09/02/2023
আল কুদস
❑
গাজি সালাহুদ্দিন আইয়ুবি রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক—এসব সেক্টরে উল্লেখযোগ্য সংস্কার সাধনের পর তাঁর সেনাবাহিনীকে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে সেই মহাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে আদেশ করেন, যেটি ইসলামি সালতানাতের ওপর ক্রুসেডারদের আক্রমণের শুরু থেকে দীর্ঘকালব্যাপী চলে আসা লড়াইয়ের ইতিহাসকে নতুনভাবে লিখতে বাধ্য করে। এই মোকাবিলা ‘হিত্তিনের যুদ্ধ’ নামে প্রসিদ্ধ। এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২২ রবিউস সানি, ৫৮৩ হিজরি মোতাবেক ১ জুলাই, ১১৮৭ খ্রিষ্টাব্দে। এটি ছিল মুসলিম ভূখণ্ডে ক্রুসেডার কর্তৃক আক্রমণের সূচনার প্রায় ৯০ বছর পর।
ফিলিস্তিনের হিত্তিন অঞ্চলে ক্রুসেডাররা তেষট্টি হাজার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীকে একত্রিত করে। দুই দলই বুঝতে পেরেছিল যে, এটি হচ্ছে চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণকারী যুদ্ধ। ক্রুসেডের ইতিহাস লিপিবদ্ধকারী বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে শাদ্দাদের (৬১৩-৬৮৪ হি.; ১২১৭-১২৮৫ খ্রি.) ভাষায়—
“দুই দলের প্রত্যেকেই জেনে গেছে যে, এখানে যে দল হেরে যাবে, সে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হবে। তাদের জীবনের বিনাশ ও ভূমি হাতছাড়া হওয়া অবধারিত। কারণ, হিত্তিন হলো জেরুসালেম নগরীর প্রবেশদ্বার—যে নগরী সংঘাতের মূল কেন্দ্রবিন্দু।”
জুলাই মাসের গ্রীষ্মের তাপদাহকে আরও উষ্ণ করে তুলেছে ক্রুসেডশক্তির চারপাশে ছড়িয়ে দেওয়া আইয়ুবি বাহিনীর লড়াইয়ের আগুন। দুই পক্ষের তুমুল সংঘর্ষ ও লড়াইয়ে সেই উত্তাপ-উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করে।
ইতিহাসবিদ ম্যাক্সিমাস মনরন্ড লিখেছেন,
“উভয় পক্ষের মধ্যে এমন তুমুল লড়াই চলছিল যে, পাখির ছোটাছুটির ন্যায় বাতাসে তিরের ছোটাছুটি পরিলক্ষিত হচ্ছিল! আর তরবারি থেকে ঝরা রক্ত, বৃষ্টির পানির মতো জমে ছিল জমিনে!”
অবশেষে হিত্তিন রণাঙ্গনে যখন ক্রুসেডার রাজা গাই অব লুজিনানের (Guy of Lusignan) বাহিনী পরাজিত হয় এবং রাজা তাঁবু খুলে পলায়ন করে, তখন সালাহুদ্দিন আইয়ুবি এই মহাবিজয়ের শুকরিয়াস্বরূপ ঘোড়া থেকে নেমে আল্লাহর রাহে মাটিতে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। এই বিজয় তাঁর জন্য পবিত্র আল-কুদসের পথ খুলে দেয়।
ঐতিহাসিক আবু শামা (৫৯৯-৬৬৫ হি.; ১২০২-১২৬৭ খ্রি.) সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন—
“সেদিন এত অধিকসংখ্যক ক্রুসেডার নিহত হয়েছিল যে, তাদের কেউ দেখলে বলবে—বন্দি করার মতো হয়তো তাদের মধ্যে আর কেউ বেঁচে নেই। অপরদিকে অধিকসংখ্যক বন্দিদের দেখলে বলবে—সেখানে হয়তো নিহত কেউ নেই, সবাইকে বন্দি করা হয়েছে। শামের উপত্যকায় ফিরিঙ্গিদের দখলদারির পর থেকে মুসলিমদের আজকের মতো অর্জন আর অর্জিত হয়নি।”
গাজি সালাহুদ্দিন আইয়ুবি কয়েক ডজন গ্রাম, শহর, কেল্লা ও দুর্গ স্বাধীন করার পর তাঁর বাহিনীকে জেরুসালেম অবরোধের নির্দেশ দেন—যেই জেরুসালেমের অধিকার নিয়েই সংঘাত ও সংঘর্ষ। ফিলিস্তিনের গাজা বিজয় অর্জন করার পর কবি ইমাদ সালাহুদ্দিন আইয়ুবিকে উদ্দেশ্য করে কাব্যিক ভাষায় বলেন—
غزوا عقر دار المشركين بغزة + جهاراً وطرف الشرك خزيان مطرق
وهيجت للبيت المقدّس لوعة + يطول بها منه إليك التشوّق
هو البيت إن تفتحه، والله فاعل + فما بعده باب من الشام مغلق .
“তারা গাজায় মুশরিকদের আস্তানায় প্রকাশ্যে হেনেছে আঘাত,
ফলে শিরিকের দোস্তদের হয়েছে আজ চরম অপমান ও মুণ্ডুপাত।
হৃদয়ের দহন বেড়েছিল বহু, বায়তুল মাকদিসের বিরহব্যথায়,
বিজয়ের তরে পবিত্র গৃহ সদা ছিল ব্যাকুল আপনার অপেক্ষায়।
আল্লাহ করুন, যদি এই ঘর হয় অবমুক্ত,
তবে রবে না শামের পানে কোনো দ্বার রুদ্ধ।”
আসলেই, আল-কুদস হচ্ছে মর্যাদার প্রতীক, স্বাধীনতার চূড়ান্ত মনজিল ও বিজয়ের চাবি।