
12/07/2025
নোট # ৪৩
শিশুর বিকাশে এক্সট্রাকারিকুলার এক্টিভিটি
সাম্প্রতিক সময়ে বয়ঃসন্ধিক্ষণে থাকা এক স্কুলছাত্রী তার বাবা মায়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন আমাদের দেশে। অবাক হইনি তবে কষ্ট পেয়েছি, আহত হয়েছি। ভাবছি, এমনটা কেন করল..!?
একজন বাবা বা মায়ের জন্য এর চেয়ে বেদনার আর কি থাকতে পারে তা আমার জানা নেই। এই মেয়ে মামলা করার টাকা কোথায় পেল? এমন সাহসই বা কোথায় পেল! তার পেছনে কে বা কারা থাকতে পারে!? এলোমেলো এমন নানা প্রশ্নের ভিড়ে উত্তর খুঁজছি।
বাবা মায়ের আচরণ ও পরিবারের ভূমিকা শিশুদের সার্বিক বিকাশকে প্রভাবিত করে। সমাজ যেমন কিছু আচরণ আমাদের ওপর অর্পণ করে, তেমনি ব্যক্তিও কিছু আচরণ অর্পণ করে থাকে। আমাদের সমাজে পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব সম্পূর্ণরূপে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত বা ঐচ্ছিক হয়। তারপরও সামাজিক ও পারিবারিক চাপেও সন্তান গ্রহণ করেন কেউ কেউ।
শিশুদের জন্য বাবা মা দু'জনই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দায়িত্ব পালন করেন। সন্তানের প্রতি তাদের ভালোবাসা অকৃত্রিম। প্রতিটি বাবা মা শিশুকে ভরণপোষণ থেকে শুরু করে যাবতীয় নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে যে এর ব্যতিক্রম ঘটে না তা নয়। তাহলে এত কিছু করার পরও কেন শিশু বিপথে যায়... বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিক্ষণে!?
বয়ঃসন্ধির বয়সটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের একেক বয়সের সময়সীমায় আচরণ ও উন্নতিমূলক কাজগুলো একেক ভাবে হয়ে থাকে। এ সময়ে সন্তানেরা এক ধরণের আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগে। শরীরে নানা দৈহিক পরিবর্তনের সাথে সাথে মানসিক ও আচরণগত পরিবর্বতন হয়। পূর্বের চেয়ে এ সময়ে নানা ধরণের হরমোনের প্রভাব তো রয়েছেই। এ সময়ে তারা পরিবারের চেয়ে অন্যের কথায় প্রভাবিত হয় বেশি। একা একা থাকতে পছন্দ করে। সবসময় নিজের ভেতর এক ধরণের ফ্যান্টাসি ও অলীক চিন্তাধারার জগতে বিচরণ করে।
খুব ছোটবেলায় একটি শিশুর প্রথম শিক্ষক হয় তার পরিবার, বিশেষ করে বাবা মা। দ্বিতীয়তঃ তার স্কুল, তৃতীয়তঃ তার খেলার মাঠ। শিশুর শিক্ষাটা হয় অবজারভেশন বা পর্যবেক্ষণ মেথডে। শিশু তাই শেখে যা সে দেখে, সেটা ভাল বা মন্দ যাই হোক না কেন। শিশুদের জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার ব্যবস্থা যেমন করা প্রয়োজন, তেমনি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক সংগঠনে যোগ দেয়া ছাড়াও নানাবিধ সৃজনশীল কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের জন্যও তাকে উৎসাহ দেয়া জরুরী। অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার মনোবৃত্তি, অন্যের প্রতি সহনশীল আচরণ করা... এগুলোও তার পর্যবেক্ষণনির্ভর একটি শিক্ষণ পদ্ধতি। শিশুর নিজের ছোট ছোট কিছু দায়িত্ব তার ওপরই অর্পণ করা বা তার নিজের বাড়ীর কাজগুলো নিজেকেই করতে দেয়া উচিত। এগুলো তাকে বলা ও শেখানো বাবা, মা ও পরিবারের সদস্যদের দায়িত্বের ভেতরই পড়ে।
শিশুর সামাজিকীকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুকে সকলের সাথে মিলেমিশে বড় করে সভ্য মানুষ হিসাবে তৈরি করা, ভুল ও শুদ্ধের পার্থক্য বোঝানো, তারা কোথায় কি করে, কার বা কাদের সাথে মেশে, এসব খেয়াল করাও পিতামাতার দায়িত্ব কতর্ব্যের ভেতর পড়ে। শিশুর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে অফলাইনের খেলাধুলার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অনলাইন খেলাধুলার চেয়ে অফলাইন খেলাধুলা বেশী কার্যকর। এতে তার দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, আচরণগত উন্নতি ও বিকাশ ঘটে। বাবা মায়ের আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্য থাকাটা জরুরী। শিশু একটু বড় হলে পজেটিভ ওয়েতে বোঝানো উচিত যে, বাবা মায়েরও যে কোন কাজ করার ক্ষমতার একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। শিশুকে তার ভালো কাজের জন্য কথার মাধ্যমে পুরষ্কৃত করা বাঞ্ছনীয়, ঠিক একইভাবে মন্দ কাজের জন্য তিরষ্কৃত না করে ভালো মন্দের পার্থক্য বোঝানো জরুরী।
অনেক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বয়স হওয়ার আগেই শিশুদের হাতের নাগালে এসে যাচ্ছে ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। অনলাইন বন্ধুত্ব ও বাজে সাইটগুলোতে তাদের অবাধ বিচরণ দেখা যায়। সন্তানের বিপথগামিতা অনেক সময় বাবা মায়েরা নোটিশ করেন না বা করলেও অনেকে আমলে নেন না, ভাবেন এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। বাচ্চার আচরণ পর্যবেক্ষণ করার মত সময়ও অনেকের থাকে না। আর ততদিনে বাচ্চাকে কিছু বলতে গেলে বাচ্চা নিজেই তেড়ে ওঠে। বাবা মায়েরা এক ধরণের জিম্মি হয়ে পড়েন। শিশু শুরু করে নাওয়া খাওয়া বন্ধের অসহযোগিতা, আর অসহায় বাবা মা ব্যস্ত হন আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, তথা সমাজ থেকে এ ধরণের আচরণ লুকিয়ে রাখতে...!
পরিবার নিয়ে নানা গবেষণা হয়েছে বহু বছর ধরে, এখনও গবেষণা চলেছে। প্যারেন্ট বিহেভিয়ার স্কেল তৈরী হয়েছে। তাই আমরা জানি অনেক ধরণের পরিবার আমাদের এ সমাজে বিরাজমান। তার ভেতর ডিকটেটরিয়াল পলিসি বা একনায়কতন্ত্রিক পরিবার, রিজেকটিভ বিহেভিয়ার পরিবার, নেগলেক্টিং পরিবার, হোস্টাইল বা আক্রমণাত্মক পরিবার, ওভার প্রোটেকটিভ বা অতি রক্ষণশীল পরিবার, গণতান্ত্রিক পরিবার, ল্যাক অভ ট্রাস্ট পরিবার, ডমিনেটিং পরিবার, হারমনিয়াস ওয়েল এডজাস্টেড পরিবার, অনেকগুলো ইস্যু এখানে বিরাজমান।
অনেক পরিবারেই সন্তানের সাথে পিতামাতার আত্মিক কোন সম্পর্কই গড়ে ওঠে না। অতি রক্ষণশীল ও প্রত্যাখ্যাত শিশুরা অপরাধপ্রবণ হয় বেশী। যে বাড়িতে শিশুর আবেগের বিকাশ সঠিকভাবে হয়, শিশু নির্দ্বিধায় নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে, স্নেহ ও নিরাপত্তাসহ জীবনে চলার জন্য সঠিক পথনির্দেশনা দেয়া হয়, বাবা মায়ের নিয়মশৃংখলাপূর্ণ ও বন্ধুত্বমূলক আচরণ, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সততার চর্চা থাকে, এসবের ওপর নির্ভর করে শিশুর উন্নত ও গ্রহণযোগ্য আচরণ।
অতিরিক্ত শাসন যেমন ক্ষতিকর তেমনি অতিরিক্ত প্রশ্রয়ও শিশুর জন্য ক্ষতিকর। শিশুর প্রতি প্রত্যাখ্যানমূলক আচরণ, নির্বিকার বোধ ও আক্রমণাত্মক আচরণ শিশুকে অপরাধী করে তুলতে পারে।
অপরাধপ্রবণ শিশুরা সাধারণতঃ বেশ বেপরোয়া হয়, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, নিজেকে অসহায় ভাবে ও ব্যর্থতায় পরাজয়ের গ্লানিতে ভোগে। সে নিজে আক্রমণাত্মক মনোভাবের হয়। আবার অনেক সময় অর্থনৈতিক কারণে যেমন বাবা মায়ের আর্থিক সামর্থ্যের আধিক্য বা কম অর্থ, জনবহুল পরিবেশ, উপযুক্ত শিক্ষার ঘাটতি, পারিবারিক অশান্তি ও বাবা মায়ের দৃষ্টিভঙ্গীর জন্যও শিশু বিপথে চলে যেতে পারে। আবার অনেক শিশু অন্যায় করেও পার পেয়ে যায়। বাবা মারাই এই ছোট ছোট অন্যায়গুলোকে প্রশ্রয় দেন। তাতে শিশুর সাহস আরও বেড়ে যায়। পরবর্তীতে অন্যায়ের মাত্রাও বাড়তে থাকে।
শিশুদের ভেতর উন্নাসিকতা, অভদ্রতাজনিত আচরণ, অন্যের সাথে দুর্ব্যবহার, অন্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, কারণে অকারণে নিজে যা জানে ও বোঝে তাকেই সঠিক ভাবা ও যেনতেনভাবে সেটাই প্রতিষ্ঠিত করা, কিছু পাওয়ার জন্য ব্ল্যাকমেইলিং এর আশ্রয় নেয়া, চাওয়ামাত্রই কিছু পাওয়ার দাবী করা, অন্যের আমানত খেয়ানত করা, নিজেকে সবচেয়ে বড় কিছু ভাবা, অঢেল অর্থ খরচ করতে চাওয়ার প্রবণতা, সমাজে এসব দেখলেই সচেতন হন। তা না হলে দুঃখজনকভাবে আপনার ঘরে জন্ম নিতে পারে একেক জন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন...!