12/07/2025
বিষয়: ধর্মীয় ওসিডি (Religious OCD) / স্ক্রুপুলোসিটি:
ধর্মীয় ওসিডি মানে এমন একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যেখানে একজন ব্যক্তি:
•অতিরিক্ত ভয় পান যে তিনি আল্লাহ, ভগমান, গড, ঈশ্বরকে অপমান করেছেন বা পাপ করেছেন
•ধার্মিক আচরণ যেমন নামাজ, দোয়া, রোজা, কোরআন, পূজা , বাইবেল, গীতা, ত্রিপাঠক পাঠ — সেগুলোতে “ভুল হয়েছে” এমন অনুভূতিতে ভোগেন
•বারবার ধর্মীয় আচার পালন করেন, যাতে নিজের সন্দেহ দূর হয়। এর ফলে রোগীর মধ্যে একধনের ভয় কাজ করে ।
আরেকটি বিষয় ধর্মীয় OCD কিন্তু যার যার ধর্ম অনুযায়ী আলাদা আলাদা হবে । অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের হলে ইসলামের বিষয় যেমন আল্লাহ, কোরআন, নামাজ, ওজু, ইত্যাদি নিয়ে হবে । ঠিক তেমনি হিন্দু ধর্মের হলে হিন্দু ধর্মের বিষয়, খ্রিস্টান ধর্মের হলে সেটার বিষয় নিয়ে হবে, বৌদ্ধ ধর্মের হলে সেটার বিষয় নিয়ে হবে ।
প্রধান লক্ষণ: গুলো মুলত দুইটি ভাবে ভাগ করা হয়:
১. অবসেশন (Obsessions): এই চিন্তাগুলো আকস্মিকভাবে আসে এবং ব্যক্তি সেগুলো না চাইলেও বারবার মাথায় আসে:
• “আমি কি আল্লাহকে অপমান করেছি?”
• “আমার মনে খারাপ চিন্তা এসেছে, আমি কি পাপ করছি?”
• “নামাজে ভুল হয়ে গেলে কি সব বরবাদ হয়ে গেল?”
• “আমি ঠিকভাবে রোযা রাখলাম তো?”
২. কম্পালশন (Compulsions): মানসিক চাপ কমাতে বারবার করা হয় এইসব কাজ:
• এক নামাজ বারবার পড়া
• কোরআন বা হাদিস বারবার পড়ে “সঠিক” বুঝে নেওয়া
• অন্যদের (মাওলানা, পীর, বাবা-মা) কাছে বারবার জিজ্ঞেস করা “আমি ঠিক আছি তো?”
• মসজিদ বা ধর্মীয় জায়গাগুলোতে অযথা বারবার যাওয়া
• ধর্মীয় কাজ নিয়ে অতিরিক্ত গিল্টি ফিলিং, এমনকি নিখুঁতভাবে করলেও
এইখানে ধর্মীয় অংশটা মুখ্য নয় — মুখ্য হলো:
• চিন্তাকে “বিপজ্জনক” মনে করা
• ভুল না করার চাপ
• নিজেকে সবসময় বিশুদ্ধ প্রমাণ করার প্রবণতা
এগুলোর যেকোনো বিষয় (ধর্ম, স্বাস্থ্য, সম্পর্ক, নৈতিকতা) কেন্দ্র করে OCD তৈরি হতে পারে।
নিচে কিছু উদাহরণ দেওয়া হল:
ইসলাম ধর্মের উদাহরণ:
ফারহানা ওজু করার সময় মনে করে, “একটু জায়গা হয়তো শুকনো রয়ে গেছে!” — সে বারবার ঘষে পানি দেয়, এক সময় আঙুলে ক্ষত তৈরি হয়।
জুবায়ের নামাজে দাঁড়ালেই মনে হয় সে “মন থেকে ঠিক মনোযোগ দিতে পারছে না।” তাই সে প্রতি নামাজ ৪–৫ বার করে পড়ে।
নাঈমা রাতে ঘুমাতে পারছেন না, কারণ মনে হয় “আমার মনে খারাপ চিন্তা এসেছে, আল্লাহ্ হয়তো আমাকে মাফ করবেন না।” সে কাঁদতে কাঁদতে সারা রাত তাওবা করে।
শামীম, ২০ বছরের ছাত্র, প্রতিবার অজু করতে গিয়ে ভাবে, “নাক ঠিকমতো ধুলাম তো?”, “চোখে পানি গেছে তো?”, তাই অজু করতে তার ১৫-২০ মিনিট লেগে যায়।
➡️ এই বেশি সময় অজু করার পেছনে ইচ্ছা নয়, বরং ভয়: “নামাজ অশুদ্ধ হয়ে যাবে, আল্লাহ রুষ্ট হবেন।”
মাহমুদা আপা, নামাজে দাঁড়ালেই তার মনে হয় — “আমি হয়তো আল্লাহকে অসম্মান করলাম, ভুল পড়লাম, বা খারাপ চিন্তা চলে এলো।”
➡️ সেই কারণে তিনি প্রতিটি নামাজ ২-৩ বার করে পড়ে, একঘন্টারও বেশি সময় লাগে।
তামান্না, প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে ১০০ বার তাওবা পড়ে, কারণ তার ভয় — “আমার মনে একবার খারাপ চিন্তা এলো, আমি শাস্তি পাবো।”
হিন্দু ধর্মের উদাহরণ:
অর্ণব প্রতিদিন পূজার আগে ঘরের মেঝে কমপক্ষে ৭ বার পানি দিয়ে ধুয়ে নেন। কারণ তার মনে হয়, জায়গাটা অপবিত্র হতে পারে।
জয়ন্তী কোনো ভুলভাবে মন্ত্র উচ্চারণ করলে মনে করেন, “দেবতা রেগে গেছেন।” তিনি আবার পূজার সমস্ত প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু করেন।
রাজীব, পূজার সময় এক পলকে মনে করল — “এই প্রতিমা যদি পাথর হয়?” এরপর সে ভয়ে কাঁপতে থাকে এবং পূজা বন্ধ করে দেয়।
➡️ তার চিন্তাটি বাস্তব না হলেও, OCD এর কারণে মনে হচ্ছে সে ভয়ানক পাপ করেছে।
সুমিত্রা, পূজার আগে মনে করে, তার কাপড় পুরোপুরি বিশুদ্ধ হয়নি। সে বারবার গোসল করে, পোশাক বদলায়, পূজা করতে গিয়ে ২ ঘণ্টা দেরি হয়।
খ্রিস্টান ধর্মের উদাহরণ:
এলিজা বাইবেল পড়ার সময় কোনো শব্দ স্পষ্টভাবে না বুঝলে ভয় পায় — “আমি কি ঈশ্বরের বাণী ঠিকমতো নিলাম না?” এরপর সে পুরো অধ্যায় আবার পড়ে।
জ্যাকব প্রার্থনার সময় হঠাৎ এক নেতিবাচক চিন্তা আসে, “আমি ঈশ্বরকে অপমান করলাম কি?” — এরপর সে নিজেকে থাপ্পড় মেরে শাস্তি দেয়।
ড্যানিয়েল, প্রার্থনার সময় মনে করে — “আমি কি ঈশ্বরের নাম সঠিকভাবে বললাম?”
➡️ সে প্রতিবার প্রার্থনা ৩-৪ বার করে করে যতক্ষণ না মনে হয় ঠিক হয়েছে।
আনা, চার্চে গিয়ে কনফেশন করে, কিন্তু বাসায় ফিরে আবার ভাবেন “আমি সব পাপ বলিনি!” — তাই তিনি সপ্তাহে ৩-৪ বার কনফেশন করতে যান।
বৌদ্ধ ধর্মের উদাহরণ:
মায়া প্রতিদিন “পাঁচটি প্রতিজ্ঞা” (Five Precepts) পাঠ করেন, কিন্তু মনে হয় সঠিকভাবে স্মরণ হয়নি। তিনি তা ২০–৩০ বার পড়েন যতক্ষণ না পুরোপুরি ‘বিশুদ্ধ’ মনে হয়।
অমিত, যখন কোনো ক্ষুদ্র প্রাণীকে ভুলে পিষে ফেলে, তখন কয়েকদিন খাবার না খেয়ে নিজেকে শাস্তি দেয়।
সুজাতা, ধ্যান করতে গিয়ে হঠাৎ একটি ‘মন্দ’ চিন্তা মনে এলো — সে ভয় পায় এই খারাপ চিন্তার কারণে তার কুশল কর্ম শেষ হয়ে গেছে।
➡️ সে দিনে ৫-৬ বার ধ্যান করে শুধুমাত্র সেই চিন্তাটি দূর করার জন্য।
মোহন, বৌদ্ধ উপাসক, হঠাৎ হাঁটার সময় একটি পিঁপড়ে পিষে ফেলে। সে এরপর অনেকক্ষণ অনুতপ্ত থাকে এবং নিজের ওপর মানসিকভাবে কঠোর হতে থাকে।
শিক্ষার্থী / তরুণদের উদাহরণ:
ইকরাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, পরীক্ষা দিতে গিয়ে মাঝে মাঝে মনে করে — “এই পরীক্ষার আগে ঠিকমতো নামাজ পড়লাম তো?” — চিন্তায় পরীক্ষা চলাকালীন বারবার বাইরে গিয়ে নামাজ পড়ে।
প্রীতি, কলেজ ছাত্রী, প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে ওঠে ৭ বার দোয়া পড়ে। কারণ মনে হয় না পড়লে তার পরিবারের কেউ হয়তো মারা যাবে।
বাচ্চা বয়সে OCD শুরু: ১১ বছর বয়সী নাফিসা, নামাজ পড়তে গেলে ভাবে, “আমি মন থেকে খারাপ কিছু ভাবলাম না তো?” — তাই সে অজান্তে নিজের উপর রাগ করে, কান্না করে।
পরিবারের প্রভাব: মা বলেন, “ভুল হলে পাপ হবে”, এই কথা শোনার পর থেকে ছেলে রাব্বি মনে করে যে প্রতিটি দোয়া যদি ঠিক না হয়, সে জাহান্নামে যাবে। ফলে OCD বাড়ে।
ধর্মীয় ওসিডি (Religious OCD) চিকিৎসার জন্য কি ধর্মীয় মনোবিজ্ঞানী (Religious Psychologist) দরকার?
উত্তর:
না, আবশ্যিক নয়।
ধর্মীয় গুরু বা ধর্মীয় মনোবিজ্ঞানী(ইমাম, পাদ্রী, পুরোহিত, ভিক্ষু) কেন ধর্মীয় OCD-এর চিকিৎসায় কার্যকর হন না?
১. OCD একটি মানসিক রোগ — ধর্মীয় নয়
•OCD বা Religious OCD মূলত আনইচ্ছাকৃত চিন্তা ও তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া নিয়ে গঠিত।
•এটি মস্তিষ্কের overactive error-detection system, anxiety এবং compulsive behavior–এর সমন্বয়ে তৈরি হয়। অর্থাৎ, ব্যক্তির মস্তিষ্ক সবকিছুতে “ভুল” বা “বিপদ” খুঁজে পায়।
🧬 মস্তিষ্কের ভূমিকায়:
•Orbitofrontal Cortex — এই অংশটি চিন্তা ও ভুলের বিশ্লেষণ করে। OCD-তে এটি অতিরিক্ত সচল হয়ে ওঠে।
•Amygdala — ভয় ও উদ্বেগ তৈরি করে
•Serotonin imbalance — OCD রোগীদের ক্ষেত্রে ব্রেনের সেরোটোনিন কার্যকারিতায় সমস্যা দেখা যায়।
• এই রোগের চিকিৎসা হয় থেরাপি (CBT/ERP) ও কখনও ওষুধ দিয়ে।
* অনেক ক্ষেত্রে বিষয়টি লার্নিং হয়ে থাকে আবার বংশগত হয়ে থাকে বা জেনেটিক এর প্রভাব থাকে ।
ধর্মীয় গুরু পাপ নিয়ে চিন্তা বোঝেন, কিন্তু রোগ হিসেবে চিনেন না:
•ওসিডি-তে রোগীর মাথায় অসংখ্য অনিচ্ছাকৃত চিন্তা আসে, যেগুলো সে নিজেই চায় না
•ধর্মীয় গুরু সাধারণত এসব চিন্তাকে “গুনাহ”, “ঈমান দুর্বলতা”, বা “শয়তানের ওয়াসওয়াসা” বলে ব্যাখ্যা করেন
•ফলে রোগী নিজেকে আরও বেশি দোষী ভাবতে শুরু করে
২. OCD হলো মানসিক রোগ, বিশ্বাসের দুর্বলতা নয়
•OCD রোগীর মস্তিষ্কে ভুল সংকেত পাঠায়, তাই সে বারবার সন্দেহ করে বা কাজ পুনরাবৃত্তি করে এটা কোনো আত্মিক দুর্বলতা নয় — এটা neurochemical imbalance এবং cognitive distortion
•ধর্মীয় গুরু সাধারণত এই মস্তিষ্কগত বা মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া বোঝেন না
৩. তারা চিকিৎসা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন: ধমীয় সাইকোলজিস্ট ধর্ম সম্পর্কে ভাল জানেন কিন্তু থেরাপি সম্পর্কে তার কোন প্রশিক্ষণ নাও থাকতে পারে। আবার থেরাপিস্ট ইসলাম ধর্মের কিন্তু পেশেন্ট আসল হিন্দু বা অন্য ধর্মের তখন কি হবে? মনে একদম জগাখিচুড়ি।
৪. উল্টো অনেক সময় রোগ বাড়িয়ে দিতে পারেন
•কেউ কেউ বলেন: “তুমি ঈমান দুর্বল, বেশি দোয়া করো, শয়তান তাড়াও”
• ফলাফল:
• রোগী আর বেশি কম্পালসন (রিচুয়াল) করতে থাকে
• OCD-এর চক্র আরও শক্তিশালী হয়
➡️ রোগী শান্তি পায় না, বরং ধর্মকে ভয় পেতে শুরু করে
⚠️ ধর্মীয় গুরু কখন সহায়ক?
✅ যদি তারা বুঝেন যে রোগী মানসিক সমস্যায় আছেন
✅ যদি তারা রোগীকে মানসিক থেরাপিস্ট বা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে রেফার করেন
✅ যদি তারা বলেন:
“তুমি অসুস্থ, পাপী নও। চিকিৎসা নাও — আল্লাহ তোমার মনের শান্তি চান।”
📌 রোগী কী করতে পারে?
• ধর্মীয় গুরুকে সম্মান করুন, কিন্তু মানসিক চিকিৎসা নিন পেশাদারদের কাছ থেকে
• রোগ সম্পর্কে পরিবার ও গুরুজনকে সচেতন করুন
• বিশ্বাস করুন: আপনার চিন্তা পাপ নয়, এটা একটি অসুস্থতা — এবং আপনি নিরাময়ের পথে যেতে পারেন
✅ ধর্মীয় ওসিডি চিকিৎসার মূল উপাদান হলো:
• Cognitive Behavioral Therapy (CBT), বিশেষ করে ERP (Exposure and Response Prevention)
• প্রয়োজনে SSRI জাতীয় ওষুধ
• থেরাপিস্টের সহানুভূতি ও বিজ্ঞানভিত্তিক বোঝাপড়া
Writer:
Md.Ashadujjaman Mondol