29/05/2022
সিবিসি (CBC) টেস্ট কী এবং কেন করা হয়?
অসুস্থতা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গেলে রোগের লক্ষণ ও ধরন বুঝে চিকিৎসক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে থাকেন। সেই ব্যবস্থাপত্রে অন্যান্য পরীক্ষার পাশাপাশি একটি পরীক্ষার নাম প্রায়ই দেখা যায়। এমনকি কখনো কখনো তালিকার শুরুতেই থাকে। সেটি হলো, সিবিসি, মানে কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট।
সিবিসি কী?
সিবিসি একটি সামগ্রিক রক্ত পরীক্ষা। চিকিৎসকেরা এর মাধ্যমে একটি সাধারণ ধারণা পেয়ে থাকেন।
রোগীর শরীর কোনো সংক্রমণের শিকার হয়েছে কি না,
রক্তকণিকা স্বাভাবিক আছে কি না,
হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কেমন; প্রভৃতি বুঝতে এই পরীক্ষাটি গুরুত্বপূর্ণ।
সিবিসি পরীক্ষার ধ্রুবক
এই পরীক্ষা রক্তের বিভিন্ন উপাদান ও বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করে একটি সার্বিক পরিসংখ্যান তুলে ধরে। উপাদান ও বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে—
লোহিত রক্তকণিকা: এটি ফুসফুস থেকে দেহের অন্যান্য অংশে অক্সিজেন বহনের কাজ করে থাকে।
শ্বেত রক্তকণিকা: এটি জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেহকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। পাশাপাশি দেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
হিমোগ্লোবিন: রক্তের লোহিত কণিকার এই প্রোটিনই অক্সিজেন বহন করে। রক্তের বর্ণের জন্যও
সিবিসি পরীক্ষার ফলাফল
কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট পরীক্ষার মাধ্যমে পাওয়া ফলাফল দেখে চিকিৎসক রোগীর রোগের ধরন সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা পেতে পারেন। কোন ফলাফল কোন রোগগুলোকে নির্দেশ করে, তা দেখে নেওয়া যাক।
রক্তে লোহিত কণিকার স্বাভাবিক মাত্রা প্রতি মাইক্রোলিটারে ৩.৫ থেকে ৫.৫ মিলিয়ন সেলস।
হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা - পুরুষের ক্ষেত্রে- ১৩.৫ থেকে ১৭.৫ গ্রাম পার ডেসিলিটার , নারীর ক্ষেত্রে- ১২.৫ থেকে ১৫.৫ গ্রাম পার ডেসিলিটার
হেমাটোক্রিট মাপা হয় শতাংশে। সাধারণত স্বাভাবিক মাত্রা হিসেবে ধরা হয় ৩৮.৩ থেকে ৪৮.৬ শতাংশ (পুরুষের ক্ষেত্রে)। ৩৫.৫ থেকে ৪৪.৯ শতাংশ (নারীর ক্ষেত্রে)।
রক্তে শ্বেত কণিকার স্বাভাবিক মাত্রা পুরুষের ক্ষেত্রে প্রতি মাইক্রোলিটারে ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ ও নারীর ক্ষেত্রে ৪,৫০০ থেকে ১১,০০০।
রক্তে লোহিত কণিকা, হিমোগ্লোবিন ও হেমাটোক্রিটের মাত্রা কম থাকলে অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা হতে পারে। লিউকেমিয়া, অস্থিমজ্জার সমস্যা, দেহে অতিরিক্ত পানির উপস্থিতির মতো অসুস্থতা দেখা দেয়।
আর এসবের মাত্রা বেশি থাকলে ধরা হয় পলিসাইথেনমিয়া। হৃদ্রোগ ও দেহের পানিশূন্যতার মতো সমস্যা হতে পারে।
রক্তে শ্বেত কণিকার মাত্রায় অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে দেহ জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়ে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। এইচআইভি সংক্রমণ, বোনম্যারো (অস্থিমজ্জা) সমস্যাসহ ক্যানসারের ঝুঁকিও তৈরি হয়।
চিকিৎসকগণ নানা সময়ে রোগীদের ব্লাড টেস্ট করতে দেন। এসব ব্লাড টেস্টের মধ্যে থাকে সিবিসি বা কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট-
CBC Test (Complete blood count ) । আর এই সিবিসি টেস্ট করে দেখা হয়, ব্লাড সেল টাইপ এবং ব্লাড সেলের কাউন্ট বা পরিসংখ্যান। এসব দেখে চিকিৎসকগণ বুঝতে পারেন ব্লাড সেল স্বাভাবিক কিনা। এই ধরনের টেস্ট করে বুঝা যায়, শরীরে কোনো ইনফেকশন আছে কিনা, রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কত ইত্যাদি ইত্যাদি।
কমপ্লিট ব্লাড টেস্ট রক্তের বিভিন্ন উপাদান ও বৈশিষ্ট্য গণনা করে যার মধ্যে রয়েছেঃ
• লোহিত রক্ত কণিকা যেটা রক্ত বহন করে,
• শ্বেত রক্ত কণিকা যেটা জীবাণুর সাথে যুদ্ধ করে,
• হিমোগ্লোবিন, রক্তে অক্সিজেন বহনকারী প্রোটিন,
• প্লাটিলেটস, রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে।
আরবিসি (RBC) বা রেড ব্লাড সেল:
রেড ব্লাড সেল বা লোহিত রক্ত কণিকার কাজ হচ্ছে ফুসফুস থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করে কোষে পৌঁছে দেয়া এবং কোষ থেকে দূষিত কার্বনডাই অক্সাইড বহন করে ফুসফুসে নিয়ে যাওয়া।
আমাদের জানতে হবে কি কি কারনে বা কোন কোন অসুখে এই সকল পরিমাপকের কি কি পরিবর্তন হতে পারে, যেমন-
• রেড ব্লাড সেলের নরমাল ভ্যালু হচ্ছে প্রতি মাইক্রোলিটারে ৩.৫ থেকে ৫.৫ মিলিয়ন সেলস । রেড ব্লাড সেল কম থাকলে অ্যানিমিয়া হতে পারে। আর রেড ব্লাড সেল বেশি থাকলে ধরা হয় পলিসাইথেনমিয়া।
• হিমোগ্লোবিন: লোহিত-কণিকার একটি প্রয়োজনীয় অংশ হল হিমোগ্লোবিন। হিমোগ্লোবিনই অক্সিজেনকে বহন করে এবং লোহিত-কণিকার রক্তবর্ণের জন্য দায়ী। পরীক্ষায় হিমোগ্লোবিনের পরিমান সাধারণভাবে নির্দেশ করে দেহ কতটা অক্সিজেন পাচ্ছে। হিমোগ্লোবিনের নরমাল ভ্যালু একজন মানুষের বয়স ও লিঙ্গের উপর নির্ভর করে। তবে ল্যাব ভিত্তিক ফলাফল এদিক সেদিক হয়ে থাকে। তবে ধরে নেয়া হয় পুরুষের নরমাল ভ্যালু হচ্ছে ১৩.৫ থেকে ১৭.৫ গ্রাম পার ডেসিলিটার আর মহিলাদের ক্ষেত্রে ১২.৫ থেকে ১৫.৫ গ্রাম পার ডেসিলিটার। এই ভ্যালুর চেয়ে কম হলে অ্যানিমিয়া হয়ে থাকে।
• হেমাটোক্রিট :লোহিত কণিকা রক্তের কতটা অংশ (ঘনায়তন বা volume-এর মাপে) জুড়ে আছে সেটি বোঝাতে এটি ব্যবহার করা হয়। এটি মাপা হয় শতাংশ বা পার্সেন্টেজ হিসেবে। যদি হেমাটোক্রিট ৪০ বলা হয়, তার মানে রক্তের ঘনায়তনের ১০০ ভাগের ৪০ ভাগ লোহিত কণিকাপূর্ণ।
• এম সি ভি(MCV)- প্রতিটি লোহিত রক্ত কণিকার স্বাভাবিক আয়তন বোঝা যায়।
• এম সি এইচ সি(MCHC)- প্রতিটি লোহিত রক্ত কনিকার মধ্যে হিমোগ্লোবিনের ঘনত্ব নির্দেশ করে।
• এম সি এইচ (MCH)- প্রতিটি লোহিত রক্ত কনিকার পরিমান নির্দেশ করে।
চলুন এখন জানা যাক অ্যানিমিয়া্র কারনসমূহ:
আমাদের দেশে প্রধান অ্যানিমিয়ার কারন হল
- আয়রনের ঘাটতি। (iron deficiency)
- থ্যালাসেমিয়া
- কৃমি
- পরিমানমত রক্ত তৈরি না হওয়া
- দীর্ঘ মেয়াদী কোন অসুখ থাকলে
- ব্লাড ক্যানসার হলে
- অপুষ্টি
- অর্শ, গেজ, অন্ত্রে ক্যানসার থাকলে
- দীর্ঘ দিন রক্ত ক্ষরণ হলে যেমন- দীর্ঘ মাসিক, পাইলস
আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত অ্যানিমিয়ার কারন হলো আয়রনের ঘাটতি, যেটা মহিলাদের সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। আসুন এখন আলোচনা করা যাক আয়রনের ঘাটতি কেন হয় সেটা নিয়ে। আমাদের শরীরে আয়রনের ঘাটতি তিন ধরনের হতে পারেঃ
- কম আয়রন জাতীয় খাদ্য গ্রহন,
- অন্ত্র হতে শরীরে আয়রন কম শোষিত হওয়া,
- ব্লাড ক্ষয় হওয়া।
কম আয়রন জাতীয় খাদ্য গ্রহন:
আমাদের দেশের বেশিরভাগ মেয়েরাই আয়রনের ঘাটতিতে ভোগে। আর এই আয়রনের ঘাটতি পূরণ করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো আয়রন জাতীয় খাবার বেশি বেশি খাওয়া। কোন কোন খাবারে আয়রন বেশি আছে সেটি পরীক্ষা করার একটি সহজ উপায় আছে। উপায়টি হলো, যে সকল খাবার কেটে রাখলে কিছুক্ষণ পর কালো হয়ে যায় বুঝতে হবে সেসকল খাবারে আয়রন আছে যেমন, বেগুন, কচুশাক, কাঁচকলা, আপেল ইত্যাদি। এছাড়াও গরুর কলিজা, মাংস, দুধ, ডিম, পাকা কলা ইত্যাদি এগুলোতে আয়রন আছে।
অন্ত্র হতে শরীরে আয়রন কম শোষিত হওয়া:
যদি অন্ত্রে কৃমি থাকে বা কোন অসুখ থাকে তাহলে সেগুলো লৌহ শোষণে বাধা দেয়।
ব্লাড ক্ষয় হওয়া:
মেয়েদের যেহেতু প্রতি মাসে রক্ত ক্ষয় হয় তাই রক্ত স্বল্পতার ঝুঁকি থাকে। তবে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে রক্ত ক্ষরণ বেশি হলে অথবা আয়রন জাতীয় খাবারের ঘাটতি থাকলে অ্যানিমিয়ার ঝুঁকি থাকে। আর এইজন্য মেয়েদের বেশি বেশি আয়রন খাওয়া উচিত। এছাড়াও খাদ্যনালী, শ্বাসনালী, মূত্রনালি হতে রক্ত ক্ষরণ হলে রক্ত স্বল্পতা হতে পারে।