17/11/2025
‘জিন বশ করা’ ও ‘জিনের সাহায্য নেওয়া’: আমরা কোন কবিরাজ ও মুদাব্বিরদেরকে ভণ্ড ও প্রতারক বলি?
সম্প্রতি অনেক দ্বীনি ভাই আমাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্ন করেছেন এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, আমরা কেন ‘মুদাব্বির’, ‘কবিরাজ’ বা ‘জিন হুজুর’ নামধারীদের ব্যাপারে ঢালাওভাবে কথা বলছি। আপনাদের এই গঠনমূলক প্রশ্নের জবাবে, আজ আমরা বিষয়টি পরিষ্কার করতে চাই।
আমরা লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশের অধিকাংশ কবিরাজ ও মুদাব্বির নিজেদেরকে হানাফী মাযহাবের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দেন। একারণেই, আজ আমরা অন্য কোনো মাযহাব বা মতাদর্শের আলোকে নয়, বরং সরাসরি হানাফী মাযহাবের বিশ্ববরেণ্য ও স্তম্ভস্বরূপ ইমামগণের অকাট্য বক্তব্যের আলোকেই বিষয়টি বিশ্লেষণ করব।
এর আরেকটি কারণ হলো, অনেক সময় হক কথা সামনে এলে, কিছু ব্যক্তি প্রতিপক্ষকে ‘আহলে হাদিস’ বা অন্য কোনো ট্যাগ লাগিয়ে মূল আলোচনাকে এড়িয়ে যেতে চায় এবং সত্যকে উপেক্ষা করার সুযোগ খোঁজে। আমরা সেই দরজাটিও সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিতে চাই।
আজ আমরা পরিষ্কার করব, আমরা মূলত কোন ধরনের ব্যক্তিদের কথা বলছি, তারা কারা, কেন তাদের নিকট চিকিৎসা গ্রহণ করা জায়েজ নয় এবং কেনই বা তারা হানাফী মাযহাবের ইমামদের দৃষ্টিতেই ভণ্ড ও প্রতারক।
প্রথম প্রশ্ন: ‘জিন বশ করার’ (تَسْخِيرُ الْجِنِّ) দাবিদারদের নিকট চিকিৎসা নেওয়া কি জায়েজ?
আমাদের জবাব: না, এটি সম্পূর্ণরূপে নাজায়েজ ও হারাম।
দলিল: আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (রহ.) ইমাম খাত্তাবী (রহ.)-এর সূত্রে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন:
وَمَا نُهِيَ عَنْهُ وَهُوَ رُقْيَةُ العَزَّامِينَ وَمَنْ يَدَّعِي تَسْخِيرَ الجِنِّ.
“(যে সকল রুকইয়াহ) নিষিদ্ধ (হারাম) করা হয়েছে, তা হলো— (কুফর-শিরকযুক্ত) মন্ত্র পাঠকারী ব্যক্তির রুকইয়াহ এবং যে ব্যক্তি জিন বশীভূতকরণ (تَسْخِيرَ الْجِنِّ) বা অধীনস্থকরণের দাবী করে তার রুকইয়াহ।”
(উমদাতুল ক্বারী: ২১/৩৯৪)
এই বক্তব্য থেকে যা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়:
১. ‘وَمَنْ يَدَّعِي تَسْخِيرَ الجِنِّ’ (এবং যে ব্যক্তি জিন বশীভূতকরণের দাবী করে):
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (রহ.)-এর এই কথাটি সকল বিতর্কের অবসান ঘটায়। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, যে ব্যক্তিই দাবি করবে যে সে জিনকে বশ করে, নিয়ন্ত্রণ করে বা নিজের অধীনস্থ করে কাজ করায়—তার রুকইয়াহ বা চিকিৎসা পদ্ধতি নিষিদ্ধ ও হারাম।
২. সুলাইমান (আঃ)-এর বিশেষত্ব:
জিন বশ করার ক্ষমতা ছিল শুধুমাত্র নবী সুলাইমান (আঃ)-এর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া একটি বিশেষ মু'জিযা। তিনি দোয়া করেছিলেন: "হে আমার রব... আমাকে এমন এক রাজত্ব দান করুন, যা আমার পরে আর কারো জন্য প্রযোজ্য হবে না।" (সূরা সোয়াদ: ৩৫)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে যখন সালাতের মধ্যে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী এক ইফরিত শয়তানকে ধরে ফেলেছিলেন, তখন তিনি তাকে বেঁধে রাখতে গিয়ে সুলাইমান (আঃ)-এর এই দোয়ার কথা স্মরণ করেন এবং তাকে ছেড়ে দেন (সহীহ বুখারী)। এই ঘটনা প্রমাণ করে, জিনকে অধীনস্থ করার দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে।
৩. আমাদের চূড়ান্ত বক্তব্য:
সুতরাং, যে ব্যক্তিই—চাই সে যত বড় মুফতি, মাওলানা বা মুহাদ্দিস হোক না কেন—জিনকে বশ করার বা নিজের অধীন করার দাবি করবে এবং অন্যকে জিন বশ করার তদবির শিক্ষা দিবে, সে কার্যত নিজেকে নবুয়তের একটি বৈশিষ্ট্যের অংশীদার বলে দাবি করছে, যা একটি ভয়ংকর মিথ্যাচার। আর এ কারণে সে একজন মিথ্যাবাদী ও প্রতারক। তার কাছে চিকিৎসা গ্রহণ করা মানে এমন এক ব্যক্তির নিকট চিকিৎসা সেবা নেওয়া, যার চিকিৎসা পদ্ধতির ভিত্তিটাই মূলত একটি মিথ্যা ও ভন্ডামিপূর্ণ দাবির উপর দাঁড়িয়ে আছে ।
দ্বিতীয় প্রশ্ন: ‘ভালো অথবা মুমিন, মুসলমান জিনের সাহায্য’ নিয়ে চিকিৎসা করা কি জায়েজ?
আমাদের জবাব: না, এটিও সম্পূর্ণরূপে নাজায়েজ ও হারাম।
দলিল: আল্লামা মোল্লা আলী কারী (রহ.) ‘বাতিল রুকইয়াহ’ বা অবৈধ ঝাড়ফুঁকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন:
..مَنْ يَأْكُلُ بِرُقْيَةٍ بَاطِلٍ كَذِكْرِ الْكَوَاكِبِ وَالِاسْتِعَانَةِ بِهَا وَبِالْجِنِّ.
“...মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে, যে বাতিল রুকইয়ার মাধ্যমে উপার্জন করে; যেমন তারকাদের নাম উল্লেখ করা এবং সেগুলোর ও জিনের সাহায্য নেওয়া।”
এই বক্তব্য থেকে যা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়:
১. ‘وَالِاسْتِعَانَةِ... بِالْجِنِّ’ (এবং জিনের সাহায্য নেওয়া):
ইমাম মোল্লা আলী কারী (রহ.) এখানে কোনো প্রকার রাখঢাক ছাড়াই বলেছেন, জিনের সাহায্য নেওয়া (ইস্তি'আনাহ বিল জিন) বাতিল রুকইয়াহর অন্তর্ভুক্ত। তিনি এখানে ‘ভালো জিন’ বা ‘খারাপ জিন’—কোনো প্রকার পার্থক্য করেননি। তিনি সাধারণভাবে ‘আল-জিন’ (الجن) শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যা সকল প্রকার জিনকেই অন্তর্ভুক্ত করে।
২. কেন জিনের সাহায্য নেওয়া হারাম?
প্রতারণার দরজা উন্মুক্তকরণ:
কোনো জিন এসে যদি নিজেকে ‘ভালো অথবা মুমিন মুসলমান’ বলে দাবি করে, তবে তা স্বচক্ষে দেখে, এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে বিশ্বাস করার কোনো উপায় আমাদের কাছে নেই। শয়তান জিনেরা স্বভাবগতভাবেই মিথ্যুক ও প্রতারক। শয়তান খুব সহজেই একজন ‘ভালো জিনের’ বেশ ধরে এসে একজন আলেম বা সাধারণ মানুষকে শিরকের পথে নিয়ে যেতে পারে।
এর সবচেয়ে বড় দলিল হলো আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত যাকাতের মাল পাহারা দেওয়ার বিখ্যাত হাদিসটি। সেখানে শয়তান একজন অত্যন্ত দরিদ্র ও অসহায় ব্যক্তির রূপ ধরে এসে আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর দয়ার সুযোগ নিয়ে পরপর দুইবার চুরি করতে এসে ধরা পড়ে এবং মিথ্যা বলে ছাড়া পায়। তৃতীয়বার ধরা পড়ার পর সে নিজেকে বাঁচানোর জন্য ‘আয়াতুল কুরসি’ পাঠ করার ফযিলত শিখিয়ে দেয়। যদিও তার শেখানো কথাটি (আয়াতুল কুরসির ফযিলত) সত্য ছিলযা রাসূল (ﷺ) সত্যায়ন করেছিলেন , রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
«أَمَا إِنَّهُ قَدْ صَدَقَكَ وَهُوَ كَذُوبٌ، تَعْلَمُ مَنْ تُخَاطِبُ مُنْذُ ثَلاَثِ لَيَالٍ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ؟» قَالَ: لاَ. قَالَ: «ذَاكَ شَيْطَانٌ»
“জেনে রেখো, সে তোমাকে সত্য বলেছে, যদিও সে চরম মিথ্যুক। হে আবু হুরায়রা, তুমি কি জানো, তিন রাত ধরে তুমি কার সাথে কথা বলছিলে?” আবু হুরায়রা (রাঃ) বললেন, ‘না’। তিনি বললেন, “সে ছিল শয়তান।”
(সহীহ বুখারী)
এবার আসুন মূল প্রশ্নে, যা সকল ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দেবে:
একবার ভাবুন, আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর মতো একজন মহান সাহাবীও শয়তানের পাতা ফাঁদে প্রায় পড়েই গিয়েছিলেন। শয়তান যখন একজন অসহায় মানুষের রূপ ধরে এসে ‘আয়াতুল কুরসি’র ফযিলতের মতো একটি সত্য কথা শেখালো, তখন তিনিও ধোঁকা খেয়ে গিয়েছিলেন। যদি না স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ওহীর মাধ্যমে তাকে সতর্ক করে দিতেন, তাহলে তিনিও হয়তো সেই শয়তানকে একজন ভালো মানুষই ভেবে নিতেন।
চিন্তার বিষয় হলো: এখন তো রাসূল (ﷺ) নেই, ওহীর দরজাও বন্ধ।
তাহলে আজকের এই ‘মুদাব্বির’ ও ‘কবিরাজরা’ কোন ক্ষমতাবলে এত নিশ্চিত হয়ে যান যে, তাদের সাহায্যকারী জিনটি আসলেই একজন ‘ভালো মুসলিম’? কে তাদের কাছে এসে এই অদৃশ্য জগতের বাসিন্দাদের চরিত্র সম্পর্কে রিপোর্ট দিয়ে যায়? জিনদেরকে ‘ভালো’ ও ‘খারাপ’ হিসেবে আলাদা করার এই বিশেষ ‘ওহী’ তারা কোথা থেকে পায়?
সালাফদের কর্মপন্থা:
রাসূল (ﷺ), সাহাবায়ে কেরাম বা কোনো তাবেঈ কখনো চিকিৎসার জন্য জিনের সাহায্য নিয়েছেন—এমন কোনো সহীহ দলিল নেই। বরং, তারা আল্লাহর কালাম ও দোয়া তথা রুকইয়াহ শারইয়াহর মাধ্যমেই জিনের আছর ,জাদুগ্রস্থ হওয়া, বদনজর ও হিংসার শিকার হওয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট এ সকল অদৃশ্য রোগ ও সমস্যার চিকিৎসা করেছেন।
অদৃশ্য শক্তির উপর নির্ভরশীলতার ভয়াবহ পরিণতি:
জিনের মতো অদৃশ্য শক্তির উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণেই আজ কিছু ‘মুদাব্বির’ ও ‘কবিরাজ’ প্রকাশ্যে বলার দুঃসাহস দেখাচ্ছে যে, শুধুমাত্র কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে রুকইয়াহ শারইয়াহর মাধ্যমে নাকি সুস্থ হওয়া যায় না! (নাউযুবিল্লাহ)। তাদের মতে, পূর্ণাঙ্গ সুস্থতা পেতে হলে এমন কবিরাজদের কাছেই যেতে হবে, যারা জিন জবাই করতে পারে, বোতলে বন্দী করতে পারে বা তাবিজ-কবজ দিতে পারে! দেখুন, জিনের সাহায্য নেওয়ার এই দরজা কীভাবে মানুষকে আল্লাহর কালামের উপরই অবিশ্বাসী করে তুলেছে!
৩. আমাদের চূড়ান্ত বক্তব্য:
সুতরাং, যে ব্যক্তি দাবি করে যে সে "ভালো অথবা মুমিন মুসলমান জিনের" সাহায্য নিয়ে চিকিৎসা করে, সে আল্লামা মোল্লা আলী কারী (রহ.)-এর ফতোয়া অনুযায়ী একটি বাতিল ও অবৈধ পন্থার অনুসরণ করছে। তার কাছে চিকিৎসা গ্রহণ করা মানে একটি বাতিল পদ্ধতিতে নিজেকে সঁপে দেওয়া, যা শরীয়তে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
হানাফী মাযহাবের এই দুজন মহান ইমামের বক্তব্য থেকে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়েছে যে, নিম্নোক্ত দুটি কাজ সম্পূর্ণরূপে হারাম ও বাতিল:
১. জিনকে বশ করার (تَسْخِيرُ الْجِنِّ) মিথ্যা দাবি করা।
২. মুমিন, মুসলমান ‘ভালো’ বা ‘খারাপ’—যেকোনো প্রকার জিনের সাহায্য (الِاسْتِعَانَةُ بِالْجِنِّ) নেওয়া।
সুতরাং, যদি কোনো ‘মুদাব্বির’, ‘কবিরাজ’ বা ‘জিন হুজুরের’ মধ্যে এই দুটি বিষয়ের কোনো একটিও পাওয়া যায়, তবে হানাফী মাযহাবের এই মহান ইমামগণের ফতোয়া অনুসারেই তাদের নিকট থেকে চিকিৎসা নেওয়া সম্পূর্ণরূপে নাজায়েজ এবং হারাম। এবং তারাই হলো সুস্পষ্টভাবে ভণ্ড ও প্রতারক।
এখন চাই সেই কবিরাজ বা মুদাব্বির যত বড়ই হাফেজ, মাওলানা, মুফতি ও মুহাদ্দিস হোক না কেন, তাতে কিছুই যায় আসে না। কারণ, ব্যক্তির পদবি বা লেবাস নয়, বরং কোরআন-সুন্নাহ এবং সালাফদের মূলনীতিই হলো হক ও বাতিলের চূড়ান্ত মাপকাঠি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই সুস্পষ্ট মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে সত্যকে চেনার এবং সকল প্রকার প্রতারণা থেকে নিজেদের ঈমানকে হেফাজত করার তাওফিক দিন। আমীন।
লেখা : আব্দুল মালেক ভাই