06/03/2025
সেনাবাহিনীতে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলেই বড় হয়েছি আমি। কারণ সেটাই আমাদের আসল কাজ—যুদ্ধের জন্য তৈরি থাকা আর যেখানে যখন দরকার, সেখানে যুদ্ধ করা। প্লেইন এন্ড সিম্পল। দেশের মাটিতে হোক বা বিদেশে, ইউএন পিসকিপিং মিশনে, যুদ্ধ তো করতেই হয়েছে। কিন্তু একটা মজার ব্যাপার হলো, যুদ্ধ যতটা শারীরিক মনে হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি মানসিক।
এই মানসিক যুদ্ধের আসল ব্যাপারটা পুরোপুরি দেখলাম প্রাইভেট সেক্টরে এসে। যুদ্ধের যত স্ট্র্যাটেজি আছে, তার প্রায় সবকটাই এখানে কাজে লাগে। প্রতিদিন নতুন চ্যালেঞ্জ, প্রতিদিন নতুন কৌশল। তখন মনে হলো, প্রাইভেট সেক্টরে আমাদের কোন যুদ্ধের বইটা পড়া দরকার?
The Art of War-এর সঙ্গে পরিচয় আমার "স্কুল অফ ইনফ্যান্ট্রি এন্ড ট্যাকটিস" এ। প্রায় ২৫ বছর আগে। একদিন কারও মুখে একটা লাইন শুনলাম—“যুদ্ধ জেতা হয় আসলে যুদ্ধের আগেই।” কথাটা শুনে মাথায় বাজ পড়ার মতো হলো। এটা তো শুধু যুদ্ধের জন্য না, লাইফের সব ক্ষেত্রেই সত্যি! তখনই বইটা পড়া শুরু করলাম, ভেবে যে এটা পুরনো মিলিটারি স্ট্র্যাটেজির ওপর লেখা। কিন্তু যত পড়লাম, তত বুঝলাম, The Art of War শুধু যুদ্ধ নিয়ে না—এটা জীবন, সিদ্ধান্ত নেওয়া, লিডারশিপ আর কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্টের ওপর এক অসাধারণ গাইডলাইন।
বইটা থেকে কিছু দারুণ শিক্ষা পেয়েছি, যা যে-কেউ কাজে লাগাতে পারে—হোক সে টিম লিডার, একজন স্টুডেন্ট, বা নিজের জীবনের কঠিন সময় পার করছে। তার মধ্যে সাতটা বিষয় আমাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে:
১. যুদ্ধ জেতা হয় প্রস্তুতির সময়েই
সান জু বারবার একটা কথাই বলেছেন—“যুদ্ধের ফলাফল আগেই নির্ধারিত হয়ে যায়।” মানে, প্রস্তুতি ছাড়া কিছুই সম্ভব না। আমি নিজেও অনেকবার ভাবতাম, “একটা ইন্টারভিউ, দেখা যাবে,” বা “এই ডিসকাশন সামলানো যাবে,” কিন্তু সান জু বলছেন—এভাবে কিছু হয় না। যে যত ভালো প্রস্তুতি নেয়, সে তত বেশি কন্ট্রোল রাখতে পারে। একবার আমার এক বস একই চিঠি ২১ বার ড্রাফ্ট করিয়েছিলেন। হয়তোবা এজন্যই এখন একটু আধটু লিখতে পারি।
২. সেরা যুদ্ধ হলো যেটা তোমাকে লড়তেই হয়নি
এটা শোনার পর আমার পুরো কনসেপ্ট বদলে গেল। এতদিন ভাবতাম, চ্যালেঞ্জের সামনে পড়ে গেলে লড়াই করাই আসল শক্তি। কিন্তু সান জু বলছেন, “সেরা জেনারেল সেই, যে যুদ্ধ ছাড়াই জিতে যায়।” মানে, স্মার্টনেস, ডিপ্লোম্যাসি, আর স্ট্র্যাটেজি যদি ঠিক থাকে, তাহলে অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ এড়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ। এটা অফিস পলিটিক্স থেকে শুরু করে পার্সোনাল লাইফ, সবখানেই সত্যি। অফিসে যেকোনো পরিস্থিতি ঘটার আগেই সামাল দেওয়াটাই মুন্সিয়ানার লক্ষণ।
৩. নিজেকে জানো, প্রতিপক্ষকে জানো
সান জুর একটা বিখ্যাত উক্তি—“যদি তুমি নিজের আর শত্রুর শক্তি-দুর্বলতা জানো, তাহলে শত যুদ্ধেও হারবে না।” এটা আমার জীবনে অনেকবার প্রমাণিত হয়েছে। অনেক সময় আমরা নিজেদের ক্যাপাবিলিটি বুঝতে পারি না, আবার প্রতিপক্ষ বা সমস্যার আসল চেহারাটাও ধরতে পারি না। অথচ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—নিজের সীমাবদ্ধতা আর শক্তি জানা, সাথে বিপক্ষের অবস্থান বোঝা। যেমন, স্বাতী ভাবে পৃথিবীর সবাই আমাকে ঠকায়। এটা আমার একটা সীমাবদ্ধতা।
৪. বিদ্যুৎ গতিতে পাল্টাও, পরিস্থিতির সাথে বদলাতে শেখো
সান জু বলেন, শক্ত লোহা হয়ে থাকার দরকার নেই, বরং হতে হবে পানির মতো—যেখানে বাধা আসবে, সেখান দিয়ে বয়ে যেতে হবে। অনেক সময় আমরা একটা প্ল্যানে এতটাই আটকে থাকি যে, পরিবর্তন দরকার হলেও মানতে পারি না। অথচ লাইফের আসল বিজয়ীরা তারাই, যারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। স্বাতীর ইভাল্যুয়েশন: আমি নাকি গিরগিটি!
৫. যখন শক্তিশালী, তখন দুর্বল দেখাও; যখন দুর্বল, তখন শক্তিশালী দেখাও
এটা বইয়ের চমৎকার স্মার্ট একটা শিক্ষা। অনেক সময় নিজেকে দুর্বল দেখানোই বেস্ট স্ট্র্যাটেজি—যাতে অন্যরা তোমাকে অবমূল্যায়ন করে, আর তোমার আসল পরিকল্পনা বুঝতে না পারে। আবার কখনো নিজেকে শক্তিশালী দেখানো দরকার, যাতে তোমার প্রতিপক্ষ ভয় পায়। এটা লিডারশিপ, নেগোশিয়েশন, এমনকি পার্সোনাল লাইফেও কাজে লাগে।
৬. ইমোশন কন্ট্রোল করতে না পারলে, তুমি হেরে গেছ
সান জু স্পষ্ট বলছেন—ক্রোধ, ভয় বা অহংকার যদি তোমার সিদ্ধান্তকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে তুমি যুদ্ধের আগেই হেরে গেছ। এটা শুনে নিজের কিছু বাজে সিদ্ধান্তের কথা মনে পড়লো—যেগুলো ইমোশন দিয়ে চালিত হয়ে নিয়েছিলাম, আর পরে আফসোস করেছি। লাইফে একধাপ এগোতে হলে, ইমোশনকে বশে আনতেই হবে।
৭. লিডার একা কিছুই না, টিমই আসল শক্তি
শেষ যে শিক্ষাটা আমাকে সবচেয়ে বেশি ভাবিয়েছে, সেটা হলো—একজন ভালো লিডার মানেই সে একা জিনিয়াস না, বরং সে এমন একজন, যে তার টিমের সেরাটা বের করে আনতে পারে। যদি কোনো টিম খারাপ পারফর্ম করে, তাহলে প্রথমে লিডারের দিকেই তাকানো উচিত। এটা শুধুমাত্র ওয়ার্কপ্লেস না, ফ্যামিলি বা ফ্রেন্ড সার্কেলেও সত্যি। আমার টিমের প্রতি আমার একটাই কথা, কাজের ক্রেডিট তোমার, আর সঠিক ইনটেনশন নিয়ে কাজটা করতে গিয়ে ঘাপলা হলে দায়-দায়িত্ব আমার।
এই সাতটা লেসন শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য না, লাইফের সব জায়গায় কাজে লাগানো যায়। যুদ্ধ মানেই শুধু আর্মস আম্যুনেশন নিয়ে নামা না, বরং স্ট্র্যাটেজি, ধৈর্য আর বুদ্ধিমত্তার খেলা। The Art of War আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে—কখন যুদ্ধ করতে হবে, আর কখন সেটা এড়িয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
তবে আমার বন্ধুদের মতামত হচ্ছে, সামরিক বাহিনীতে থাকার সময় আমার চেহারা, আচরণ, কার্যকলাপ ইত্যাদি সনাতন সামরিক স্টাইলে মিলতো না বলে যুদ্ধের আগেই ডিসেপশন বলয় নিয়ে সন্ধিহান থাকত তারা। স্বাতীরও একই ধারণা। এই ব্যাপারটা এখনো বের করতে পারিনি আমি। তাদের কথা, আমার চেহারার সাথে নাকি একশন মেলেনা। এটাই নাকি সবচেয়ে বড় ডিসেপশন।
(কমেন্টে অন্যান্য লেখা)
🤍