23/03/2023
রমজান ও সিয়াম এবং এ সংক্রান্ত প্রচলিত বিদআতি কার্যক্রম (২য় পর্ব)
❑ রমজান মাসে কতিপয় বিদআত ও সুন্নত বিরোধী কার্যক্রম: (১০টি)
রমজান মাসে সমাজে একাধিক বিদআত প্রচলিত রয়েছে। যেগুলো এক জায়গায় এক রকম, অন্য জায়গায় আর এক রকম। এক দেশের লোকাচার অন্য দেশ থেকে ভিন্ন। নিম্নে আমরা আমাদের দেশে প্রচলিত এ সংক্রান্ত কিছু বিদআতি কাজের চিত্র তুলে ধরব।
◈ ১) রমজানের নতুন চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে বিদআত:
রমজানের নতুন চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছু লোক চাঁদের দিকে হাত উঁচু করে শাহাদাত অঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করে থাকে। এটা বিদআত। কেননা কুরআন-সুন্নায় এর কোন ভিত্তি নাই। তবে নতুন চাঁদ দেখলে নিম্নোক্ত দুআটি পাঠ করা সুন্নত:
اللَّهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالْيُمْنِ وَالإِيمَانِ وَالسَّلاَمَةِ وَالإِسْلاَمِ رَبِّى وَرَبُّكَ اللَّهُ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমানি ওয়াস সালামাতি ওয়াল ইসলাম। রাব্বী ওয়া রাব্বুকাল্লাহ”। [26]
অর্থ: হে আল্লাহ, এ চাঁদকে আমাদের মাঝে বরকত, ঈমান, শান্তি-নিরাপত্তা ও ইসলামের সাথে উদিত কর। আমার ও তোমার রব আল্লাহ।”
◈ ২) সেহেরি সংক্রান্ত বিদআত:
দেখা যায়, রমজান মাসে শেষ রাতে মুয়াজ্জিনগণ মাইকে উচ্চ আওয়াজে কুরআন তেলাওয়াত, গজল, ইসলামি সঙ্গীত ইত্যাদি গাওয়া শুরু করে। অথবা টেপ রেকর্ডার চালিয়ে বক্তাদের ওয়াজ, গজল বাজাতে থাকে। সেই সাথে অনবরত ডাকাডাকি চলতে থাকে: ভায়েরা আমার, বনেরা আমার, উঠুন, সেহরির সময় হয়েছে, রান্নাবান্না করুন, খাওয়া-দাওয়া করুন” ইত্যাদি। অথবা কোথাও বা কিছুক্ষণ পরপর উঁচু আওয়াজে হুইসেল বাজানো হয়।
এর থেকে আরও আজব কিছু আচরণ দেখা যায়। যেমন: এলাকার কিছু যুবক রমজানের শেষ রাতে মাইক নিয়ে এসে সম্মিলিত কণ্ঠে গজল বা কাওয়ালী গেয়ে মানুষের বাড়ির দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে চাঁদা আদায় করে। অথবা মাইক বাজিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকে। এ ছাড়াও এলাকা ভেদে বিভিন্ন বেদাতি কার্যক্রম দেখা যায়।
আমাদের জানা উচিত, শেষ রাতে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নিচের আসমানে নেমে আসেন। এটা দুআ কবুলের অন্যতম একটি সময়। আল্লাহ তাআলার নিকট এ সময় কেউ দুআ করলে তিনি তা কবুল করেন। মুমিন বান্দাগণ এ সময় তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন, কুরআন তেলাওয়াত করেন, মহান আল্লাহ তাআলা তাআলা দরবারে রোনাজারি করে থাকেন।
সুতরাং এ সময় মাইক বাজিয়ে, গজল গেয়ে বা চাঁদা তুলে এ মূল্যবান সময়ে ইবাদতে বিঘ্নিত করা নিঃসন্দেহে গুনাহর কাজ। এতে মানুষের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানো হয়। যার ফলে অনেকের সেহরি এমনকি ফজরের নামাজ পর্যন্ত ছুটে যায়। এই কারণে অনেক রোজাদারগণ সেহরির শেষ সময় পর্যন্ত বিলম্ব না করে আগে ভাগে সেহরি শেষ করে দেয়। এ সবগুলোই গুনাহের কাজ।
➧ তাহলে আমাদেরকে জানতে হবে ক্ষেত্রে সুন্নত কী?
এ ক্ষেত্রে সুন্নত হচ্ছে, ফজরের আগে সেহরির জন্য আলাদা একটি আজান দেওয়া। এই আজান হল সেহরি খাওয়ার জন্য এবং তারপর ফজর সালাতের জন্য আরেকটি আজান দেওয়া। এজন্য রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পক্ষ থেকে দু জন মুয়াজ্জিনও নিয়োগ করা ছিল। যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
« إِنَّ بِلاَلاً يُؤَذِّنُ بِلَيْلٍ ، فَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يُؤَذِّنَ ابْنُ أُمِّ مَكْتُومٍ »
“বেলাল রাতে আজান দেয়। অতএব তোমরা বেলালের আজান শুনলে পানাহার করতে থাক ইবনে উম্মে মাকতুমের আজান দেওয়া পর্যন্ত।” [27]
সুনানে নাসাঈর হাদিসে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِنَّ بِلَالًا يُؤَذِّنُ بِلَيْلٍ لِيُوقِظَ نَائِمَكُمْ وَلِيَرْجِعَ قَائِمَكُمْ وَلَيْسَ أَنْ يَقُولَ هَكَذَا يَعْنِي فِي الصُّبْحِ
“বেলাল আজান দেয় এজন্য যে, যেন ঘুমন্ত লোক জাগ্রত হয় আর তাহাজ্জুদ আদায়কারী ফিরে আসে অর্থাৎ নামাজ বাদ দেয় এবং সেহরি খায়।”
সুতরাং এ দুটির বেশি কিছু করতে যাওয়া বিদআত ছাড়া অন্য কিছু নয়। এজন্যই ওলামাগণ বলেছেন, “যেখানে একটি সুন্নত উঠে যায় সেখানে একটি বিদআত স্থান করে নেয়।” আমাদের অবস্থাও হয়েছে তাই। সুন্নত উঠে গিয়ে সেখানে নিজেদের মনগড়া পদ্ধতি স্থান দখল করে নিয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে পুনরায় সুন্নতের দিকে ফিরে আসার তাওফিক দান করুন। আমিন।
তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, যে এলাকায় দুটি আজান দেওয়ার প্রচলন নেই সেখানে রমজান মাসে হঠাৎ করে দুটি আজান দেওয়া ঠিক নয়। কেননা, এতে মানুষের মাঝে সেহরি খাওয়া ও ফজর সালাতের সময় নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে।
◈ ৩) সেহেরি খাওয়ার সময় মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা বিদআত:
সেহরি খাওয়া একটি ইবাদত। আর যে কোন ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য নিয়ত অপরিহার্য শর্ত। কারণ, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
« إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ »
সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।” (সহিহ বুখারি) তাই রোজা রাখার জন্য নিয়ত থাকা অপরিহার্য। তাই নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَنْ لَمْ يُبَيِّتْ الصِّيَامَ قَبْلَ الْفَجْرِ فَلَا صِيَامَ لَهُ
“যে রাতে (ফজরের আগে) রোজা রাখার নিয়ত করে নি তার রোজা হবে না।” (সুনান নাসাঈ, আল্লামা আলবানি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।) কিন্তু জানা দরকার, নিয়ত কী বা কীভাবে নিয়ত করতে হয়?
➧ নিয়ত কী বা কিভাবে নিয়ত করতে হয়?
ইমাম নববী রাহ. বলেন, মনের মধ্যে কোন কাজের ইচ্ছা করা বা সিদ্ধান্ত নেওয়াকেই নিয়ত বলা হয়। সুতরাং রোজা রাখার কথা মনে মধ্যে সক্রিয় থাকাই নিয়তের জন্য যথেষ্ট। মুখে উচ্চারণ করার প্রয়োজন নেই। কেননা, ইসলামি শরিয়তে কোন ইবাদতের নিয়ত মুখ দিয়ে উচ্চারণের কথা আদৌ প্রমাণিত নয়।
অথচ আশ্চর্য জনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ওজুর নিয়ত, নামাজের নিয়ত, সেহরি খাওয়ার নিয়ত ইত্যাদি চর্চা করা হয়। নামাজ শিক্ষা, রোজার মসায়েল শিক্ষা ইত্যাদি বইতে এ সব নিয়ত আরবিতে অথবা বাংলা অনুবাদ করে পড়ার জন্য জনগণকে শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, দ্বীনের মধ্যে এভাবে নতুন নতুন সংযোজনের পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে সতর্ক করে গেছেন। তিনি বলেন,
« مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ »
“যে আমাদের এই দ্বীনে এমন নতুন কিছু তৈরি করল যা তার অন্তর্ভুক্ত নয় তা পরিত্যাজ্য।” (বুখারি ও মুসলিম)
তাই মুসলমানদের কর্তব্য হল, দলীল-প্রমাণ ছাড়া গদ বাধা নিয়ত সহ সব ধরণের বিদআতি কার্যক্রম পরিত্যাগ করা এবং সুন্নতকে শক্তভাবে ধারণ করা। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
◈ ৪) বিলম্বে ইফতার করা:
কিছু রোজাদারকে দেখা যায়, স্পষ্টভাবে সূর্য ডুবে যাওয়ার পরও অতি সর্তকতার কারণে আরও কিছুক্ষণ পরে ইফতার করে। এটি স্পষ্ট সুন্নত বিরোধিতা। কারণ, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
« لاَ يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ »
“মানুষ ততদিন কল্যাণে উপর থাকবে যতদিন তাড়াতাড়ি ইফতার করবে।” (বুখারি ও মুসলিম)
◈ ৫) তারাবিহ নামাজ সংক্রান্ত বিদআত:
অনেক মসজিদে দেখা যায়, তারাবিহর নামাজের প্রতি চার রাকাত শেষে মুসল্লিগণ উঁচু আওয়াজে ‘সুবাহানা জিল মুলকে ওয়াল মালাকূতে…” দুআটি পাঠ করে থাকে। এভাবে নিয়ম করে এই দুয়া পাঠ করা বিদআত। অনুরূপভাবে এ সময় অন্য কোন দুআ এক সাথে উঁচু আওয়াজে পাঠ করাও বিদআত। কারণ, এ ব্যাপারে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোন সহিহ হাদিস নেই। বরং নামাজ শেষে যে সকল দুআ সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো পাঠ করা সুন্নত। যেমন: তিনবার আস্তাগফিরুল্লাহ”, একবার আল্লাহুম্মা আন্তাস সালাম ওয়ামিন্কাস সালাম, তাবারাক্তা ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকারাম” ইত্যাদি। এ দুয়াগুলো প্রত্যেকেই চুপি স্বরে নিজে নিজে পাঠ করার চেষ্টা করবে। (অবশ্য অনেক আলেমের মতে এ দুআগুলো কেবল ফরজ সালাতের সালামান্তে পঠনীয়। কিন্তু আল্লামা বিন বাজ রাহ. সহ কিছু আলেম, এই দুআগুলো যে কোনও সালাতের পরে পাঠ করার কথা বলেছেন। আল্লাহ ভালো জানেন)
◈ ৬) তারাবির নামাজে খুব তাড়াতাড়ি কুরআন তেলাওয়াত করা বা তাড়াহুড়া করে নামাজ পড়া:
অনেক মসজিদে রমজানে তারাবির নামাজে খুব তাড়াতাড়ি কুরআন তেলাওয়াত করা বা তাড়াহুড়া করে নামাজ শেষ করা। যার কারণে তেলাওয়াত ঠিক মত বুঝাও যায় না। নামাজে ঠিকমত দুআ-জিকির পাঠ করা যায় না। এটা নি:সন্দেহে সুন্নত পরিপন্থী। কেননা, আল্লাহর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রাতের কিয়ামুল লাইল হত অনেক দীর্ঘ এবং ধীর স্থির।
৭) বদর দিবস পালন করা বিদআত:
২য় হিজরির রমজানের সতের তারিখে বদরের প্রান্তরে মক্কার মুশরিক সম্প্রদায় এবং রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার জানবাজ সাহসী সাহাবায়ে কেরামের মাঝে এক যুগান্তকারী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধ ছিল অস্ত্র-সম্ভার এবং জনবলে এক অসম যুদ্ধ। মুসলমানগণ অতি নগণ্য সংখ্যক জনবল আর খুব সামান্য অস্ত্র-শস্ত্র সহকারে কাফেরদের বিশাল অস্ত্র সজ্জিত বাহিনীর প্রতিরোধ করেছিলেন এবং আল্লাহ তাআলা সে দিন অলৌকিকভাবে মুসলমানদেরকে বিজয় দান করেছিলেন। এ যুদ্ধের মাধ্যমে সত্য মিথ্যার মাঝে চূড়ান্ত পার্থক্য সূচিত হয়েছিল।
এতো ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু প্রতি বছর রমজানের সতের তারিখে এ ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করার জন্য লোকজন একত্রিত হয়ে কুরআন তেলাওয়াত দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। তারপর বদরের বিভিন্ন ঘটনা, সাহবিদের সাহসিকতা ইত্যাদি আলোচনা কর হয়। এভাবে প্রতি বছর এই দিনে ‘বদর দিবস’ পালন করা হয়। এটি যদিও আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে এটির প্রচলন তেমন নেই। কিন্তু দু:খ জনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের কিছু ইসলামি সংগঠন প্রতি বছর বেশ জোরে শোরে সাংগঠনিক কার্যক্রম হিসেবে এই বিদআত পালন করে থাকে। অথচ উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার সর্বোত্তম আদর্শ সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন এবং সালাফে সালেহীন থেকে এ জাতীয় অনুষ্ঠান পালনের কোন ভিত্তি নাই। বদরের এ ঘটনা নি:সন্দেহে মুসলমানদের প্রেরণার উৎস। এ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এভাবে দিবস পালন করা শরিয়ত সম্মত নয়।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নবুওয়ত জীবনে রয়েছে অনেক বক্তৃতা, সন্ধি-চুক্তি এবং বিভিন্ন বড় বড় ঘটনা-যেমন: বদর, হুনাইন, খন্দক, মক্কা বিজয়, হিজরত মুহূর্ত, মদিনায় প্রবেশ, বিভিন্ন বক্তৃতা যেখানে তিনি দ্বীনের মূল ভিত্তিগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও তিনি তো এ দিনগুলোকে আনন্দ-উৎসব হিসেবে পালন করা আবশ্যক করেন নি। বরং এ জাতীয় কাজ করে খৃষ্টানরা। তারা ঈসা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালামের জীবনের বিভিন্ন ঘটনাকে উৎসব হিসেবে পালন করে থাকে। অনুরূপভাবে ইহুদীরাও এমনটি করে। ঈদ-উৎসব হল শরিয়তের একটি বিধান। আল্লাহ তাআলা শরিয়ত হিসেবে যা দিয়েছেন তা অনুসরণ করতে হবে। অন্যথায় এমন নতুন কিছু আবিষ্কার করা যাবে না যা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয়।” [28]
মূলত: এ জাতীয় কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত থাকা মানুষকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের শরিয়ত থেকে দূরে রাখার একটি অন্যতম মাধ্যম। সুতরাং শরিয়ত যে কাজ করতে আদেশ করে নি তা হতে দূরে অবস্থান করে রমজান মাসে অধিক হারে কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামাজ আদায় করা, জিকির-আজকার এবং অন্যান্য এবাদত-বন্দেগি বেশি বেশি করা দরকার। কিন্তু মুসলমানদের অন্যতম সমস্যা হল শরিয়ত অনুমোদিত ইবাদত বাদ দিয়ে নব আবিষ্কৃত বিদআতি আমল নিয়ে ব্যস্ত থাকা। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমিন।
◈ ৮) ইতিকাফ সংক্রান্ত ভুল ধারণা:
আমাদের দেশে মনে করা হয় যে, সমাজের পক্ষ থেকে এক ব্যক্তিকে অবশ্যই ইতিকাফে বসতে হবে তা না হলে সবাই গুনাহগার হবে। কিন্তু এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। কারণ, ইতিকাফ হল একটি সুন্নত ইবাদত। যে কোন মুসলমানই তা পালন করতে পারে। যে ব্যক্তি তা পালন করবে সে অগণিত সোওয়াবের অধিকারী হবে। সবার পক্ষ থেকে একজনকে ইতিকাফে বসতেই হবে এমন কোন কথা শরিয়তে নেই।
◈ ৯) জুমাতুল বিদা পালনের বিদআত:
জুমাতুল বিদা কী? জুমাতুল বিদা পালন করার গুরুত্ব কতটুকু?
জুমাতুল বিদা বলতে বুঝায়, রমজানের শেষ জুমা সালাতের মাধ্যমে রমজানকে বিদায় জানানো। আমাদের দেশে দেখা যায়, রমজানের শেষ শুক্রবারকে খুব গুরুত্বের সাথে ‘জুমাতুল বিদা’ হিসেবে পালন করা হয়। এ উপলক্ষে জুমার নামাজে পরিলক্ষিত হয় প্রচুর ভিড়। অনেক মানুষ এ দিনে বিশেষভাবে দুআ করে, কেউ কেউ মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে, কেউ কেউ এ দিন উপলক্ষে বিশেষ কিছু নামাজ পড়ে, ইফতার পার্টি করে..ইত্যাদি। পরের দিন পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে নিউজ আসে “যথাযোগ্য মর্যাদা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মাধ্যমে সারা দেশে ‘জুমাতুল বিদা’ পালিত হয়েছে”!! অথচ রমজানের শেষ জুমার দিনে এমন কিছু বিশেষ আমল করতে হবে কুরআন-সুন্নায় এ ব্যাপারে কোন ধারণা পাওয়া যায় না।
আমাদের কর্তব্য, প্রত্যেক জুমার দিনকে গুরুত্ব দেওয়া। সকল জুমার দিন ফজিলত পূর্ণ। রমজানের প্রতিটি দিন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রমজানের শেষ জুমার বিশেষ কোন ফযিলত আছে বলে কুরআন-সন্নায় কোন প্রমাণ নাই। সুতরাং এ দিনটিকে বিশেষ ফজিলত পূর্ণ মনে করে ‘জুমাতুল বিদা’ পালন করা বিদআত।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সকল প্রকার বিদআত থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
◈ ১০) ফিতরা প্রদানের ক্ষেত্রে সুন্নতের বরখেলাপ:
খাদ্য দ্রব্য না দিয়ে টাকা দিয়ে অথবা কাপড় কিনে ফিতরা দেওয়া সুন্নতের বরখেলাপ। কারণ, হাদিসে ফিতরা হিসেবে খাদ্য দ্রব্য প্রদান করার কথাই বর্ণিত হয়েছে । যেমন: ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
فَرَضَ رَسُولَ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – زَكَاةَ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ ، أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ ، عَلَى كُلِّ حُرٍّ أَوْ عَبْدٍ ، ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى ، مِنَ الْمُسْلِمِينَ
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের প্রত্যেক স্বাধীন, দাস, পুরুষ অথবা নারী সকলের উপর এক সা (প্রায় আড়াই বা তিন কেজি) পরিমাণ খেজুর অথবা জব জাকাতুল ফিতর হিসেবে আবশ্যক করেছেন।” (বুখারি ও মুসলিম) এখানে খাদ্য দ্রব্যের কথা সুস্পষ্ট।
তা ছাড়া নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগেও দিনার-দিরহামের প্রচলন ছিল কিন্তু তিনি অথবা তার কোন সাহাবি দিনার-দিরহাম দ্বারা ফিতরা আদায় করেছেন বলে কোন প্রমাণ নাই। তাই সুন্নত হল, আমাদের দেশের প্রধান খাদ্য দ্রব্য (যেমন: চাল) দ্বারা ফিতরা আদায় করা।
আরেকটি বিষয় হল: হাদিসে বর্ণিত এক সা’র পরিবর্তে আধা সা ফিতরা দেওয়াও সুন্নতের বরখেলাপ। যেমনটি উপরোক্ত হাদিসে স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হচ্ছে। যদিও আমাদের সমাজে আধা সা ফিতরা দেওয়ার মাসআলাই দেওয়া হয়।
আল্লাহ তাআলা সকল ক্ষেত্রে তার নবির সুন্নতকে যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন এবং সকল বিদআত ও সুন্নত বিরোধী কার্যকলাপ থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
তথ্যসূচী:
-------------------------
[1] বুখারি ও মুসলিম।
[2] বুখারি ও মুসলিম।
[3] বুখারি, সওম অধ্যায় এবং মুসলিম, ঈমান অধ্যায়।
[4] সহিহ বুখারি, কিতাবুস সাওম। সহিহ মুসলিম, কিতাবুস সিয়াম।
[5] বুখারি ও মুসলিম।
[6] সহিহ মুসলিম। পবিত্রতা অধ্যায়।
[7] তিরমিজি, রোজা অধ্যায়। মুসতাদরাক হাকেম। আল্লামা আলবানি রাহ. হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন। দেখুন: সহিহ তারগীব ওয়াত্ তারহীব। হাদিস নম্বর: ৯৯৮।
[8] সহিহ বুখারি, অধ্যায়: রোজা। সহিহ মুসলিম অধ্যায়: রোজা।
[9] সহিহ বুখারির ব্যাখ্যা গ্রন্থ ফাত্হুল বারী। অধ্যায়: দু মাস এক সাথে কম হবে না। ১৭৭৯ নং হাদিসের ব্যাখ্যা।
[10] বুখারি ও মুসলিম।
[11] সহিহ বুখারি, অধ্যায়: জাকাত। সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান।
[12] মুসনাদ আহমদ, ৫/২৩১, সুনান তিরমিজি, ঈমান অধ্যায়। ইমাম তিরমিজি বলেন, “হাদিসটি হাসান-সহিহ। সুনান ইবনে মাজাহ্, অধ্যায়: ফিতনা-ফ্যাসাদ।
[13] বুখারি, অধ্যায়: তাহাজ্জুদ। মুসলিম, অধ্যায়: মুসাফিরদের নামাজ।
[14] বুখারি,অধ্যায়: তারাবিহর নামাজ। মুসলিম, অধ্যায়: মুসাফিরদের নামাজ।
[15] সহিহ বুখারি, অধ্যায়: তারাবিহর নামাজ। অনুচ্ছেদ: রমজান মাসে রাতের নামাজ পড়ার ফজিলত।
[16] সহিহ বুখারি, অধ্যায়: ইতিকাফ এবং সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: ইতিকাফ।
[17] সহিহ বুখারি, অধ্যায়: শবে কদরের ফজিলত। সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: ইতিকাফ।
[18] সহিহ বুখারি
[19] মুসনাদ আহমদ,৫/ সুনান আবুদাউদ, অধ্যায়: রোজা, তিরমিজি, অধ্যায়: রোজা অনুচ্ছেদ। আল্লামা আলবানি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।
[20] সহিহ বুখারি, অধ্যায়: লাইলাতুল কদরের ফজিলত। সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: রোজা।
[21] সহিহ বুখারি, অধ্যায়: লাইলাতুল কদর-এর ফজিলত।
[22] বুখারি, অধ্যায়: লাইলাতুল কদর-এর ফজিলত। মুসলিম, অধ্যায়: রোজা।
[23] সহিহ বুখারি, অধ্যায়: রোজা অধ্যায়। সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: রোজা। তবে সহিহ মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে, সাহাবিগণ সকল ক্ষেত্রে সর্ব শেষ বিধানের রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ করতেন।
[24] সহিহ বুখারি, অধ্যায়: রোজা, সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: রোজা।
[25] সহিহ বুখারি, অধ্যায়: সাওম। সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম। তবে সহিহ মুসলিমের ভাষ্য হল: “আমরা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে রমজান মাসে সফরে যেতাম…”।
[26] মুসনাদ আহমদ, তালহা বিন ওবায়দুল্লাহ থেকে বর্ণিত (৩/৪২০), তিরমিজি, অনুচ্ছেদ: চাঁদ দেখার সময় কী বলবে? আল্লামা আলবানি রাহ. বলেন, হাদিসটি সহিহ।
[27] বুখারি, অনুচ্ছেদ: ফজরের আগে আজান দেওয়া। মুসলিম: অনুচ্ছেদ: ফজর উদিত হলে রোজা শুর হবে...।
[28] ইকতিযাউয সিরাতিল মুস্তাকীম [২/৬১৪ ও ৬১৫]
আরও পড়ুন:
রমজান ও সিয়াম এবং এ সংক্রান্ত প্রচলিত বিদআতি কার্যক্রম (১ম পর্ব)
m.facebook.com/photo/?fbid=671186011679034&set=a.465198945611076
লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব