13/04/2023
জীবনের গল্প এবং প্যালিয়েটিভ কেয়ার এর গুরুত্বঃ
আমি ডাঃ মোঃ ইউসুফ আরাফাত,, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিদ্যায় ব্যাচেলার ডিগ্রী অর্জনের পর ২০১২ সাল থেকে জ্ঞান অন্বেষণের তাগিদে বিভিন্ন বিষয়ের উপরে বিভিন্ন সেমিনারে এটেন্ড করা শুরু করি,,
একপর্যায়ে 2015 সালের শেষের দিকে পিজি হসপিটালের
ই ব্লক এ অবস্থিত "প্যালিয়েটিভ কেয়ার" এর নাম শুনি এবং একটি সার্কুলার দেখি তিন দিনের একটি ট্রেনিং,,, অ্যাপ্লাই করলাম এবং সিলেক্টেড হলাম,,2015 সালের নভেম্বরের ৩০ তারিখ থেকে ডিসেম্বরে ২ তারিখ পর্যন্ত ট্রেনিং ছিল,,খুব ইনজয় করলাম বিশেষ করে প্রফেসর নিজাম উদ্দিন স্যারের প্রতিটি কথা হৃদয়ের মধ্যে গেঁথে গেল,, ট্রেনিং এর শেষের দিন উনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন আপনারা যদি কেউ লাইফ মেম্বার হতে চান তাহলে হয়ে যেতে পারেন,, কোন চিন্তাভাবনা ছাড়াই ওই দিন ই খুব আনন্দের সাথে লাইফ মেম্বার হিসাবে প্যালিয়েটিভ কেয়ার এ নাম লিখলাম ,, সেই দিন ন্যূনতম চিন্তা ও আসেনি , আমার জীবনের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে,,😓,,
তখন শুধু এতটুকুই চিন্তা ছিল হয়তো বা এই পরিবারভুক্ত হয়ে থাকলে আমার রোগীদের জন্য বিপদের মুহূর্তে কিছুটা সহযোগিতা করতে পারব,,
এরপর থেকে প্যালিয়েটিভ কেয়ার এর বিভিন্ন প্রোগ্রামে বিশেষ করে বাৎসরিক প্রোগ্রাম গুলোতে চিঠি পেলেই অ্যাটেন্ড করতাম আনন্দের সহিত,, ভালো লাগতো প্যালিয়েটিভ কেয়ার এর সাথে জড়িত ব্যক্তিদের, বিশেষ করে তখন জুলহাস ভাই এবং সম্রাট ভাই অফিসিয়ালি দায়িত্ব পালন করতো,, দুইজন ই খুব প্রিয় ব্যক্তি ছিল,,
২৫ ই ডিসেম্বর 2021,,, চার বছর বয়সী আমার ছোট মেয়ে নুজহাত এর হালকা ঠান্ডা জ্বর,, চিন্তা করলাম শীতের সকালে রোদে বসলে হয়তো ভালো লাগবে, তাই তাকে কোলে করে চেম্বারের সামনে রোদে নিয়ে আসতে চাইলাম,, জামা পরাতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম তার বাম হাতের সোল্ডার এ কিছুটা ফুলে আছে,, দেখার সাথে সাথে মাথার মধ্যে খুব খারাপ ভাবে একটা চাপ অনুভব করলাম,, মেয়ের মা কে বললাম, তুমি এখনি একটু হসপিটালে নিয়ে যাও ওইখানে একটা এক্সরে করাও,, এক্সরে রিপোর্টটা ভালো আসলো না,, মনে করেছিলাম রিপোর্ট ভুল এসেছে ,, বিশ্বাস করতে পারছিলাম না,,
সেদিন থেকে শুরু হল আমার কষ্টের জার্নি,, 😓, একজনের পর একজন শুধু ডাক্তার দেখিয়ে ই গেলাম,, মনের মধ্যে শুধু একটাই সংশয়, এই বুঝি আমার মেয়ের হাতের অংশটা কেটে ফেলতে হবে,, 😓,
একপর্যায়ে ভর্তি হতে হলো ঢাকা শিশু হসপিটালে,, টোটাল রিপোর্ট গুলো আমাকে আরো খারাপের দিকেই ইঙ্গিত করছিল,,
ওইখান থেকে সিদ্ধান্ত দিলো আপনারা ক্যান্সার হসপিটালের একজন ডাক্তার দেখান,, পূর্ব পরিচিত ক্যান্সার হসপিটালের এক ডাক্তার আপার পরামর্শ ভর্তি হতে হল ক্যান্সার হসপিটালে,, একের পর এক টেস্ট আর সময় অতিবাহিত হতে হতে একসময় প্রয়োজন হলো বোনমেরু টেস্ট করার যেটা ক্যান্সার হসপিটাল নেই,, তখন বলা হলো আপনারা পিজি হসপিটালে করাতে পারেন অথবা ওইখানে নিয়ে ভর্তি করেন,, শুরু হলো পিজি হসপিটাল এর জার্নি,,
বোনমেরু টেস্ট, এতো কষ্টের টেস্ট,, এখনো বুকের সাথে মিশে থাকা মেয়ের আত্মচিৎকারে শুনতে পাই,,
ডি-ব্লক এর শিশু ওয়ার্ড যেখানে পুরুষ এলাও না, সেখানে মেয়ের একটা ই কথা "আমি বাবাকে ছাড়া থাকবো না",,
গার্ডদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুরি করে কয়বার দেখা করা যায়? ,, তারপরে জানালার পাশে চুরি করে দাঁড়িয়ে থাকতাম,,
যেইদিন বোনমেরু টেস্ট এর রেজাল্ট দিবে ঠিক সেদিনই অজানা কারণে "ই ব্লকের" নিচে বসে ছিলাম,, হঠাৎ দেখলাম আমার সামনে প্রফেসর নিজামুদ্দিন স্যার গাড়ি থেকে নামলেন, যদিও শুনেছিলাম উনি 2019 এ হসপিটাল থেকে অবসরে চলে গেলেন,, সাথে সাথে স্যার কে সালাম দিয়ে আমার অবস্থা জানালাম, স্যার কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো এরপরে বলল তুমি লাইব্রেরী রুমে আসো,, স্যারের সাথে সাথেই গেলাম, কথা বলছিলাম স্যারের সাথে,, ঠিক তখনই ডি ব্লক থেকে মেয়ের মা ফোন দিল
"ডাক্তার কি জানি বলছে, আমি কিছু বুঝতে পারছি না তুমি তাড়াতাড়ি আসো"
স্যারের অনুমতি নিয়ে দৌড় দিলাম ডি ব্লক এ,, কথা শুনছি আর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে,, আমাকে জানানো হলো আপনার মেয়ের আর কোন চিকিৎসা নেই, নিয়ে যান বাসায়, আপনারা দেশের বাইরে নিয়ে বোন মেরু ট্রান্সপ্লান্ট করলে ১৫ থেকে ২০ পার্সেন্ট সম্ভাবনা আছে সেই ক্ষেত্রে কোটি টাকার উপরে খরচ,,
সাথে সাথে আবার স্যারের কাছে দৌড় দিয়ে আসলাম, জানালাম ডিটেলস,, স্যার বললো সবই তো আল্লার ইচ্ছা তুমি এখানে নিয়ে আসো,, পরের দিন ই সব কিছু রেডি করে ই ব্লকের প্যালিয়েটিভ কেয়ার ডিপার্টমেন্টে ভর্তি করালাম,, আমার মেয়ে মনে হয় নতুন জীবন পেলো সাময়িক সময়ের জন্য,,সে আমার সাথে থাকতে পারলো,,
এতদিনের জার্নিতে যেখানে কোনভাবেই তার ব্যথা কমছে না, সারাদিন শুধু একটা ই কথা ছিল, "বাবা ব্যথা, বাবা ব্যথা, সেখানে প্যালিয়েটিভ কেয়ার এ ভর্তি করার পর আস্তে আস্তে তার ব্যথা কমা শুরু হল এবং কিছুটা ভালোর দিকে আসলো,, ১০-১৫ দিন থাকার পর কিছুটা ভালো অবস্থা নিয়ে বাসায় আসলাম,,
ভুলেই গিয়েছিলাম সে অসুস্থ ছিল,, কয়েক মাস পর হঠাৎ করে তার প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেল,, ইমারজেন্সি ব্যবস্থা নেওয়ার পরে আবার ভর্তি হতে হল প্যালিয়েটিভ কেয়ার এ,,
৫ ই ফেব্রুয়ারি ২০২২,,এই ভর্তি ই তার শেষ ভর্তি চিন্তা ও করতে পারেনি,, 😓😓
১৬ ই ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩.৩০ এ প্যালিয়েটিভ কেয়ার এর চাইল্ড ওয়ার্ড এর বেডে পরিবারের সকলকে সামনে রেখে পৃথিবীর সকল কষ্টকে শেষ করে হাসতে হাসতে জান্নাতে চলে গেছে আমার পাঁচ বছর তিন মাস বয়সী মেয়ে নুজহাত ❤️❤️
মৃত্যু আমাদের সকলেরই আছে, তবে সবার থেকে বিদায় নিয়ে এইরকম উত্তম মৃত্যু সবার ভাগ্যে আসে না,,
প্রফেসর নিজাম উদ্দিন স্যার ট্রেনিং গুলোতে হয়তোবা এইরকম উত্তম মৃত্যুর কথাই বলেছেন, সেটা ওই দিন ই উপলব্ধি করতে পেরেছি,,
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্যালিয়েটিভ কেয়ার আমাকে এবং আমার মেয়েকে সাপোর্ট দিয়ে গেছে,, যার জন্য সারা জীবন আমি কৃতজ্ঞ এই পরিবারের প্রতি,, আর এই সাপোর্টটা নাগরিক হিসেবে প্রতিটি ব্যক্তিরই অধিকার বলে আমি মনে করি,, আমি তখনই এর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি, যখন আমাকে ডাক্তার বলেছে "আপনার মেয়ের আর কিছুই করার নেই" আর প্যালিয়েটিভ কেয়ার এর কথা হচ্ছে
"কিছু না কিছু করার থাকতেই হবে"
আমার কখনো প্রয়োজন হবে এটা যেমন আমি চিন্তা করতে পারেনি , ঠিক তেমনি ভাবে আপনার কখন প্রয়োজন হবে সেটা আপনিও অনুমান করতে পারবেন না,,তাই এই সেবা সম্পর্কে প্রত্যেকেই জ্ঞান রাখা উচিত বলে মনে করি,,
প্যালিয়েটিভ কেয়ার কি??
প্যালিয়েটিভ কেয়ার হচ্ছে এমন একটি আশ্রয়স্থল যেখানে, নিরাময় অযোগ্য রোগীদের শারীরিক এবং মানসিক কষ্ট কমানো একটি প্রচেষ্টা,, যখন হসপিটাল থেকে অথবা ডাক্তারের পক্ষ থেকে বলা হয় "আমাদের আর কিছু করার নেই " তখন ই জীবনের শেষ বিন্দু পর্যন্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার নির্ভরযোগ্য হাতটা এই হচ্ছে "প্যালিয়েটিভ কেয়ার",,
""জীবন সীমিত নিরাময় অযোগ্য রোগে আক্রান্ত রোগী এবং তার পরিবারের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং আত্মিক সেবা প্রধানের প্রচেষ্টার আদর্শ রূপ প্যালিয়েটিভ কেয়ার,,,,,