28/07/2025
রক্তে হিমোগ্লোবিন কম,বা অ্যানিমিয়া মানেই কি রক্তে আয়রনের অভাব?
উত্তর: না, সবসময় নয়।
অ্যানিমিয়ার তার পিছনে লুকিয়ে থাকতে পারে প্রাণঘাতী কোনও কারণ। লিখলেন ডাঃ ত্রিবর্না সিনহা চক্রবর্তী।
এরকম প্রায়শই বলতে শুনি,
" এই তোমার অ্যানিমিয়া আছে? রক্তে হিমোগ্লোবিন কম? আয়রন ট্যাবলেট খাও"। আবার আয়রন বেশী থাকে সেরকম খাবারের নাম ও কেউ কেউ বলে দেন অযাচিত ভাবে।
একজন ডাক্তার এবং পাথোলজিস্ট হবার সুবাদে বলছি, এই অযাচিত উপদেশ গুলো দেওয়া please বন্ধ করুন।
👉🏻 অ্যানিমিয়ার নেপথ্যে থাকতে পারে কোনো Chronic disease — যেমন Arthritis, Infection, Kidney problem।
👉🏻হতে পারে Thalassemia trait — যেখানে আয়রন দিলে উল্টে ক্ষতি হতে পারে, হতে পারে Vitamin B12 বা Folate deficiency, হতে পারে Hemolytic anemia .
তাই শুধু হিমোগ্লোবিন দেখে ওষুধ দেবেন না , বা খাবেন না Please. বরং ডাক্তার দেখিয়ে অ্যানিমিয়ার কারন টা কি সেটার Proper investigation করান।
⚫ এই প্রসঙ্গে কদিন আগেই ঘটে যাওয়া একটি নির্মম বাস্তব কাহিনি বলি।
একটা সত্যি ঘটনা… অ্যানিমিয়ার নেপথ্যে এক জীবন চলে যাওয়ার বাস্তব ঘটনা ।
প্রায় ১৫ বছর আগের কথা। বাড়ির প্রথম ইন্টিরিয়র কাজের সময় এক অসাধারণ কার্পেন্টারকে পেয়েছিলাম। ছেলেটি খুবই পরিশ্রমী আর নিখুঁত হাতে ফার্নিচার তৈরি করত। তাই, বাড়ির যে কোনো কাঠের কাজেই ওকে মাঝে মধ্যেই ডেকে পাঠাতাম।
তারপর হঠাৎ একদিন—এই তো বছর তিনেক আগে—আমায় ফোন করল। বলল, " দিদি, আপনার কাছে আমার স্ত্রী কে একবার দেখাতে চাই।"
আমি বললাম, " নিয়ে এসো।"
নিয়েও এলো। মেয়েটি শান্ত, মিষ্টি চেহারার । প্রথম দেখাতেই আমি চমকে উঠলাম।
বললাম, “তোমার স্ত্রীর শরীরে তো একদম রক্ত নেই। কী করেছো?”
উত্তরে মেয়েটি নিজেই হেসে বলল,
"আমি ওকে কতোদিন থেকে বলি, আমার শরীর ভালো লাগে না, শুধু শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে....হাঁপ ধরে, ক্লান্ত লাগে...আর ও বলে, আমি নাকি ফরসা হচ্ছি, সুন্দর হচ্ছি!!"
এটাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভুল বোঝাবুঝি।
এর পিছনে যে নিঃশব্দ বিপদ ঘাপটি মেরে বসেছিল, তা তখনও ওরা জানত না।
শরীর ফরসা হলে যে সবসময় সৌন্দর্য বাড়ে না—এই কথা যেন মেয়েটির মুখেই তখন ফুটে উঠছিল।
আমি বললাম, আসলে , তোমরা যাকে ফরসা ভাবছো আমাদের চোখে সেটা ফ্যাকাশে বা Pale হয়ে যাওয়া।
Severe anaemia তে blood supply কমে গিয়ে রক্তচাপ নেমে যায় তাই skin হয়ে যায় pale, চোখের conjunctiva হয় রঙহীন, ঠোঁট বিবর্ণ।
মেয়েটিকে দেখে বুঝলাম , ব্যাপারটা হালকা নয়। দুই পা ও দেখলাম ফুলে গেছে।
আমি বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করলাম। জানা গেল, মেয়েটি দীর্ঘদিন ধরেই ক্লান্ত, খাওয়া-দাওয়া ঠিক নেই, মাথা ঘোরে, বুক ধড়ফড় করে, দাঁড়ালেই চোখে অন্ধকার দেখে।
জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার আগে কখনও হিমোগ্লোবিন টেস্ট করানো হয়েছে?”
মেয়েটি মাথা নেড়ে বলে, “এক কবিরাজের পরামর্শে অনেকদিন ধরে আয়রনের ট্যাবলেট খেয়েছি দিদি। তেমন কিছু লাভ হয়নি। কেউ বলেছিল পালং শাক, কুলেখাড়া খেতে—সেগুলিও খেয়েছি। কিছুদিন ভালোও লাগতো, তারপর আবার শরীর খারাপ... মাথা ধরে, বুক ধড়ফড় করে... ইত্যাদি ।"
এরপর শুরু হল পরীক্ষা-নিরীক্ষা। রক্ত পরীক্ষা করতেই ধরা পড়ল Severe anaemia, হিমোগ্লোবিন নাম মাত্র । Severe anaemia র সাথে, ওর ছিল Raised creatinine & urea level, Shrunken kidneys on USG.
Diagnosis: Chronic Kidney Disease (CKD) – Stage 5 (ESRD)end-stage renal disease।
Treatment: Urgent Kidney Transplantation.
ওদেরকে বোঝালাম, এই অ্যানিমিয়া আসলে সেকেন্ডারি টু কিডনি ফেইলিওর।
বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় ছিল kidney transplantation।
দুঃখজনকভাবে—অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা আর সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত না নিতে পারার কারণে, ওদের পক্ষে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সম্ভব হলো না... এবং কয়েক মাসের মধ্যেই মেয়েটি চলে গেল... নিঃশব্দে, অকালে।
আজও সেই স্মৃতি মনে পড়লে বুকের মধ্যে হাহাকার জেগে ওঠে।
- যদি রোগটি আরো আগে ধরা পড়ত!!...
- যদি আয়রন ট্যাবলেট খেয়ে রোগ টা কে এতোদিন চাপা না দেওয়া হতো!!.....
- যদি কেউ ওদেরকে আগে সাবধান করত!!...
- যদি 'ফর্সা হওয়া'কে রঙ নয়, রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখা যেত!!...
এই ঘটনাটি বললাম , কারণ এর পেছনে লুকিয়ে আছে এক বড় শিক্ষা।
সচেতন হোন,
👉🏼 সব এনিমিয়া মানেই আয়রনের ঘাটতি নয়।
👉🏼 সব ক্লান্তি মানেই শরীর দুর্বল না। পিছনে অন্য রোগও থাকতে পারে।
👉🏼 আর শুধু আয়রনের ট্যাবলেট খেলেই রোগ ভালো হয় না—অনেক সময়ে তাতে রোগ চাপা পড়ে, কিন্তু মূল কারণটা থেকে যায় অচেনা, অজানা।
এবার প্রশ্ন জাগবে, কিডনি রোগে কেনো অ্যানিমিয়া ?
কিডনি Erythropoietin (EPO) নামের হরমোন তৈরি করে, যা Bone marrow কে RBC / লোহিত রক্ত কণিকা তৈরি করতে বলে। দুটো কিডনিই যখন অকেজো হয়ে যায়, তখন EPO উৎপাদন বন্ধ, ফলে Bone marrow থেকে রক্ত তৈরী বন্ধ, আর দেখা দেয় মারাত্মক রকমের এনিমিয়া।
তাই ,
দীর্ঘদিন ধরে চলা অ্যানিমিয়া, শরীরের ক্লান্তি, অরুচি, বমি ভাব, পা ফুলে যাওয়া – এগুলোকে অবহেলা করবেন না।
এমনকি ফর্সা হয়ে যাওয়া ত্বকও হতে পারে এক বিপজ্জনক সংকেত।
রক্ত পরীক্ষা (CBC) ও কিডনি ফাংশন টেস্ট (KFT) সময়মতো করানো জরুরি। সাথে Peripheral smear, Iron profile, Vitamin B12, বা Hb Electrophoresis দরকার অনুযায়ী করলে অ্যানিমিয়ার কারণ জানা যায়, সঠিক রোগ ধরা পড়ে।
তাই কেউ যদি আপনার সামনে বলে, আমার অ্যানিমিয়া আছে বা হিমোগ্লোবিন কমে গেছে, তাকে উল্টে বলুন,
" কি কারণে তোমার অ্যানিমিয়া একটু ভালো করে investigation করাও। ওষুধ খাবার আগে অ্যানিমিয়ার কারণ টা কি সেটা জানা দরকার।"
— অনুমান নয়, প্রমাণে ভরসা রাখুন।
Dr✍️ Tribarna Sinha Chakraborty,
MBBS, MD (Pathology).