27/09/2022
বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস ২০২২
‘জলাতঙ্ক : মৃত্যু আর নয়, সবার সঙ্গে সমন্বয়’।
বিশ্বে প্রতি ১০ মিনিটে একজন এবং প্রতিবছর প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ জলাতঙ্ক রোগে মারা যান। বাংলাদেশেও বছরে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ জন রোগী মৃত্যুবরণ করেন জলাতঙ্কে। শুধু মানুষই নয়, প্রতিবছর প্রায় ২৫ হাজার গবাদিপশুও জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে থাকে দেশে। রোগটি প্রতিরোধের লক্ষ্যে মানুষকে সচেতন করতেই গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর র্যাবিস কন্ট্রোলের উদ্যোগে প্রতিবছর ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জলাতঙ্ক দিবস পালিত হয়।
জলাতঙ্ক যেভাবে ছড়ায়: কুকুর, শিয়াল, বিড়াল, বানর, বেঁজি, বাদুড় ইত্যাদি র্যাবিস জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে এবং আক্রান্ত উল্লেখিত প্রাণি মানুষকে কামড়ালে মানুষের এ রোগ হয়। এসব আক্রান্ত প্রাণির মুখের লালায় র্যাবিস ভাইরাস থাকে। এ লালা পুরোনো ক্ষতের বা দাঁত বসিয়ে দেওয়া ক্ষতের বা সামান্য আঁচড়ের মাধ্যমে রক্তের সংস্পর্শে এলে রক্তের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং জলাতঙ্ক রোগ সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে শতকরা ৯৫ ভাগ জলাতঙ্ক রোগ হয় কুকুরের কামড়ে।
জলাতঙ্কের লক্ষণ: সন্দেহজনক প্রাণি কামড়ানোর ৯ থেকে ৯০ দিনের মাঝে জলাতঙ্কের লক্ষণ দেখা দেয়। কারো শরীরে জলাতঙ্কের লক্ষণ দেখা দিলে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে উন্মত্ত বা পাগলামো আচরণ এবং মৌন আচরণ—এ দুই ধরনের আচরণ দেখা দিতে পারে।অস্বাভাবিক আচরণে আক্রান্ত ব্যক্তির কথাবার্তা ও ভাবভঙ্গি হবে অস্বাভাবিক। সে উদ্দেশ্য ছাড়াই ছুটে বেড়াবে, ক্ষুধামন্দা হবে, বিকৃত আওয়াজ করবে, বিনা প্ররোচনায় অন্যকে কামড়াতে আসবে ইত্যাদি।
এছাড়া পানির পিপাসা খুব বেড়ে যাবে, তবে পানি খেতে পারবে না। পানি দেখলেই আতঙ্কিত হবে, ভয় পাবে। আলো-বাতাসের সংস্পর্শে এলে আতঙ্ক আরও বেড়ে যাবে। খাবার খেতে খুবই কষ্ট হবে, খেতে পারবে না। শরীরে কাঁপুনি, মুখ দিয়ে অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ হবে। কণ্ঠস্বর কর্কশ হতে পারে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাবে, আক্রমণাত্মক আচরণ দেখা দেবে।
মৌন আচরণে আক্রান্ত স্থান একটু অবশ অবশ লাগবে। শরীর নিস্তেজ হয়ে ঝিমুনি আসতে পারে। মানুষের চোখের আড়ালে থাকা, শরীরে কাঁপুনি ও পক্ষাঘাত দেখা দিতে পারে।
সন্দেহজনক প্রাণি কামড় বা আঁচড় দিলে যা করবেন:
সন্দেহভাজন প্রাণি কামড়ানো বা আঁচড়ানোর সাথে সাথে ক্ষতস্থানটি ১০-২০ মিনিট ধরে সাবান বিশেষ করে কাপড় কাঁচা সাবান ও প্রবহমান পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলার পর পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্রবণ দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে। এরপর ক্লোরহেক্সিডিন বা পোভিডোন আয়োডিন দিয়ে ক্ষতস্থানটিকে ভালো করে ওয়াশ করতে হবে। এতে ৭০-৮০% জীবাণু নষ্ট হয়ে যায়।
জীবাণুর সংস্পর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা:
ক্যাটাগরি ১: পশু যদি শুধু স্পর্শ করে বা অক্ষত চামড়ায় লেহন করে, তবে কিছু করতে হবে না।
ক্যাটাগরি ২: আঁচড়, রক্তপাতহীন ছুলে গেলে চামড়ার যত্ন নেওয়া এবং টিকা নিতে হবে।
ক্যাটাগরি ৩: চামড়া ভেদ করা কামড়, ছুলে যাওয়া চামড়া কিংবা দেহাভ্যন্তরে লেহন, মুখমণ্ডল বা পিঠে মেরুদণ্ডের কাছাকাছি আঁচড়, রক্তখেকো বাদুড়ের আঁচড়ে চামড়ার যত্ন, টিকা ও ইমিউনোগ্লোবিন ইনজেকশন নেওয়া লাগবে।
টিকার ধরন এবং ডোজ:
জলাতঙ্কের দুই ধরনের টিকা রয়েছে। একধরনের টিকা মাংসপেশিতে (শুধু বাহুতে) এবং অন্যটি চামড়ায় দিতে হয়। চামড়ায় দেওয়া টিকা বেশি কার্যকর, কম খরচ হলেও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে মাংসপেশির টিকাই বেশি প্রচলিত।
আগে কিংবা গত পাঁচ বছরে টিকা দেওয়া হয়নি, এমন ব্যক্তি বা শিশুর জন্য ডোজ: ০ (কামড় নয়, টিকা দেওয়ার দিন), ৩, ৭, ১৪দিন। আরেকটি সূচি হচ্ছে ০তম দিনে দুই বাহুতে ২টি টিকা এবং ৭ ও ২১তম দিনে ১টি করে টিকা।
* পশু আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে অন্তত ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই টিকা নিয়ে নেওয়া উচিত।
* কোনো কারণে ইমিউনোগ্লোবিন পাওয়া না গেলে (ক্যাটাগরি ৩) ০তম দিনে দুই বাহুতে ২ টিকা নিতে হবে। ৩, ৭, ১৪ ও ২৮তম দিনে নিয়ে ডোজ পূর্ণ করতে হবে।
* পাঁচ বছরের মধ্যে টিকা নেওয়া থাকলে ০ ও তৃতীয় দিনে বুস্টার টিকা নিলেই হবে।
* ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তির ক্ষেত্রে কামড়ের আগেই টিকা—০ ও তৃতীয় দিন; এরপর আক্রান্ত হলে ০, ৭ ও ২১/২৮তম দিন।
* শুধু গৃহপালিত কুকুর ও বিড়ালের কামড়ের পর যদি সেই প্রাণী পরবর্তী ১০ দিন সম্পূর্ণ সুস্থ থাকে, তবে ১৪ ও ২৮তম দিনের টিকা না দিলেও হবে।
একটি কথা বলা উচিত, জলাতঙ্ক মস্তিষ্কের এমন একটি গুরুতর অসুখ, যেটা প্রতিরোধের জন্য কোনো ধরনের অবহেলা করা যাবে না। অন্তঃসত্ত্বা, স্তন্যদানকারী মা, নবজাতক শিশু, অতিবয়স্ক ব্যক্তিও টিকা নিতে পারবেন। কোনো রকম সন্দেহ, প্রশ্ন থাকলেও অসুখের ভয়াবহতা বিবেচনা করে টিকা নিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে
ক্ষতস্থানে যা করা যাবে না: ক্ষতস্থানে কোনো স্যালাইন, বরফ, চিনি, লবণ ইত্যাদি ক্ষারক পদার্থ ব্যবহার করা যাবে না। বাটিপড়া, পানপড়া, চিনিপড়া, মিছরিপড়া, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি জলাতঙ্কের হাত থেকে কাউকে বাঁচাতে পারে না। ক্ষতস্থান কখনোই অন্য কিছু দিয়ে কাটা, চোষণ করা বা ব্যান্ডেজ করা যাবে না। এতে বরং ইনফেকশন হতে পারে। ক্ষতস্থানে বরফ, ইলেকট্রিক শক দেওয়া যাবে না কিংবা হাত-পা বাঁধাও যাবে না। কোনো কবিরাজ বা ওঝার শরণাপন্ন হয়ে কোনো অবৈজ্ঞানিক কিংবা অপচিকিৎসা গ্রহণ করে সময় ক্ষেপণ করবেন না।
যেসব প্রাণির কামড়ে ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রয়োজন নেই: ইঁদুর, খরগোশ, কাঠবিড়ালী, গুঁইসাপ ইত্যাদি কামড় দিলে র্যাবিস ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে টিটেনাস ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
বিশেষ অবস্থায় ভ্যাকসিন নিতে সমস্যা হবে কি: গর্ভাবস্থায়, মায়ের স্তন্যদানকালে, অন্য যেকোনো অসুস্থতায়, ছোট বাচ্চা বা বৃদ্ধ ব্যক্তি এরকম কোনো বিশেষ অবস্থায় জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন নিতে কোনো সমস্যা নেই।