
03/02/2023
ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা একটি মারাত্মক মানসিক সমস্যা।যা একটা মানুষকে ভেতর থেকে শেষ করে দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন লোক এই বিষন্নতা ব্যাধিতে ভুগছে যা তাদেরকে অক্ষমতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশেও দিন দিন বিষন্নতায় ভোগা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমে বুঝতে হবে ডিপ্রেশন কি? কেন হয়? ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলো কি? যদি একবার নিশ্চিত হতে পারেন আপনার এ রোগ আছে তবেই না সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে তা থেকে উপশম পেতে পারবেন।
ডিপ্রেশন কি...?
ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা একটি মারাত্মক মানসিক সমস্যা।যা একটা মানুষকে ভেতর থেকে শেষ করে দেয়।যা আপনার অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা ও কাজকর্মের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।ডিপ্রেশন 'Silent Killer' এর মতো মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
ডিপ্রেশন যে কতোটা ভয়াবহ ব্যাধি যে ভুগেছে সে ছাড়া কেউ ই বুঝতে পারবে না।যা একটা সুস্থ মানুষের জীবনের সব কিছু উল্টো পাল্টা করে দেয়।তারা স্বাভাবিক লাইফের কোনো কাজ করতে পারে না, তারা খুলে হাসতে পারে না,ঠিক মতো কারো সাথে কথা বলতে পারে না,যে কোনো সময় কান্না করে।সে এক ভয়াবহ অবস্থা।যা কেউ বুঝতে পারে না।যা কাউকে বুঝানো যায় না।যা আমাদের আপন জনের সাথে ও সম্পর্ক নষ্ট করে।
অনেক সময় দু:খবোধ (Sadness) ও বিষন্নতাকে (Depression) এক বলে মনে করি। এ দুটো কিন্তু এক নয়। দু:খবোধ হলো সাময়িক মন খারাপ যা অল্প কিছু সময় পরেই ঠিক হয়ে যায়। এর জন্য কোন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে, ডিপ্রেশন দীর্ঘকালীন সমস্যা। যা থেকে মুক্তি পাবার জন্য উপযুক্ত চিকিৎসার ও পরামর্শের প্রয়োজন হয়ে থাকে।
ডিপ্রেশনের লক্ষনগুলো হলো...
১.সবসময় মন খারাপ লাগে।
২.কিছু করতে ইচ্ছা করে না,কিছু করতে ভালো লাগে না।
৩.কোনো ব্যাপারে মনস্থির করতে সময় লাগে।
৪.যে কাজ আপনি সহজে করতে পারতেন,সে কাজ করে উঠতে না পারা।
৫.খুব ক্লান্ত লাগা।
৬.খুব অস্থির লাগা।
৭.ক্ষুদা না পাওয়া ও ওজন কমা(কিছু ক্ষত্রে এর উল্টো টা হয়,খাওয়া বেড়ে যাওয়া,ওজন বেড়ে যাওয়া)
৮.নিদ্রাহীনতা
৯.আত্মবিশ্বাসের অভাব বা আস্থা হারানো।
১০.নিজেকে অপদার্থ বা অকর্মন্য মনে করা।
১১.বিরক্ত লাগা।
১২.দিনের কোনো এক সময় বেশি বিষন্ন লাগা।
১৩.আত্মহত্যার কথা ভাবা।
আমরা এই সবকিছুর থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য নিজেকে ব্যস্ত রাখি যাতে আমরা আরো ক্লান্ত হয়ে পরি।
কেনো হয় ডিপ্রেশন...?
কেনো এ রোগ হয় নির্দিষ্ট করে কারো পক্ষেই তা বলা সম্ভব না। তবে অনেকের ক্ষেত্রেই কিছু কমন কারণ থাকে যার জন্য এ রোগের উৎপত্তি হতে পারে।
১. অপমানবোধ
মানসিক বা শারীরিকভাবে অবমাননার স্বীকার হলে অনেকে ডিপ্রেশন আক্রান্ত হয়।
২.নিরাপত্তাহীনতা বা একাকিত্বতা
সামাজিক ও পারিবারিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেকে ডিপ্রেশনের স্বীকার হয়। তাছাড়া, বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব বা অন্যান্য কাছের মানুষদের সাথে সম্পর্কহীনতা একাকিত্বতার কারণে ডিপ্রেশনে ভোগে।
৩.মৃত্যুশোক
কাছের মানুষের মৃত্যু অনেকের ক্ষেত্রে ডিপ্রেশনের ঝুঁকি বাড়ায়।
৪.বংশগত প্রভাব
পরিবারে কারো ডিপ্রেশন থাকলে তা অন্যদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
৫.জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তন
জীবনে বড় কোন পরিবর্তন ঘটলে তা থেকে অনেকে বিষন্নতায় ভুগে। চাকরি হারালে, অবসরে গেলে, আয় কমে গেলে, জায়গা পরিবর্তন করলে, বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে, এমনকি, নতুন বিয়ে করলেও অনেকে ডিপ্রেশনের শিকার হয়।
৬.বড় কোনো রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
বড় ধরণের কোন রোগ থাকলে রোগী ডিপ্রেশনের শিকার হতে পারে।
৭.ঔষধের প্রভাব
নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ সেবনের ফলেও কেউ কেউ ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়। যেমন, ব্রণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত আইসোট্রেটিনিয়ন বা অ্যান্টিভাইরাল ‘ইন্টারফেরন-আলফা’ জাতীয় ঔষধ সেবনেও অনেকে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়।
এছাড়াও বিভিন্ন কারণে মানুষ ডিপ্রেশনে ভুগে থাকে। ব্যক্তিভেদে ডিপ্রেশনের কারণে পার্থক্য দেখা যায়।
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায়ঃ
১.মেডিসিন
২. সাইকোথেরাপিইঃ ডিপ্রেশন আপনাকে অসহায় অবস্থায় পতিত করবে। ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন ধরণের থেরাপি ও চিকিৎসার পাশাপাশি নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। নিজের চেষ্টা না থাকলে এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। নিজের প্রতিদিনের কাজকর্ম, খাওয়া-দাওয়া, জীবনপ্রণালী এমনকি চিন্তা-ভাবনায়ও পরিবর্তন আনতে হবে ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির জন্য।
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির জন্য নিচের পয়েন্টগুলো সহায়ক হতে পারেঃ
১.রুটিনমাফিক চলাঃ
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পেতে প্রতিদিনের জীবনকে একটা রুটিনের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। প্রতিদিনের কাজ-কর্মকে যদি একটা নিয়মের মধ্যে বেঁধে ফেলা যায় তবে তা ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে।
২.লক্ষ্য নিয়ে কাজ করাঃ
লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। ডিপ্রেশনে যেহেতু কোন কাজ করতে ইচ্ছা করেনা তাই প্রতিদিন একটু একটু করে কাজ করার জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।
ধরা যাক, প্রথম দিন আপনি ঠিক করলেন আপনি আজ একটা মজার কিছু রান্না করবেন। যদি আপনি সেই কাজটা ঠিক মত করতে পারেন তবে পরের দিন আর একটু বেশি কিছু করার কথা চিন্তা করতে হবে। এভাবে ধীরে ধীরে কাজের সাথে সম্পৃক্ততা বাড়াতে পারলে এক সময় ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
প্রতিদিন অল্প কিছু সময় ব্যায়াম করলে তা আপনার শরীর এবং মনকে সুস্থ রাখবে। ব্যায়াম করা মানে, ম্যারাথন দৌড় টাইপ কিছু না, আপনি যদি প্রতিদিন কিছু সময় হাঁটাহাটি করেন তবুও তা আপনার মস্তিষ্কে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যা আপনাকে ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করবে।
৩.সুষম খাদ্য গ্রহণঃ
সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি মেলে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন খাবারে প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ থাকে। সাইক্রিয়াটিস্টদের মতে, যেসব খাবারে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এ্যাসিড এবং ফলিক এসিড থাকে সেসব খাবার ডিপ্রেশন কমাতে সহায়তা করবে।
ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা একটি মারাত্মক মানসিক সমস্যা।যা একটা মানুষকে ভেতর থেকে শেষ করে দেয়।
৪.অনিদ্রা দূর করাঃ
পর্যাপ্ত ঘুম ডিপ্রেশন কমায়। ডিপ্রেশনের রোগীদের নিদ্রাহীনতা দেখা দেয়। তাই, প্রথমেই ঘুম সমস্যার সমাধান করতে হবে। প্রতিদিনের জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে নিদ্রাহীনতা দূর করা সম্ভব। প্রতিদিন ঠিক সময়ে ঘুমোতে যাওয়া এবং সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। দিনের বেলার হালকা ঘুমের অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে। শোবার ঘর থেকে টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল এগুলো সরিয়ে রাখতে হবে। এভাবেই অনিদ্রা রোগ ধীরে ধীরে দূর করা সম্ভব।
৬.ইতিবাচক চিন্তা করাঃ
ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকলে মানুষের মনে বিভিন্ন রকম নেগেটিভ চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। যেমন, আমিই বুঝি সবচেয়ে খারাপ, আমার মত দুঃখ কারো নেই, আমি সবার চেয়ে অসুস্থ, আমি ব্যর্থ একজন মানুষ- এই ধরণের চিন্তাগুলো সুস্থ হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। তাই, এই নেগেটিভ চিন্তাগুলোকে মন থেকে দূর করে পজিটিভলি চিন্তা করার চেষ্টা করতে হবে। যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিচার করতে হবে। আশাহত হওয়া যাবে না কোনভাবেই।
৭.আনন্দদায়ক কাজের মধ্যে সময় কাটানোঃ
নতুন কিছু করার চেষ্টা করতে হবে। মজার কোন কাজ। যেমন, নতুন কোথাও ঘুরতে যাওয়া, মজার কোন বই পড়া, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া। মন ভালো রাখার সবরকম চেষ্টা করতে হবে। মন ভালো থাকলে ডিপ্রেশন কেটে যাবে একসময়।
৮.Psychiatrist / Psychologist এর পরামর্শ গ্রহণ করা।
এই সব কিছুর থেকে উপরে হচ্ছে নিজের ইচ্ছা শক্তি। নিজের মধ্যে ইচ্ছা শক্তি থাকলে সকল সমস্যা কে দূর করা সম্ভব।নিজেকে ভালোবাসলে সহজে ভালো থাকা যায়। আর আমাদের নিজেকে ভালোবাসতে হবে😊😊
ডিপ্রেশন পুরোপুরি না ভালো হওয়া পর্যন্ত পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।