
04/02/2023
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতের অমিল, ঝগড়া, রাগ করে কথা না বলা, আলাদা রুমে ঘুমানো ইত্যাদি বিষয়গুলি খুবই প্রাচীন চর্চার মধ্যে পড়লেও ইদানিং এগুলো আরো প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। এ‘ধরনের মৃদু মাত্রার দ্বন্দ খুব বেশী সিরিয়াস হলে সেগুলি হাতাহাতি, মারামারি, বিষন্নতা, ডিভোর্স, মামলা ইত্যাদি পর্যায় পর্যন্ত গড়াচ্ছে। বাবা-মায়ের এহেন অবস্থার কারণে এসবের বিরূপ প্রভাব পড়ছে সন্তানদের উপরেও। অতিমাত্রায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার বা আসক্তি, সহনশীল ক্ষমতার অভাব, বৈবাহিক সম্পর্কের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব, পরকীয়ার সম্পর্ক, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের পরোক্ষ মতামত ও অবস্থানের প্রভাব, আত্ন-অহংকার, প্রতিদ্বন্দিতামূলক মানসিকতা, আত্ননির্ভরশীলতা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিটাই কেন জানি অনেকটা ঠুনকো হতে চলেছে। সুতরাং, উপরোক্ত কারণগুলোর জন্য যারা আলাদা থাকা বা বিচ্ছেদমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেন বা নিতে চাচ্ছেন, তাদের জন্য তথ্য হচ্ছে, গবেষণা মতে, দ্বিতীয় বিয়েতে সুখী হওয়া বা সুথে থাকার সুযোগ খুবই কম। যদিও এর কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। কিন্তু, বিচ্ছেদ হওয়া বেশীর ভাগ দম্পতিরা-ই পরে আফসোস ভরে উপলব্ধি করেছেন যে, প্রথম সংসারটিতে মানিয়ে নিলেই ভালো হতো। আর, সবচেয়ে বেশী ভোগান্তিতে পড়ে বাচ্চাগুলো। তাদের মানসিক সমস্যা, অনিরাপত্তাবোধ, বুলিং, বিষন্নতা, আত্নহত্যার চিন্তা ও আত্নহত্যার ঘটনা খুবই সচরাচর। এমনকি, প্রথম ঘরের কিশোরী মেয়ের তার দ্বিতীয় বাবা দ্বারা (মায়ের দ্বিতীয় স্বামী) বিভিন্নভাবে শারিরীক, মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি ব্লাকমেইল করার মাধ্যমে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করার ঘটনাও আছে আমাদের দেশেই। সুতরাং, পরে আফসোস করার চেয়ে শুরুতেই মানিয়ে নিতে পারা উত্তম।
প্রেক্ষাপট এমন হয়েছে যে, বিবাহ করার পূর্বে এখন বিবাহ-পূর্ব কাউন্সেলিং (Pre-Marital Counseling) জরূরী হয়ে পড়েছে। কারণ, বিবাহের পরে মানসিক, আবেগীয়, পারিবারিক, জৈবিক ও সামাজিক বিষয়গুলোতে একজন মানুষের আচরণগত ভুমিকাগুলোকে স্বাস্থ্য সম্মত পন্থায় প্রয়োগ ও চর্চা করতে পারা জরূরী। জেনে রাখা প্রয়োজন যে, বিবাহ শুধুমাত্র দুইজন মানুষের একসাথে বসবাস-ই নয়, এর সাথে আরো অনেক আনুষাঙ্গিক বিষয় রয়েছে। যেমন,
মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানী-এই তিন ধারার সম্মিলিত অনুসিদ্ধান্ত ও ব্যাখ্যা অনুযায়ী বিয়ের প্রথাটি নিম্নলিখিত কয়েকটি ক্ষেত্রকে একত্রিত করে। যেমন:
১. সামাজিক
২. রাষ্ট্রীয়/আইনগত
৩. ধর্মীয়
৪. শ্বশুর-বাড়ীর আত্নীয়দের সাথে সম্পর্ক (In-laws relationship)
অর্থাৎ, সামাজিক প্রেক্ষাপট মতে, দু‘জন বিপরীত লিঙ্গের মানুষ সারা জীবনের জন্য একসাথে বসবাস করবে এবং তাদের মধ্যকার শারিরীক, মানসিক, বৈষয়িক ও আবেগিক বিষয়গুলোকে শেয়ার করবে।
রাষ্ট্রীয়/আইনগত প্রেক্ষাপট মতে, তারা রাষ্ট্রের কিছু নিয়মকানুন মেনে চলার মাধ্যমে এই সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট থাকবে এবং তাদের একটি লিখিত অঙ্গীকার নামা (নিকাহনামা বা কাবিননামা) থাকবে। তারা কখনো আলাদা হতে চাইলে রাষ্ট্র-স্বীকৃত সেই নিয়ম অনুযায়ী-ই (তালাক) আলাদা হবার অধিকার রাখবে।
ধর্মীয় যুক্তি মতে, তারা তাদের স্ব-স্ব ধর্মের বিধান অনুযায়ী একে অপরকে গ্রহন করবে ও প্রয়োজনে ধর্মীয় নিয়মেই প্রত্যাখ্যান করবে।
প্রত্যেকেই তাদের In-laws relationship কে মূল্যায়নের মাধ্যমে, সম্মান প্রদর্শন ও চর্চার মাধ্যমে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলবে। In-laws relationship বলতে শুধুমাত্র শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর সাথের সম্পর্কককেই বোঝায় না, শ্বশুর বাড়ীর অন্যান্য আত্নীয়-স্বজনের সাথেও সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলবে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে বিষয়গুলোর ধারণা এমনই। ইতিবাচক মানসিকতা ও প্রকৃত অর্থে সংসার করতে চাওয়ার আকাংখা থাকলেই এবং কেবল উপরোক্ত বিষয়গুলি মনে ও বিশ্বাসে ধারণ করে চর্চা করলেই সুখী দাম্পত্য জীবন গঠন করা সম্ভব।
মোহাম্মদ মিজানুর রহমান খান
চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী