17/04/2025
আমার মেডিকেলের ( চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ) বড় আপা মুন্নি আপা। একজন অসম্ভব মেধাবী মানুষ। যেমন পড়ালেখায় তেমনি পড়ালেখার বাইরে যে কোন বিষয়ে সমান পারদর্শী। কিন্তু কোথাও অহংকার এর ছিটে ফোটা নেই।
আপার জীবনের কথা তার নিজের হাতে লেখা। আমার অটিজম রোগীদের বাবা মায়েদের জন্য খুব শিক্ষনীয় একটি লেখা, একই সাথে খুব প্রেরণা দায়ক। সময় থাকলে পড়ে দেখবেন।
★***********★*************★************★
আচ্ছা, আপনাদের কি কখনো মরে যেতে ইচ্ছে করে? এক অসম্ভব বিষাদে ভাসতে ভাসতে মনে হয় আর বাঁচতে চাইনা, একেবারেই না। আমারও খুব মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল, জীবনে মাঝে মাঝে এমন মনে হয়, কিন্তু প্রচন্ড কষ্টে খানখান হতে হতে নিজেকে শেষ করে দেয়ার সেই ইচ্ছে একেবারে অন্যরকম। সেদিন ছিলো আগষ্টের পোড়া গরমের শেষে একটা গুমোট বিকেল। আমি আমার দু বছরের ছেলেটাকে বুকে নিয়ে ধানমন্ডির এক হাসপাতালে ডাক্তারের রুমের সামনে বসে আছি, থরথর কাঁপছি। খানিক আগেই শুনেছি আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর সংবাদ, আমার ছেলেটার সমস্যা, যা নিয়ে থাকতে হবে আজীবন, করতে হবে এক অসম যুদ্ধ।
বাসায় কিভাবে ফিরেছি জানিনা, ফিরে আমাদের বিশাল শোয়ার ঘরের মোজাইক করা ঠান্ডা মেঝেতে গড়িয়ে গড়িয়ে কেঁদেছি। আমার মনে হয়েছে, আর নয়, আমি আর বাঁচতে চাইনা একটি মূহুর্তও। বড্ড অভিমানে এই জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে বহুদূরে চলে যেতে ইচ্ছে করছিলো ভীষণ। একদিন গেছে, দু'দিন গেছে, আমি কেঁদেই গেছি। মরে যাওয়ার ওই ইচ্ছেটার মাঝখানেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসেছি, চোখ মুছতে মুছতে ভেবেছি, আরে! কি বোকার মতো ভাবছি মরে যাবো বলে! আমার তো মরা চলবেনা, আমাকে তো বরং বাঁচতে হবে দারুণ সুস্থ, সুন্দর ভাবে। নাহলে আমার এই দেবশিশুর মতো সন্তান, যে কিনা অনেক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জীবন কাটাবে, তার পাশে থাকবে কে? তার হাত ধরে রাখবে কে? সেই থেকে মরে যাবো বলে ভাবিনা, কোন অভিমান, কোন বিষাদ বেদনায় ভেঙে যেতে যেতেও ভাবি বাঁচতে হবে, আমার আজীবন শিশু হয়ে রয়ে যাওয়া বাপজানের জন্য। শতেক কষ্টেও স্রস্টার কাছে পরমায়ু চাই, আমার ছেলের সমান পরমায়ু।
আমি জানি, আর জানে আমার মতো শত হাজার মায়েরা, বাবারা। নিজের সন্তানের প্রতিবন্ধকতার এই সংবাদে কি এক অসম্ভব আঘাতে জর্জরিত হতে হয়। জীবন পালটে যায়, জীবনের পরিকল্পনাগুলো এলোমেলো হয়ে যায়, তবুও তো জীবন এগোয়, দিনগুলো কাটে, সময় গড়ায়। এক হঠাৎ আঘাত, মেনে নেয়া খুব কঠিন, কিন্তু মেনে না নিয়েও উপায় নেই।
আপনার সন্তানের অটিজম সনাক্ত হলে কি করবেন? করতে হবে অনেক কিছুই। প্রথমে কাঁদুন প্রাণ ভরে, তারপর মেনে নিন, সমস্যাটিকে। সমস্যা স্বীকার না করলে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। কখনো নিজের দোষী বা দায়ী ভাববেন না। এই সমস্যার পেছনে আপনার কোন হাত নেই। সমস্যা লুকিয়েও রাখার দরকার নেই। কাছের নির্ভরযোগ্য মানুষদের সাথে আলোচনা করুন, প্রয়োজনে সাহায্য প্রার্থনা করুন। মনে রাখবেন, এ আপনার লজ্জা, দোষ বা দায় নয়, একটা সমস্যা মাত্র, যা যে কারোরই হতে পারতো বা পারে।
এরপর প্রয়োজন ভালো কোন বিশেষজ্ঞ বা সেন্টারের দ্বারস্থ হয়ে অটিজম আছে কিনা পুনরায় নিশ্চিত হওয়া এবং কোন পর্যায়ে আছে তা নির্নয় করা। তারপর শিশুটির কি চিকিৎসা প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা। সবার সব চিকিৎসা দরকার পড়েনা। আর চিকিৎসা নিয়ে খুব অস্থির হয়ে একযোগে সবকিছু শুরু করলে তা খুব একটা ভালো ফল আনেনা।
সবচেয়ে ভালো হয় নিজেরা, মা বাবা বা পরিবারের আপনজনেরা যদি পর্যাপ্ত সময় দেন। তবে একজনের জন্য সেটা বেশ ক্লান্তিকর বলেই সময় ভাগ করে নিলে খুব ভালো। তবে, এইসব শিশুরা যেহেতু তাদের সমস্যা বা অসুবিধার কথা বর্ণনা করতে পারেনা, অবশ্যই অন্য কারোর সাথে বাচ্চা থাকলে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ছোট ছোট গঠনমূলক কাজ বা খেলা শিশুর বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটাতে পারে। কিন্তু মোবাইল বা টেলিভিশন মস্তিষ্কের বিকাশ ধীর করে, তাই ছবির বই, ব্লকের খেলনা, কাগজ বা কাঠ ইত্যাদি দিয়ে কিছু তৈরি করা, ইত্যাদি ব্যাপারগুলো শিশুর মানষিক বিকাশের জন্য উপকারী।
যেহেতু এটি দীর্ঘমেয়াদি এক কার্যক্রম, বলা যায় সারাজীবনের যুদ্ধ, তাই প্রথমেই খুব অস্থির হয়ে সব শক্তি বা অর্থবিত্ত খরচ করে ফেলা যাবেনা। মনে রাখতে হবে এদের জন্য আর্থিক ব্যাক আপ রাখতে হবে, তাই মা বাবাকে উপার্জন করতে হবে, শক্ত ও সুস্থও থাকতে হবে। সব চাকুরী ব্যবসা গুটিয়ে ফেলা, সামাজিক সম্পর্কে ছেদ টানা খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা।
অটিজম চ্যালেঞ্জড শিশুরা ধীর গতিতে হলেও শিখতে পারে। তাদের জন্য আদরে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একটা শান্ত সুন্দর পরিবেশ দিতে পারলে তাদের অস্থিরতা কম হয়, শিখেও তাড়াতাড়ি। প্রথম উদ্দেশ্য থাকবে তাদের শান্ত করা, ভাষা বা দেহভঙ্গির মাধ্যমে যোগাযোগ করতে শেখানো, তারপর ধীরে ধীরে নিজের প্রাত্যহিক কাজকর্মে অভ্যস্ত করা।
পরবর্তীতে শিশুর যত্নের জন্য কোন প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। কোন স্কুল বা ডে কেয়ার অথবা কোন শিক্ষক। খুঁজে বার করুন আপনার শিশু কিসে আগ্রহ বোধ করছে, কিসে অস্থির হচ্ছে, কিসে তার সমস্যা হচ্ছে। শেখান খুব ধৈর্যের সাথে ছোট ছোট বিষয়গুলো। কঠিন বটে, কিন্তু অসম্ভব নয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মা বাবার মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারটি। এই ক্লান্তিকর কাজটি করতে গিয়ে অনেকেই নিজেই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। সেই বিষয়ে খুব লক্ষ্য রাখতে হবে। এই বিষয়ে লিখবো আগামীতে। ভালো থাকুন।