12/10/2025
একজন ভুলে যাওয়া দর্জির গল্প — এক অসম্পূর্ণ স্বপ্নের সেলাই
সালটা ছিল ২০১৭।
আমি তাবলিগ জামাতে বের হয়েছি, জায়গা — বাগেরহাট।
আমির সাহেব বললেন,
“ভাই, তালীমের গাস্তের জন্য বের হোন।চেষ্টা করুন সবাই ভাইকে বাজারে গিয়ে তালিমের দাওয়াত দিন, কাউকে দাওয়াত দিয়ে সাথে করে আনবেন।”
এক সাথি নিয়ে আমি বের হয়ে গেলাম।
কোর্ট মসজিদের পাশের এক মার্কেটে সেলাইয়ের দোকানে ঢুকলাম।
দর্জি ভাই একা বসে কাপড় কাটছিলেন।
আমি সালাম দিলাম,
কিছুক্ষণ আলাপ করলাম,
তারপর আস্তে বললাম —
“ভাই, একটু সময় পেলে আসুন না, মসজিদে বসে আল্লাহর কথা শুনবেন।”
লোকটা তাকিয়ে রইল আমার চোখের দিকে —
চোখদুটো লাল, জলভরা, কিন্তু মুখে কোনো শব্দ নেই।
কিছুক্ষণ পর কাঁপা গলায় বলল —
“ভাই, আমরাও তো মানুষ।
মন চায় সংসার করতে, একটা বউ থাকুক, বাচ্চা ডাকুক ‘আব্বু’।
কিন্তু আমি পারিনি… বিয়েই হয়নি।
৪০ বছর পেরিয়ে গেল, বন্ধুরা সবাই সংসার করছে।
কেউ বাজারে গেলে তাদের বউরা ফোন দেয়, আমি ফিরলে কেউ জিজ্ঞেসও করে না।”
চুপচাপ শুনছিলাম।
তারপর বলল —
“লোকজন হাসে, ‘দর্জি ভাই, তোমার তো কাপড়ের মাপ নিতে নিতে বউয়ের মাপও হারায় গেছে!’
হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিই, কিন্তু ভেতরে পুড়ি।
নামাজেও মন বসে না।
কেন জানি মনে হয়, আল্লাহ হয়তো আমার মতো মানুষকে ভুলে গেছেন।”
সেদিন আমি কথা হারিয়ে ফেলেছিলাম।
একটা নীরব কান্না, একটা অপূর্ণ জীবন — যেন সেলাইয়ের ফাঁকে ফাঁকে রক্ত ঝরছিল।
আমি ফিরেছিলাম মসজিদে,
কিন্তু সেই চোখদুটো সারারাত ভাসছিল সামনে।
সেই থেকে আমি ঠিক করি —
যারা নিঃসঙ্গ, যারা শারীরিক বা মানসিক সমস্যার কারণে ভালোবাসা হারিয়েছে,
তাদের পাশে থাকব।
আজ এত বছর পর যখন দেখি —
সেইরকম শত শত মানুষ চিকিৎসা নিয়ে আজ সংসার করছে,
বাচ্চা কোলের হাসি শুনছে,
স্ত্রীর মুখে তৃপ্তির চিহ্ন,
চেম্বারে মিষ্টি, দই, ফল, পায়েস, টাকা—হাদিয়া নিয়ে আসে,
বলতে ভুলে না —
“ডাক্তার ভাই, আপনি শুধু রোগ সারাননি, জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন।”
তখন মনে হয় —
একজন ডাক্তারের সাফল্য মানে শুধু রোগ সারানো নয়,
একটা ভাঙা আত্মাকে আবার বাঁচতে শেখানো।
এই গল্পটা কেবল এক দর্জির নয় —
এটা হাজারো একাকী পুরুষের গল্প,
যারা ভালোবাসা চায়, কিন্তু নিজের শরীর বা সমাজের কারণে পিছিয়ে যায়।
তাদের জন্যই আমি কাজ করি,
তাদের মুখের হাসিটাই আমার সবচেয়ে বড় জয়।
এমন কষ্টের কিছু স্মৃতি শেয়ার করতে পারেন।
কোন সালে অনেক কষ্টে ছিলেন?