02/04/2023
হোমিওপ্যাথিতে কি আছে অমরত্বের সন্ধান?
১ লা এপ্রিল, বস্টন-নিউ ইয়র্ক, নির্মাল্য দাশগুপ্তঃ মানুষ যুগে যুগে খুঁজে চলেছে অমরত্বের সন্ধান, ব্যর্থও হয়েছে বারবার। কিন্তু হঠাত এক আলোর ঝলকানি দেখা গেছে সম্প্রতি। গতকাল বিশ্ববিখ্যাত জার্ণাল নেচার অল্টারনেটিভ মেডিসিনে প্রকাশিত হয়েছে একটি গবেষণা, যা ইঙ্গিত দিচ্ছে অমরত্ব হয়তো আর দূরে নয়। হার্ভার্ড অল্টারনেটিভ মেডিক্যাল স্কুল থেকে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, হোমিওপ্যাথি ওষুধ প্রয়োগ করে, বিভিন্ন জীবের আয়ু দ্বিগুণ থেকে দশগুণ পর্যন্ত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এককোষী ইস্ট, সি এলিগেন্স (এক ধরণের কেঁচো), ড্রসোফিলা (এক ধরণের মাছি) ও ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করে সবার ক্ষেত্রেই এরকম ফল দেখতে পাওয়া গেছে। তবে জীবদেহের জটিলতার সাথে আয়ুবৃদ্ধি ব্যাস্তানুপাতে কমেছে। যেমন, সি এলিগেন্সর আয়ু হোমিওপ্যাথিক ওষুধে ১৮ দিন থেকে বেড়ে প্রায় ছয়মাস হয়ে গেছে; ড্রসোফিলার আয়ু তিন মাস থেকে দেড় বছর মত হয়ে গেছে। কিন্তু ইঁদুরের ক্ষেত্রে এতদিন বাড়েনি। বন্দি অবস্থায় সুষম পুষ্টি পেলে ইঁদুর সাধারণত তিন বছর বাঁচে, কিন্তু ছয়মাস বয়স থেকে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ প্রয়োগে ইঁদুরের আয়ু প্রায় আট থেকে দশ বছর হয়ে গেছে। ইঁদুরের ক্ষেত্রে তিনগুণ আয়ুবৃদ্ধি দেখে, বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, মানুষ বা অন্যান্য বৃহৎ বানরগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে আয়ু হয়তো দ্বিগুণ বা খুব বেশি হলে তিনগুণ হতে পারে। তার বেশি হয়তো হবেনা।
এই গবেষণাটি আরেকটি দারুণ জিনিস দেখতে পেয়েছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যান্সারের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু পরীক্ষাধীন ইঁদুরগুলির মধ্যে সেরকম লক্ষণ দেখা যায়নি। এবং ইঁদুরগুলো সাত আট বছর পর্যন্ত প্রজননক্ষম ছিল। বার্ধ্যকের সাথে দেহে কোষের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়, একে সেনেসেন্স দশা বলে। এই সেনেসেন্ট কোষ কেমোকাইন, সাইটোকাইন নামক অনেক ক্ষতিকর রাসায়নিক নির্গত করে। যা বার্ধ্যকের বিভিন্ন রোগের যেমন, আলঝাইমার্স, পার্কিনসন্স, গ্লুকোমা, ফ্রাইব্রোসিস, ক্যান্সার ইত্যাদির অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়, দীর্ঘদিন ধরে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ প্রয়োগে ইঁদুরগুলোর মধ্যে সেনেসেন্ট কোষ প্রায় দেখাই যায়নি। এবং ফলস্বরূপ, ক্ষতিকর রাসায়নিক নির্গমন দেখা যায়নি।
বার্ধ্যকের সঙ্গে প্রাণীর ডিএনএ-র ও ডিএনএ-র সংযুক্ত হিস্টোন প্রোটিনের বিভিন্ন রাসায়নিক অবস্থা পরিবর্তন ঘটে। বার্ধ্যকের সাথে ডিএনএ-র বিভিন্ন অঞ্চলে সাইটোসিন ক্ষারকে মিথাইল গ্রুপ যুক্ত হয়। একে বলে মিথাইলেশান ঘড়ি। প্রাণীদেহের ইঁদুরের জিনোম পর্য্যায়ের গবেষণায় দেখা গেছে, হোমিওপ্যাথিক ওষুধ ইঁদুরের ডিএনএ-র ও ডিএনএ-র সংযুক্ত হিস্টোন প্রোটিনের বিভিন্ন রাসায়নিক অবস্থা পরিবর্তন করতে সক্ষম এবং তা দীর্ঘদিন ধরে যৌবনের অবস্থা ধরে রাখে। হোমিওপ্যাথি মিথাইলেশান ঘড়িও মন্থর করে দেয়, ফলে বয়স বাড়ে ধীর গতিতে।
হার্ভার্ড অল্টারনেটিভ মেডিক্যাল স্কুলের অধিকর্তা বিশিষ্ট বিজ্ঞানী চাল আল্টুডোমান এই সাম্প্রতিক আবিষ্কারের জন্য সহকর্মী বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। তবে তিনি এও বলেন, হোমিওপ্যাথি কি ভাবে এই কাজগুলো করেছে, সেটা এখনো দেখা বাকি। উনি মনে করছেন, হোমিওপ্যাথিক ওষুধগুলো কোনভাবে স্টেমসেলের ইয়ামানাকা ফ্যাক্টারকে উদ্দীপ্ত করে বৃদ্ধ কোষগুলোকে পুনর্জীবন দান করছে। তবে উনি বলার সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলেন, এটা ওঁর অনুমান মাত্র। উচ্ছ্বসিত হলেও উনি কিছুটা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন মানুষের ক্ষেত্রে এই গবেষণা কতটা সফল হবে তা নিয়ে। কারণ ইঁদুর সহ সব প্রাণীগুলোরই পরীক্ষাগারে রক্ষণাবেক্ষণ হয়েছে, তাদের পুষ্টি, বিশ্রাম সব নিয়ন্ত্রিত ছিল, প্রাণীগুলির জেনেটিক্সও একই ছিল প্রায়, তাই ওষুধ নির্ধারণ, তার মাত্রা নির্ধারণ অনেক সহজ ছিল। কিন্তু মানবদেহে এরকম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। মানবদেহে বিভিন্ন হোমিওপ্যাথিক ওষুধ বিভিন্ন ভাবে কাজ করে। উপসর্গ দেখে ওষুধ আর মাত্রা নির্ধারণ খুবই কঠিন। তাই সঠিক চিকিৎসক, সঠিক রোগী, সঠিক রোগ, সঠিক ওষুধ আর সঠিক মাত্রা এতগুলি বিষয় মাথায় রেখে মানুষের ওপর কাজ করতে হবে। তবে ওঁর আশা, মানবদেহে যদি সঠিক মাত্রায়, সঠিক হোমিওপ্যাথিক ওষুধ প্রয়োগ করা যায়, তবে “মানুষও হয়তো অমর হয়ে যাবে”। বলেই হাসতে হাসতে বলেন, ওটা কথার কথা। অমরত্ব কখনোই সম্ভব নয়, তবে হোমিওপ্যাথির দ্বারা দুশো আড়াইশো বছর হয়তো সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে। মানুষে এই পরীক্ষা সফল হলে এই কাজের জন্য তিন চারটে নোবেল প্রাইজ আসবে বলে, ওঁর প্রত্যাশা।
কিংবদন্তী হোমিওপ্যাথ জর্জ ভিটলকাস এই খবরে তাঁর উচ্ছ্বাস চেপে রাখেননি। তবে উনি মনে করেন, ইয়ামানাকা ফ্যাক্টারের থেকেও হোমিওপ্যাথির মাধ্যমে ইলেকট্রনের স্পিন আন্টিস্পিন বদলে আণবিক বিশৃঙ্খলা বা মলিকুলার কেওস রোধই এর কারণ। উনি সম্প্রতি ভারত থেকে প্রকাশিত হোমিওপ্যাথির ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক পাওয়ারের গবেষণার কথাও উল্লেখ করেন। তবে উনিও মানবেদেহে এর সাফল্য নিয়ে কিছুটা সতর্ক ও সন্ধিহান।
তবে এই খবরে অ্যামেরিকার বার্ধ্যক্য গবেষণার অর্থমঞ্জুরি প্রতিষ্ঠান এন আই এ বা ন্যাশেনাল ইন্সটিটিউট অফ এজিং নড়েচড়ে বসেছে এবং দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেছে বলে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে। অনেক সদস্যই আড়ালে প্রশ্ন তুলছেন, সস্তায় যেখানে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া হোমিওপ্যাথি এরকম কাজ করছে, তাহলে জনসাধারণের অর্থ ধ্বংস করে বার্ধ্যকের প্রচণ্ড খরচ সাপেক্ষ ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াযুক্ত অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের পেছনে এত বিলিয়ান বিলিয়ান ডলার প্রতি বছর ঢালার সার্থকতা কোথায়? এলোপ্যাথিক বিজ্ঞানীদের এই গবেষণায় যথেষ্ট শতর্ক দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন বিজ্ঞানীর সাথে ইমেইল বা ফোন মারফত যোগাযোগ করা হলে, প্রত্যেকেই বলছেন, পেপারটা পড়া হয়নি। পড়ে মতামত দেবেন। অনেকে এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, বলেছেন, এই তথ্যে কারচুপি আছে। এটা অসম্ভব। হোমিওপ্যাথিতে জল আর অ্যালকোহল ছাড়া কিছু থাকেনা। জল আর অ্যালকোহলে দীর্ঘ জীবন পেলে মাতালরা অমর হয়ে যেত।নিশ্চয়ই ওরা স্টেরয়েড মিশিয়েছে।
হোমিওপ্যাথিক বৈজ্ঞানিক দলের প্রধান ডঃ সাইডোউইসেনশাফটকে সাংবাদিক সম্মেলনে একথা বললে, উনি মুচকি হেসে বলেন, স্টেরয়েড যদি সর্বরোগহর বলে ওঁরা মনে করেন, ওঁরা নিজেরা কেন তবে স্টেরয়েড দিয়ে একই চেষ্টা করছেননা। উনি এরপর দৃঢ় স্বরে বলেন, মানবদেহে হোমিওপ্যাথি দীর্ঘায়ু দেবে কিনা তা এখনো অজানা হলেও, একটা জিনিস পরিষ্কার যে এই গবেষণা অনেক সংঘাত বাড়াবে এবং গবেষণা বহু ভাবে রোখার চেষ্টা হবে। গবেষণার সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীদের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হতে পারে। তারপর ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে বলেন, অসাধু অ্যালোপ্যাথিক ফার্মা লবির সাথে সংঘাত অনিবার্য্য এক্ষেত্রে। তবে ফার্মা লবির চাপ ওঁদের দমাতে পারবেনা, কারণ সারা বিশ্বের প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্ক, শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ ওঁদের পাশে আছেন, ওঁর বিশ্বাস। দরকার হলে জনতার কাছ থেকে ভিক্ষে করেও (ক্রাউড ফান্ডিং)করে হলেও এই গবেষণা চালিয়ে যাবেন।