02/12/2025
আপনি কি জানেন সার্জারি বা শল্য চিকিৎসার জনক কে?
না জানা থাকলে গুগলে সার্চ করুন বা এআই এর মাধ্যমে জেনে নিন। তার আগে এই লেখাটি মনো যোগ দিয়ে পড়ুন।
সার্জারির জন্ম কোনো আধুনিক অপারেশন থিয়েটারে হয়নি,
হয়েছিল ১৭৯৩ সালে পুনের এক ধুলোমাখা রাস্তায়!
দৃশ্যটা কল্পনা করুন- পুনের এক সাধারণ কুঁড়েঘরের দরজায় বসে আছেন কাওয়াসজি (Cowasjee) নামের এক ব্যক্তি। তাঁর চেহারা বীভৎস, কারণ তাঁর নাকটা নেই। মুখের ঠিক মাঝখানটা যেন কেউ ধারালো অস্ত্র দিয়ে চেঁছে তুলে নিয়েছে। সামনে বসে আছেন একজন সাধারণ গ্রামের কুমোর (Potter), যার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেই, আছে শুধু একটা ধারালো ক্ষুর আর কিছু ভেষজ লতাপাতা। আর তাঁদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন দু'জন বিলাত-ফেরত ব্রিটিশ সার্জন টমাস ক্রুসো এবং জেমস ফাইন্ডলে। তাঁদের চোখে-মুখে অবিশ্বাস আর কৌতূহল। তাঁরা দেখছেন, লন্ডনের বড় বড় মেডিকেল কলেজে যা শেখানো হয় না, ভারতের এই ধুলোবালি মাখা রাস্তায় বসে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন এক কুমোর কিভাবে সেটা করেন?
ঘটনার পেছনের গল্প- কাওয়াসজি ছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গরুরগাড়ির চালক। ১৭৯২ সালে টিপু সুলতানের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তিনি ধরা পড়েন। শত্রুসেনারা শাস্তি হিসেবে তাঁর নাক এবং এক হাত কেটে দেয়। সেই যুগে নাক কেটে দেওয়া ছিল মৃত্যুর চাইতেও বড় অপমান। লোকলজ্জায় কাওয়াসজি মুখ লুকিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। শেষে তিনি শরণাপন্ন হন পুনের সেই কুমোর বৈদ্যের।
অপারেশন : লস্ট টেকনোলজি- ব্রিটিশ ডাক্তাররা ভেবেছিলেন, কুমার হয়তো কোনো মলম লাগিয়ে ছেড়ে দেবেন। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটলো, সেটা দেখে তাঁদের চক্ষু চড়কগাছ!
কুমোর বৈদ্য প্রথমে একটি পাতলা মোম দিয়ে কাওয়াসজির নাকের মাপ নিলেন। এরপর সেই মাপ বসালেন কাওয়াসজির কপালে। তারপর খুব ধীরস্থির হাতে ক্ষুর চালালেন। কপাল থেকে চামড়া ও টিস্যুর একটি অংশ এমনভাবে কাটলেন, যাতে সেটা পুরোপুরি আলগা হয়ে না যায়— একটা সরু অংশের সঙ্গে ঝুলে থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে 'Pedicle Flap'। এই ঝুলে থাকা অংশটিই চামড়াটাকে জীবিত তথা রক্ত সঞ্চালন বজায় রাখে।
কুমোর সেই চামড়াটা উল্টে নামিয়ে আনলেন নাকের ওপর। নিপুণ হাতে সেলাই করে জুড়ে দিলেন কাটা জায়গায়। যেন মাটির কলসিতে তালি দিচ্ছেন- এতোটাই সহজ তাঁর ভঙ্গি! এরপর তিলের তেল আর ভেষজ প্রলেপ দিয়ে জায়গাটা বেঁধে দিলেন।
কয়েক সপ্তাহ পর যখন ব্যান্ডেজ খোলা হলো, ব্রিটিশ ডাক্তাররা বাকরুদ্ধ। কাওয়াসজি ফিরে পেয়েছেন তাঁর নাক! দাগ আছে সামান্য, কিন্তু গঠন প্রায় আগের মতোই।
লন্ডনে তোলপাড় এবং সুশ্রুতের প্রত্যাবর্তন- চোখের সামনে ঘটলেও এই ঘটনা ব্রিটিশ ডাক্তারদ্বয় ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না?
তাঁরা কাওয়াসজির ছবি আঁকালেন এবং বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠালেন লন্ডনে। ১৭৯৪ সালের অক্টোবর মাসে বিখ্যাত 'Gentleman's Magazine'-এ এই ঘটনা ছাপা হলো।
শিরোনামে লেখা ছিল : "একটি অদ্ভুত অপারেশন- যা কোনো ডাক্তার করেননি, করেছেন পুনের এক কুমোর।"
ইউরোপের চিকিৎসাজগত নড়েচড়ে বসলো। ১৮১৪ সালে এই রিপোর্ট পড়েই বিখ্যাত সার্জন জোসেফ কনস্টানটাইন কার্পু (Joseph Constantine Carpue) দীর্ঘ ২০ বছর গবেষণা করে ইউরোপে প্রথমবারের মতো সফল নাক প্রতিস্থাপন করেন। তিনি এর নাম দেন "The Indian Method"।
আসল নায়ক : মহর্ষি সুশ্রুত- মজার ব্যাপার হলো, পুনের সেই কুমোর কিন্তু কোনো জাদুকর ছিলেন না। তিনি প্রয়োগ করেছিলেন ২৬০০ বছরের পুরানো এক ভারতীয় জ্ঞান। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে (অর্থাৎ যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে) মহর্ষি সুশ্রুত তাঁর অমর গ্রন্থ 'সুশ্রুত সংহিতা'-য় (অধ্যায় ১৬) ঠিক এই পদ্ধতিটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন কিভাবে গাল বা কপালের চামড়া দিয়ে নাক মেরামত করা যায়?
কালের বিবর্তনে বড় বড় শিক্ষালয় ধ্বংস হয়ে গেলেও ভারতের নাপিত, কুমোর আর বৈদ্যরা বংশ পরম্পরায় এই বিদ্যা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। বাবা শিখিয়েছেন ছেলেকে, ছেলে শিখিয়েছেন তাঁর ছেলেকে। এভাবেই সুশ্রুতের জ্ঞান হাজার বছর পাড়ি দিয়ে ১৭৯৩ সালে পুনের সেই কুমোর পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিল।
আজ বিশ্বজুড়ে কসমেটিক সার্জারি বা রাইনোপ্লাস্টি নিয়ে যে এতো মাতামাতি, তার শেকড় কিন্তু পশ্চিমা ল্যাবরেটরিতে নয়, প্রোথিত আছে আমাদের এই উপমহাদেশের মাটিতেই।
ইতিহাসের পাতাগুলো বড় অদ্ভুত- আমরা ভাবি আধুনিক বিজ্ঞান মানেই পশ্চিমের দান, অথচ তার Blue Print হয়তো হাজার বছর আগেই আমাদের পূর্বপুরুষরা তৈরি করে (লিখে রেখে) গিয়েছিলেন।
পুনশ্চ:- পাশ্চাত্যের বাণিজ্যিক ধারার চিকিৎসাবিদ্যায় প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি লাভ করে যারা নিজেদেরকে বড় চিকিৎসক মনে করেন, তাঁদের উচিত প্রাচীন ভারতীয় প্রাকৃতিক চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান আহরণ করা।
( উক্ত লেখা অন্তঃর্জাল থেকে নেয়া ও নতুন করে সাজিয়ে লেখা হয়েছে এবং ছবি এআই এর মাধ্যমে নির্মিত হয়েছে। )
** সবার জানার জন্য শেয়ার করুন।