষজ্ঞ নাও মিলতে পারে। ফলে এইদূ'জন বিশেষজ্ঞের ♥ হার্ট এবং লাংগস উভয়ের রোগের একটা লেভেল পর্যন্ত ধারণা এবং চিকিৎসা করার সক্ষমতা থাকা প্রয়োজন ব'লেই আমার ব্যক্তিগত অভিমত। সারা দেশের জনগোষ্ঠীর জন্য সুন্দর সাবলীল রেফারেল ব্যবস্থা এবং একই ছাদের নিচে উভয় রোগের বিশেষজ্ঞ ব্যবস্থা সুচারুভাবে চালু করা গেলে তখন হয়তো ভিন্নভাবে চিন্তার সুযোগ থাকবে। এছাড়াও কিছু কিছু রোগ আছে যার চিকিৎসা উভয়বিধ বিশেষজ্ঞের সম্মিলিতভাবে এমনকি অন্যান্য বিশেষজ্ঞকে সঙ্গে নিয়ে করতে হয় যেমন-- PULMONARY HYPERTENSION (PAH) - এমন একটি রোগ যেখানে - ফুসফুসের বিশেষজ্ঞ, হৃদরোগের বিশেষজ্ঞ, RHEUMATOLOGIST, IMAGING SPECIALIST, CARDIAC INTERVENTIONIST, THORACIC SURGEON, HEART- LUNG TRANSPLANT SURGEON, ANESTHESIOLOGIST, PATHOLOGIST ইত্যাদি সকলের সমন্বয় প্রয়োজন।
সেটির সুযোগ যতক্ষণ পর্যন্ত না হচ্ছে ততক্ষণ জীবনের সার্থেই একজন চিকিৎসককে একটি লেভেল পর্যন্ত সমন্বিত বা COMPREHENSIVE চিকিৎসা দিতে হবে এবং সুযোগ থাকলেই অন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। তাহলেই রোগীদের মঙ্গল হবে।
কল্যাণ হোক সকলের।