08/12/2025
“জ্বীনের সাহায্য নিয়ে সমস্যা সমাধান করা জায়েজ আছে, ভাই। আল্লাহর নবী সুলাইমান আলাইহিস সালামও জ্বীনের সাহায্য নিয়েছিলেন! এই কবিরাজ জ্বীনের সাহায্য নিয়ে তোমাকে সাহায্য করবেন। আমাদের এলাকায় অনেক মানুষ উনার মাধ্যমে সাহায্য পেয়েছেন।”
ফরিদ সাহেবের বেশ কিছুদিন ধরেই ব্যবসায় লাগাতার অবনতি যাচ্ছে। কোনো ভাবেই কোনো উন্নতির দেখা মিলছে না।
বিষয়টি নিয়ে পেরেশান থাকতে থাকতে তার অন্যান্য পারিবারিক এবং সামাজিক সম্পর্কগুলোও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মোটকথা, সব মিলিয়ে খুবই হযবরল অবস্থা! একদিন একজন পুরনো দিনের বন্ধুর সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলে বন্ধুটি তাকে একজন কবিরাজের ঠিকানা দিয়ে উপরের কথগুলো বললেন।
এরপর ফরিদ সাহেব উনার ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে ইকরামের সাথে আলোচনা করেন। ইকরাম ভার্সিটির পাশাপাশি অনলাইনে ইসলাম নিয়ে ধারাবাহিকভাবে পড়াশোনা করছে মাশাআল্লাহ। ইকরাম বিষয়টি শুনার পরে বাবাকে বললেন-
"সুলাইমান আলাইহিস সালাম এর বিষয়টি একমাত্র উনার জন্যই ইউনিক ছিল। আমাদের দেখা উচিত আমাদের নবীজি রসূলুল্লহ্ সলাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কিরামগন জ্বীনের সাহায্য নিয়েছিলেন কিনা কোনো বিষয়ে।
সুলাইমান আলাইহিস সালাম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার নিকট দু'আ করেছিলেন:
"হে আমার রব, আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমাকে এমন এক রাজত্ব দান করুন যা আমার পর আর কারও জন্যই প্রযোজ্য হবে না। নিশ্চয়ই আপনি বড়ই দানশীল।" (সুরা সাদ: ৩৫)
আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
একটি অবাধ্য জ্বীন একরাতে আমার সালাতে বাধা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আমার নিকট আসল। আল্লাহ্ আমাকে তার উপর ক্ষমতা প্রদান করলেন। আমি তাকে ধরলাম এবং মসজিদের একটি খুঁটির সাথে বেঁধে রাখার ইচ্ছে করলাম, যাতে তোমরা সবাই স্বচক্ষে তাকে দেখতে পাও। তখনই আমার ভাই সুলাইমান আলাইহিস সালাম-এর এ দু’আটি আমার মনে পড়লো। হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমাকে এমন রাজ্য দান করুন, যা আমি ছাড়া আর কারও ভাগ্যে না জোটে- (সূরা সাদ: ৩৫)।
অতঃপর আমি জ্বীনটিকে ব্যর্থ এবং লাঞ্ছিত করে ছেড়ে দিলাম। (সহিহ বুখারি: হাদিস ৩৪২৩)
এক্ষেত্রে আরও একটি হাদিস দেখতে পারি:
মি‘রাজ রজনীতে রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি জ্বীন দেখতে পেলেন। তার হাতে আগুনের লেলিহান শিখা ছিল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দিকে দেখলে মনে হত যেন সে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দিকে ছুটে আসছে। অতঃপর জিবরাঈল আলাইহিস সালাম প্রিয় নবীকে বললেন, আমি আপনাকে এমন কতকগুলো শব্দ শিক্ষা দিব কি যা পাঠ করলে এই জ্বীনের আগুন নিভে যাবে এবং সে উপুর হয়ে পড়ে যাবে? রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, নিশ্চয়ই শিক্ষা দিবেন। অতঃপর জিবরাঈল আলাইহিস সালাম বললেন, পড়ুন:
أَعُوذُ بِوَجْهِ اللهِ الْكَرِيمِ وَبِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ اللَّاتِي لَا يُجَاوِزُهُنَّ بَرٌّ وَلَا فَاجِرٌ مِنْ شَرِّ مَا يَنْزِلُ مِنْ السَّمَاءِ وَشَرِّ مَا يَعْرُجُ فِيهَا وَشَرِّ مَا ذَرَأَ فِي الْأَرْضِ وَشَرِّ مَا يَخْرُجُ مِنْهَا وَمِنْ فِتَنِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَمِنْ طَوَارِقِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ إِلَّا طَارِقًا يَطْرُقُ بِخَيْرٍ يَا رَحْمَنُ
আমি আসমান হতে আগত ও আসমানের দিকে ধাবিত বস্তুর অমঙ্গল হতে, মাটিতে সৃষ্ট ও মাটি হতে বহির্গত বস্তুর অমঙ্গল হতে, রাত্র-দিনের বালা-মুসিবত হতে ও রাত্র-দিনের ঘটনাপ্রবাহ হতে- তবে উত্তম ঘটনা হতে নয়- হে দয়াময়! (আমি) আল্লাহ্র সম্মানিত সত্তার ও তার সেই পূর্ণ কালেমা সমূহের আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যা পুণ্যবান ও পাপী কেহই অতিক্রম করতে পারে না। (সহিহ আহমাদ: ১৫৪৯৮)
সুতরাং আমরা জ্বীনের কাছে সাহায্য চাইবোনা বরং তাদের ক্ষতি থেকে আল্লাহ পাকের কাছে আশ্রয় চাইবো।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সুলাইমান আলাইহিস সালাম এর উপর জাদু এবং জ্বীনসাধনার অপবাদ নতুন কিছুনা। পূর্ববর্তী কিতাবধারীরাও এই অপবাদ দিত।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বিষয়টি পরিষ্কার করে কুরআনে বর্ণনা করেছেন
"এবং সুলাইমানের রাজত্বকালে শয়ত্বানরা যা পাঠ করত, তারা তা অনুসরণ করত, মূলতঃ সুলাইমান কুফরী করেনি বরং শয়ত্বানরাই কুফুরী করেছিল, তারা মানুষকে যাদু শিক্ষা দিত এবং যা বাবিলের দু’জন ফেরেশতা হারূত ও মারূতের উপর পৌঁছানো হয়েছিল এবং ফেরেশতাদ্বয় কাউকেও (তা) শিখাতো না যে পর্যন্ত না বলত, আমরা পরীক্ষা স্বরূপ, কাজেই তুমি কুফরী কর না, এতদসত্ত্বেও তারা উভয়ের নিকট হতে এমন জিনিস শিক্ষা করতো, যা দ্বারা তারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করতো, মূলতঃ তারা তাদের এ কাজ দ্বারা আল্লাহর বিনা হুকুমে কারও ক্ষতি করতে পারত না, বস্তুতঃ এরা এমন বিদ্যা শিখত, যদ্দ্বারা তাদের ক্ষতি সাধিত হত আর এদের কোন উপকার হত না এবং অবশ্যই তারা জানত যে, যে ব্যক্তি ঐ কাজ অবলম্বন করবে পরকালে তার কোনই অংশ থাকবে না, আর যার পরিবর্তে তারা স্বীয় আত্মাগুলোকে বিক্রয় করেছে, তা কতই না জঘন্য, যদি তারা জানত!" (সূরা আল বাকারাহ: ১০২)
সাধারনভাবে, জ্বীন কোনো বিশেষ স্বার্থ বা শয়তানি পরিকল্পনা ছাড়া কাউকে সাহায্য করে না।
যেখানে আমাদের রসূলুল্লহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায় কিরামগন কখনই জ্বীনদের সাহায্য কিংবা তাদের দিয়ে ঝাঁড়ফুক কিংবা তাবিজ কবজের বিষয়ে যাননি।
অনেক কবিরাজ মনে করেন উনারা জ্বীনদের অনুগত বানিয়ে কাজ করাচ্ছেন কিন্তু আসলে উনারাই শয়তানের অনুগত হয়ে যাচ্ছেন- এটা উনারা টের পাচ্ছেন না।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আমাদের শয়তানের আনুগত্য করতে নিষেধ করেছেন। এবং কুরআনে এই বিষয়ে এক ভয়াবহ সতর্কতা দিয়েছেন:
"যেদিন তাদের সবাইকে একত্রিত করা হবে, (সেদিন আল্লাহ বলবেন) হে জ্বীন সমাজ! তোমরা মানব সমাজের উপর খুব বাড়াবাড়ি করেছ। মানব সমাজের মধ্য থেকে তাদের বন্ধুরা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা পরস্পরে পরস্পরের নিকট হতে লাভবান হয়েছি আর আমরা আমাদের নির্ধারিত সময়ে পৌঁছে গেছি যা তুমি আমাদের জন্য নির্ধারিত করেছিলে। আল্লাহ বলবেন, জাহান্নামই হল তোমাদের বাসস্থান, তার মধ্যেই হবে তোমাদের চিরবাস, তবে আল্লাহ যদি অন্যরূপ ইচ্ছে করেন (তবে তাই হবে)। তোমার প্রতিপালক কুশলী এবং সর্বজ্ঞ।" (সূরা আনআম: ১২৮)
এবার ইকরাম থেমে তার পিতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আব্বু, আমাদের জন্যে সবচেয়ে নিরাপদ এবং বরকতময় হল সবরের সাথে রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম এবং সালাফদের দেখানো পথ অনুসরণ করা।”
আমরাও পরিপূর্ণ ইয়াকিনসহ যেন বলি এবং আমল করি—
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
আমরা কেবল তোমারই ‘ইবাদাত করি এবং কেবলমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। (সূরা ফাতিহা: ৫)