08/12/2025
বিএমইউতে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স রিপোর্ট প্রকাশ
৪৬ হাজারের বেশি নমুনা বিশ্লেষণ, বহু গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিকে উচ্চমাত্রার রেজিস্ট্যান্স
বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (বিএমইউ)তে গত এক বছরে মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনোলজি বিভাগের উদ্যোগে বিভিন্ন রোগীর ৪৬ হাজার ২৭৯টি নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাকের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিকের দীর্ঘদিনের অযৌক্তিক ব্যবহার—বিশেষ করে সিপ্রোফ্লোক্সাসিন, অ্যামোক্সিসিলিন, সেফট্রিয়াক্সোন, জেনটামাইসিন, মেরোপেনেম, টিগেসাইসিলিনসহ বহু ওষুধ—এখন বহু ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে পড়ছে। রোগীর দেহে রেজিস্ট্যান্স তৈরি হওয়ায় এসব ওষুধ কাজ করছে না, চিকিৎসা দীর্ঘায়িত হচ্ছে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটছে।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স হলো যখন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক বা পরজীবীর মতো অণুজীবগুলো অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ দ্বারা আর মারা যায় না বা তাদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় না। ফলে সংক্রমণ নিরাময় কঠিন হয়ে পড়ে। ভুল ব্যবহার, অতিরিক্ত ব্যবহার বা অসম্পূর্ণ ডোজের কারণে অণুজীবগুলো ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠে এবং সাধারণ সংক্রমণও প্রাণঘাতী হয়ে যেতে পারে।
বিশ্ব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সচেতনতা সপ্তাহ–২০২৫ উপলক্ষে আজ সোমবার (৮ ডিসেম্বর ২০২৫) বিএমইউতে আয়োজিত অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স রিপোর্ট ২০২৪–২০২৫ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
এ বছরের স্লোগান ছিল—‘এখনই পদক্ষেপ নিন, আমাদের বর্তমানকে রক্ষা করুন, আমাদের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করুন।’
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বিএমইউর মাননীয় ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মোঃ শাহিনুল আলম। সভাপতিত্ব করেন মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবু নাসের ইবনে সাত্তার।
‘আবারও মানবজাতি ব্যাকটেরিয়ার কাছে পরাস্ত হতে পারে’
অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তায় মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) অধ্যাপক ডা. মোঃ সায়েদুর রহমান বলেন, এক সময় মানুষের হাতে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবায়োটিক না থাকায় ব্যাকটেরিয়ার কাছে পরাস্ত হতে হতো। আগামী ১০–১৫ বছরের মধ্যে মানবজাতি আবারও সেই সংকটে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে; তবে এবার ওষুধ থাকবে, কিন্তু সেগুলো কার্যকর হবে না। তাই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সকে এখন বিশ্বব্যাপী ‘এক মহা বিপর্যয়’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
‘সমস্যা যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের, সমাধানের দায়িত্বও বিশ্ববিদ্যালয়ের’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মাননীয় ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মোঃ শাহিনুল আলম বলেন, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মোকাবিলায় গবেষণা, গাইডলাইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নেতৃত্ব নিতে হবে। তিনি বলেন, যে সমস্যাকে অসমাধানযোগ্য মনে হয়, সেটির সমাধানের পথ খুঁজে বের করাও বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব।
প্রো–ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মোঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এখনই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ কার্যকর করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. আবু নাসের ইবনে সাত্তার বলেন, অযথা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, নিজে নিজে ওষুধ খাওয়া, অসম্পূর্ণ ডোজ এবং প্রাণিসম্পদে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার—এসব কারণে অণুজীবগুলো দ্রুত প্রতিরোধী হয়ে যাচ্ছে। ফলে চিকিৎসা জটিল হচ্ছে, চিকিৎসার খরচ বাড়ছে, আইসিইউ ভর্তি ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে।
তিনি বলেন, হাত ধোয়া, টিকাদান, নিরাপদ খাদ্য, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা ও যথাযথ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই এএমআর প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখা যায়।
প্রতিবেদনটির বৈজ্ঞানিক ফলাফল তুলে ধরেন ডা. শাহেদা আনোয়ার
মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহেদা আনোয়ার জানান, নিয়মিত প্রশিক্ষণ, মনিটরিং, ইকিউএএস অংশগ্রহণ ও কঠোর ইন্টারনাল কোয়ালিটি কন্ট্রোলের মাধ্যমে ডেটার গুণগত মান নিশ্চিত করা হয়েছে।
বিশ্লেষণের মূল পরিসংখ্যান
মোট নমুনা: ৪৬,২৭৯
কালচার পজিটিভ: ১১,১০৮ (২৪ শতাংশ)
সর্বাধিক নমুনা: প্রস্রাব
প্রধান প্যাথোজেন (প্রস্রাব): E. coli
প্রধান প্যাথোজেন (রক্ত): Salmonella Typhi
উল্লেখযোগ্য রেজিস্ট্যান্স পর্যবেক্ষণ
Salmonella Typhi: ciprofloxacin–এর প্রতি সর্বোচ্চ রেজিস্ট্যান্স; chloramphenicol ও TMP–SMX তুলনামূলক কার্যকর।
কিছু আইসোলেটে ceftriaxone রেজিস্ট্যান্স, যা ক্লোনাল বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
E. coli: ciprofloxacin ও amoxicillin–এর প্রতি উচ্চ রেজিস্ট্যান্স; meropenem ও tigecycline এখনও কার্যকর।
Klebsiella spp.: ceftriaxone, gentamicin ও ciprofloxacin–এর রেজিস্ট্যান্স মাঝারি–উচ্চমাত্রায়।
Acinetobacter spp.: প্রায় সব অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধেই উচ্চ রেজিস্ট্যান্স; meropenem ও tigecycline–এও রেজিস্ট্যান্স বাড়ছে।
২০২২–২৫ ট্রেন্ড: MRSA ও প্রস্রাবের ESBL উৎপাদক E. coli কিছুটা কমলেও carbapenemase-producing E. coli, Klebsiella, Acinetobacter ও Pseudomonas–এ রেজিস্ট্যান্স উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।
ক্যান্ডিডেমিয়া: Candida tropicalis ও Candida albicans বেশি পাওয়া গেছে; বহু প্রজাতিতে fluconazole রেজিস্ট্যান্স বেশি।
অন্যান্য বক্তব্য ও উপস্থিতি
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ডিন অধ্যাপক ডা. মোঃ ইব্রাহীম সিদ্দিক, ডিন অধ্যাপক ডা. মোঃ আতিয়ার রহমান, ডিন ডা. সাখাওয়াত হোসেন সায়ন্ত, নবজাতক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোঃ আব্দুল মান্নান, শিশু হেমাটোলজি অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোঃ আনোয়ারুল করিম, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আয়েশা খাতুন, গাইনোকোলজিক্যাল অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস, ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোঃ সাইফুল ইসলাম, বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নায়লা আতিক খান, ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. ইলোরা শারমিন, অধ্যাপক ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস, অর্থোপেডিক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম, হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইরতেকা রহমান, সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহেদা আনোয়ার, সহযোগী অধ্যাপক ডা. চন্দন কুমার রায়, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. ফারজানা ইসলাম প্রমুখ।
রিপোর্ট প্রস্তুত ও তথ্যসংগ্রহে বিভাগের এমডি রেসিডেন্ট ও ল্যাব টেকনোলজিস্টরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। অনুষ্ঠানে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বিষয়ক পোস্টার প্রেজেন্টেশন প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হয়।