03/06/2021
লিভার সিরোসিস কি?
লিভার সিরোসিস একটি মারাত্মক ও অনিরাময়যোগ্য রোগ। এতে যকৃৎ বা লিভারের কোষকলা এমনভাবে ধ্বংস হয়ে যায় যে তা সম্পূর্ণ বিকৃত ও অকার্যকর হয়ে পড়ে। লিভার সিরোসিসে লিভারে সূক্ষ্ম সুতার জালের মতো ফাইব্রোসিসের বিস্তার ঘটে। লিভারে ছোট ছোট গুটি দানা বাঁধে। ফলে লিভারের যেসব স্বাভাবিক কাজ আছে, যেমন বিপাক ক্রিয়া, পুষ্টি উপাদান সঞ্চয়, ওষুধ ও নানা রাসায়নিকের শোষণ, রক্ত জমাট বাঁধার উপকরণ তৈরি ইত্যাদি কাজ ব্যাহত হয়। দেখা দেয় নানাবিধ সমস্যা। ধীরে ধীরে এই রোগ মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় মানুষকে।
কেন হয়?
এই তালিকাটি অনেক বড় এবং দেশভেদে সিরোসিসের কারণগুলোও বিভিন্ন। ইউরোপ ও আমেরিকায় সিরোসিসের প্রধান কারণ এ্যালকোহল আর হেপাটাইটিস সি ভাইরাস। বাংলাদেশে প্রায় আড়াই হাজার রোগীর উপর জরীপ চালিয়ে দেখা গিয়েছে যে, এদেশে লিভার সিরোসিসের প্রধাণ কারণ হেপাটাইটিস বি ভাইরাস, আর এর ঠিক পরেই রয়েছে ফ্যাটি লিভার। হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ও এ্যালকোহলের স্থান বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস ও ফ্যাটি লিভারের অনেক পরে। হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস সংক্রমণ কারও কারও ক্ষেত্রে ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি আকার ধারণ করে সিরোসিসে পরিণত হয়।
ফ্যাটি লিভার নানা কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিস, ডিজলিপিডেমিয়া (রক্তে চর্বি বেশী থাকা ), ওবেসিটি (স্থুলতা /মেদ-ভুড়ি), উচ্চরক্ত চাপ আর হাইপোথাইরয়ডিজম ফ্যাটি লিভারের প্রধাণ কারণ। পাশ্চাত্যে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত প্রায় ৩০ শতাংশ রোগী পরবর্তীতে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হন। এদেশেও আমরা ফ্যাটি লিভার জনিত লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের রোগী পেয়ে থাকি।
এ ছাড়া দীর্ঘদিন অ্যালকোহল গ্রহণ, যকৃতে মাত্রাতিরিক্ত চর্বি, অতিরিক্ত আয়রন, কপার জমে যাওয়া এবং কিছু অটোইমিউন রোগের (দেহের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থায় কোনো অস্বাভাবিকতার কারণে সৃষ্ট) কারণেও লিভার সিরোসিস হতে পারে। যেসব কারণে লিভার সিরোসিস হয়, সেগুলো যদি আগেই ধরা পড়ে, তাহলে অবশ্যই তাকে সঠিকভাবে চিকিৎসা করতে হবে; যাতে ভবিষ্যতে তার লিভার সিরোসিস না দেখা দেয়। আসলে প্রতিরোধই মূল চিকিৎসা। সিরোসিস একবার হয়ে গেলে তারপর যদি চিকিৎসা করা হয়, তারপরও শরীর পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে না। সুতরাং কারণ যদি ধরা পড়ে এর সঠিক চিকিৎসা করতে হবে।
লিভার সিরোসিসের উপসর্গ ও জটিলতা:
লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত সবার ক্ষেত্রে শুরুতে তেমন উপসর্গ থাকে না। পেটের আল্ট্রাসাউন্ড কিংবা পেটে অস্ত্রোপচার করাতে গিয়ে হঠাৎ এ রোগ নির্ণয় হয় কারও কারও। হঠাৎ রক্তে লিভার এনজাইমের অস্বাভাবিকতা বা আলট্রাসনোগ্রাফিতে লিভারের আকার-আকৃতির পরিবর্তনের কারণ খুঁজতে গিয়ে লিভার সিরোসিস ধরা পড়ে। কোনো কোনো রোগীর শারীরিক দুর্বলতা, অবসাদ, অরুচি, পেটে অস্বস্তি, ওজন কমে যাওয়া, পায়ের পেশিতে অস্বস্তি বা ক্রাম্পের মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। শারীরিক পরীক্ষায় যকৃৎ এবং কখনো কখনো প্লীহা বড় পাওয়া যায়। লিভার সিরোসিস থেকে লিভার ফেইলিউর হলে পেটে ও পায়ে পানি আসে, চোখ ও প্রস্রাব হলুদ হয়ে যায়, রক্তবমি ও কালো পায়খানাও হতে পারে। অনেকের কথাবার্তায় অসংলগ্নতা, অস্বাভাবিক আচরণ, এমনকি চেতনা হারানোর মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। লিভার সিরোসিস থেকে লিভারের ক্যানসারের ঝুঁকিও কম নয়।
সিরোসিস প্রতিরোধে করণীয়
হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধে রয়েছে কার্যকর ভ্যাকসিন। জন্মের পরপর কিংবা ইপিআই শিডিউলে বাচ্চাদের হেপাটাইটিস বির টিকা দেওয়া হয়। হেপাটাইটিস বির টিকা সারা জীবন ধরে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। হেপাটাইটিস সি প্রতিরোধে কোনো টিকা নেই। তবে অরক্ষিত যৌন সম্পর্ক পরিহার, একই ক্ষুর বা রেজরে একাধিক ব্যক্তির শেভ না করা, যেকোনো প্রকার মাদকাসক্তি পরিহার, রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে যথাযথ পরীক্ষা, চিকিৎসার যন্ত্রপাতি সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করে অস্ত্রোপচার, দাঁতের চিকিৎসায় জীবাণুমুক্ত সরঞ্জাম ব্যবহারের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি এবং সি থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব।
সিরোসিস হলে কি করবেন?
লিভার সিরোসিস হলেই যে রোগীর মৃত্যু হবে, তা কিন্তু হয়। এ রোগের আধুনিক চিকিৎসা রয়েছে। সিরোসিসে আক্রান্ত যে কোন ব্যাক্তির উচিত দ্রুত লিভার বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে চিকিৎসা নেয়া ও নিয়মিত ফলোআপে থাকা। এতে দীর্ঘদিন ভালো থাকা যায়। পাশাপাশি সিরোসিসের কারণ শনাক্ত করে তার চিকিৎসা করা গেলে লিভারের খারাপের দিকে যাওয়ার ঝুকিও অনেক কমে যায়। রাস্তাঘাটে বিক্রি হওয়া দূষিত পানীয়, মাড়াই আখের রস, ব্যবহার হওয়া বরফ, শরবত, কেটে রাখা ফলফলারির মাধ্যমে হেপাটাইটিস এ এবং ই-এর সংক্রমণ হয়। এভাবে জন্ডিসে আক্রান্ত হলে লিভার সিরোসিস আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। এই সমস্যায় আক্রান্ত হলে অবহেলা না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করা যাবে না। হেপাটাইটিসে সংক্রমণ হলে ঝাড়ফুঁক-জাতীয় চিকিৎসা না করে দ্রুত বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা নিন। লিভার সিরোসিস ও এর কারণগুলোর আধুনিকতম চিকিৎসা আজ এদেশেই সম্ভব। দেশেই তৈরী হচ্ছে অধিকাংশ ওষুধও। এদেশে যা নেই তা হলো লিভার প্রতিস্থাপন বা ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের ব্যবস্থা। বাংলাদেশে এরই মধ্যেই কয়েকটি লিভার প্রতিস্থাপন সার্জারি হয়েছে। তবে এই মুহূর্তে কিছু সমস্যার কারণে এই সার্জারি করা যাচ্ছে না। প্রতিবেশী দু-একটি দেশে এ সুযোগ থাকলেও তা খুবই ব্যয়বহুল আর সঙ্গত কারণেই আমাদের সিংহভাগ রোগীর সাধ্যের অতীত। সেদিন হয়তো আর বেশী দুরে নয় যেদিন এদেশেই অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন সম্ভব হবে।
ডাঃ আবদুল্লাহ আল কাইয়ূম
লিভার ও পরিপাকতন্ত্র বিশেষজ্ঞ
শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।