24/02/2023
যৌনরোগ ও ইউনানী চিকিৎসা পর্ব ১০
গনোরিয়া – সংক্রমিত এক জটিল যৌন রোগ
ভাষানুযায়ী নাম বাংলাঃ প্রমেহ বা মূত্রনালীর ক্ষত, ইউনানীঃ সূযাক, আয়ুর্বেদিকঃ বিষ মেহ, ইংরেজীঃ Gonorrhoeal
পরিচিতি বা তারীফ (Description) :
গনোরিয়া একটি সংক্রামক যৌন ব্যধি যা নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যে হয়ে থাকে।
গনোরিয়া রোগটি আমাদের সমাজে প্রমেহ নামে পরিচিত। আসলে এটি একটি জীবাণুবাহিত রোগ। Neisseria gonorrhea নামক এটি জীবাণু দ্বারা রোগটি হয়ে থাকে। পৃথিবীজুড়ে এ রোগটির বিস্তৃতি যৌন রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এ রোগকে অনেকে সাধারণ মনে করে নিয়মিত চিকিৎসা করে না।
এ রোগের উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে বিশেষ করে বাত, প্রস্রাবে রক্তপড়া, প্রস্রাব বন্ধ হওয়া, পাখরি হওয়া, অন্ডকোষ ফুলা, প্রস্রাবে জ্বালা-যন্ত্রণা, শুক্রতারল্য, ধ্বজভঙ্গ প্রভৃতি রোগ লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
এ ছাড়া গনোরিয়ায় আক্রান্ত মায়ের পেট থেকে সন্তান জন্মের সময় এর পুজ বা রস সন্তানের চোখে লাগলে তার চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে।
অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা করলে এর জীবাণুকে ডটের মত বা 'কামার’ মত দেখা যায়। এরা জোড়ায় জোড়ায় একসঙ্গে অবস্থান করে বলে এদেরকে ডিপ্লোকক্কাসও বলা হয়।
এ কারণ বা আসবাব (Etiology ) &
সাধারণতঃ বহুগামী স্ত্রীলোকের সঙ্গে বা আক্রান্ত কোন লোকের সঙ্গে যৌন সংঙ্গমের মাধ্যমে গনোকক্কাস ( Gonoccus) নামক জীবাণু সংক্রমনে গনোরিয়া রোগের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া অনিয়মিত যৌন সংগম, অতিরিক্ত স্বপ্নদোষ ও অতিরিক্ত রেতঃ পাতের ফলে এ রোগ সৃষ্টি হতে পারে। অধিক তেজস্কর, গরম ও মিষ্টি দ্রব্য সেবন ও তেজস্কর মূত্রকারক ওষুধ সেবনেও এ রোগ হতে পারে।
লক্ষণ বা আলামত সমূহ ( Sign & Symptoms) :
১। গনোরিয়া জীবাণু শরীরে প্রবেশ করার ২-৩ দিনের মধ্যে প্রস্রাব নালীর মাথায় সুড় সুড় করে চুলকায় এবং সামান্য গরম ও লাল হয়ে জ্বালা অনুভব হয়।
২। প্রস্রাব করতে জ্বালা-পোড়া ও বেদনা অনুভব হয় এবং পুরুষাঙ্গের মাথায় আঠালো পুঁজ দেখা দেয়। এ ছাড়া পুরুষাঙ্গের মাথায় টিপ দিলে হালকা নীল বর্ণের তরল পুঁজ বের হয়। ক্রমে তা ঘন পুঁজ (Pus) এ রূপ নেয়।
৩। কুচকির গ্ল্যান্ডগুলো ব্যথা হয়ে সামান্য জ্বর অনুভব হয়। কখনো জ্বর বৃদ্ধি পেয়ে মাথা ব্যথা, প্রলাপ, মূর্ছা, হাত-পা ম্যাজ ম্যাজ করা, অস্বস্তি ভাব প্রভৃতি লক্ষণ। প্রকাশ পায়।
৪। উপযুক্ত চিকিৎসা না হলে পুরুষাঙ্গের মধ্যে লিটারস ও কাউপার গ্ল্যান্ডগুলো। আক্রান্ত হয়ে বার বার প্রস্রাবের বেগ ও প্রস্রাবের শেষ দিকে একটু রক্ত দেখা দিতে পারে। মলদ্বারের সম্মুখে ব্যথা হতে পারে।
৫। রোগের কঠিন অবস্থায় মূত্রনালী দিয়ে অনবরত হলদে, সাদা বা নীল বর্ণের পুঁজ পড়তে দেখা যায় এবং কাপড়ে দাগ লাগে। আবার কখনও রক্ত মিশ্রিত দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ নির্গত হয়। এ অবস্থা ৭ থেকে ২১ দিনের মত থাকে।
৬। রোগের পুরাতন অবস্থায় কেবল মূত্রনালী সামান্য সিজ থাকে অথবা অত্যধিক পরিশ্রমের পর সকাল বেলা ঘন সাদাটে একটু পুঁজ দেখা দিতে পারে।
৭। মলত্যাগের রাস্তায় আঙ্গুল দিয়ে প্রোষ্টেটকে মর্দন করলে তা থেকে যে নিঃস্বরণ বা সিকরেশন বের হয় তা অনুবিক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখলে Gonococus জীবাণু দেখা যাবে।
৮। প্রোয়োট গ্লান্ড ও সেমিনাল ভেসাইকল আক্রান্ত হলে দীর্ঘদিন ধরে রোগ চলতে থাকে। এ অবস্থার ব্যথাযুক্ত বীর্যপাত হবে এবং তাতে একটু রক্ত মিশ্রিত থাকবে এবং মলদ্বারের সম্মুখে ব্যথা অনুভব হবে। এ ছাড়া এপিডিমিস অথবা মুত্রথলি আক্রান্ত হয়ে থাকে। এ অবস্থায় বারবার প্রস্রাব হয় ও প্রস্রাবের শেষ দিকে ব্যথা অনুভব হয়।
রোগনির্ণয় বা তাশখীছ (Diagnosis)
লক্ষণ সমূহ দেখে রোগ নির্ণয় করতে হবে। এ ছাড়া Blood Examine for Warser Man Test. Khen Test এবং VDRL. TPHA Test দ্বারা রোগ নির্ণয় করা যায়।
চিকিৎসা পদ্ধতি বা উছুলে এলাজ (Treatment Process)
গনোরিয়া সাধারণ রোগ নয় একথা সবার স্মরণ রাখতে হবে। রোগাক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা করানো উচিৎ। এ রোগ সাধারণতঃ বহুগামী বা পতিতালয় থেকে ছড়ায় বলে তা থেকে দূরে থাকতে হবে।
এ রোগ অত্যন্ত ভয়ানক হলেও যদি যথাসময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা করা হয় তবে ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব। আর অবহেলা করে চিকিৎসা না করলে বহুকাল যাবত এর যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।
রোগের প্রথম অবস্থায় সহজ সূত্রকারক ওষুধ সেবন করতে হয় এবং সহ পিছকারী ওষুধ ১ ঘন্টা অন্তর কয়েকবার ব্যবহার করতে হয়। পাকস্থলী পরিষ্কার রাখতে হবে অর্থাৎ কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করতে হবে।
চিকিৎসা বা এলাজ (Treatment)
প্রথমে ক্ষত পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে প্রস্রাব নিঃস্বরণকারী ওষুধ ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন-
১। খিরারীতা, বাঙ্গীরীজা, গফুর, কাহু বীজ, ধনিয়া, সাদা চন্দন ৩ গ্রাম করে নিয়ে ক্বাথ তৈরী করে শরবত বুযুরী ৫০ মিঃ লিটার সহ সকাল-বিকাল সেবন করতে হবে।
২। খারে খশক, খতমী বীজ ৭ গ্রাম করে, খিরাবীজ ৯ গ্রাম, জিরা ৪ গ্রাম, কাসনী বীজ ৫ গ্রাম নিয়ে রাতে পানিতে ভিজিয়ে সকালে থেকে ৩৫ নিঃ লিটার শরবত ছন্দল সহ সকাল-বিকাল সেবা।
৩। ক্ষত ও জ্বালা-পোড়া নিবারণের জন্য- গেরুয়াটি ১০ গ্রাম, চিনি ২০ গ্রাম নিয়ে চূর্ণ করে হেঁকে সংরক্ষণ করতে হবে। ৩ গ্রাম করে পাউডার মাঠা বা মাখন সহ সকাল-বিকাল খালি পেটে সেবা।
৪। শ্বেতধূপ, সোহাগা খৈ, ফিটকারী খৈ ১০ গ্রাম করে, চিনি ওষুধের সমান নিয়ে চূর্ণ করে ছেকে সংরক্ষণ করতে হবে। ৬ গ্রাম করে পাউডার সকাল-বিকাল শরবত মুছাফফী বা ঠান্ডা পানি সহ সেব্য।
৫। কাবাব চিনি ১৫ গ্রাম, সাদা খয়ের, শূরা কলমী, জিরা, ছোট এলাচী দানা, জামালগোটা ৫ গ্রাম করে, সত্তে বিরোজা ১০ গ্রাম নিয়ে কুটে পিষে ৯টি পুড়িয়া করে সংরক্ষণ করতে হবে। ১টি করে পুড়িয়া সকাল-বিকাল কাঁচা দুধ সহ সেব্য।
৬। শিলাজুত কখ, শূরা কলমী, ফিটকারী খৈ, সাদা খয়ের, বড় এলাচী দানা ১২ গ্রাম করে নিয়ে চূর্ণ করে হেঁকে ৭৫ গ্রাম চিনি মিলিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। ৭ গ্রাম করে পাউডার দুধ বা ঠাণ্ডা পানি সহ সকাল-বিকাল সেব্য।
৭। হরিতকী, বহেড়া, আমলকী, বর্গে হেনা ১২ গ্রাম করে নিয়ে ২ লিটার পানিতে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে চটকিয়ে হেঁকে সে পানিতে আনজরুত, দাম্বুল আখওয়াইন, সফেদা কাশগরী, রেসোয়াত, কাফূর, সুরমা, আরমানীয়ান মাটি, মুর্দাসঙ্গ, নীল বেলায়েতী ১ গ্রাম করে নিয়ে ভালভাবে চূর্ণ করে মিলিয়ে পিচকারী করতে হবে।
৮। কাতিরা গাম ২ গ্রাম, নেশান্তা, আরমানীয়ান মাটি ১ গ্রাম করে, কাফূর ৫০০ মিঃ গ্রাম আফিম ১২৫ মিঃ গ্রাম নিয়ে চূর্ণ করে স্ত্রী লোকের দুধে বা মুরগীর ডিমের সালা অংশের সাথে বেটে বতি প্রস্তুত করে মূত্রনালীতে সিয়াফ বা বতি হিসেবে প্রবেশ করিয়ে রাখতে হবে।
এ রোগের বাজারে প্রচলিত ওষুধ সমূহঃ
১। হারে সূর্যাক / হারবাল সূর্যাক।
২টি করে ট্যাবলেট সকাল-বিকাল মাঠা বা ঠান্ডা পানি সহ সেব্য।
২। এত্রিফল শাহতারা / হারবাল শাহ্হ্তারা / শাহতারা কম্পাউন্ড
১ চা-চামচ করে ওষুধ সকাল-বিকাল খালি পেটে পানি সহ সেব্য।
৩। মাজুন ছবচীনী / মাজুন ওশবা / হারবাল চুবচীনী।
১ চা-চামচ করে ওষুধ দিন ২ বার পানি সহ সেব্য।
৪। শরবত বুযূরী / হারবাল বুযূরী / কেলিহার্বস
৪ চা-চামচ করে ওষুধ দিন ৩-৪ বার পানি সহ সেবা।
পরামর্শঃ
দুধ, সাবু, বার্লি, এরারুট, মুগডালের খিচুড়ী রোগের প্রথম অবস্থায় পুরাতন চিকন চালের ভাত, লাউ, ঝিঙ্গা, শশা, কাঁকুড়, কলার থোর, কলার মোচা, কলা এবং মুরগীর বাচ্চার এখুনিতে চাল পাক করে সেবা।
সকল প্রকার গরম দ্রব্য, মাংস, ডিম, মরিচ, টক, মদ, চা, কফি, অধিক মিষ্টি অধিক লবন, অধিক ভ্রমণ, অত্যধিক শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম এবং সকল প্রকার গুরুপাক দ্রব্য ও স্ত্রী সহবাস নিষেধ।
বিঃদ্রঃ একজন অভিজ্ঞ হাকিম, কবিরাজ অথবা হার্বালিষ্ট এর পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।