04/02/2024
আজ ৪ ফেব্রুয়ারী, বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। ক্যান্সার নামক মরন-ব্যাধিটিকে বিশ্বজুড়েই মৃত্যুর অন্যতম প্রধান একটি কারন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর যে ছয় ধরনের ক্যান্সার পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি হয়, ওরাল ক্যান্সার বা মুখ ও চোয়ালের ক্যান্সার তার মধ্যে অন্যতম। সারা বিশ্বে প্রতিবছর ৫০ হাজারেরও বেশী মানুষ মুখ ও চোয়ালের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী হিসেবে শনাক্ত হয়, এবং প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এই ক্যান্সারে মারা যায়। যদি শুধু বাংলাদেশের কথা বলি, প্রতিবছর ৭ হাজারেরও বেশি নতুন রোগী ওরাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়, যাদের মৃত্যুহার প্রায় ৬.৬ শতাংশ।
🔘ওরাল ক্যান্সার বলতে আসলে কোন কোন জায়গার ক্যান্সারকে বোঝায়?
মূলত গালের ভিতরের অংশ, মুখগহ্বর, ঠোঁট, জিহবা, মুখের তালু, মাড়ি এবং তদসংলগ্ন চোয়ালের কোন অংশের খারাপ ধরনের টিউমারকেই মোটা দাগে 'ওরাল ক্যান্সার' বলে।
🔘কাদের বেশি হয় মুখের ক্যান্সার? বা কাদের মুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি?
ধুমপায়ী ও মদ্যপানকারীদের মধ্যে ওরাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও যে সকল বিষয় মুখ ও চোয়ালের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়, সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ-
🔹তামাক ও তামাকজাতীয় পন্য সেবন
🔹পান-সুপারী, নস্যি সেবন
🔹রেডিয়েশন কিংবা সুর্যের ক্ষতিকর রশ্মির প্রভাব
🔹রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব
🔹কিছু ভাইরাস, যেমন EBV, HPV
🔘ওরাল ক্যান্সারের মধ্যে কোন ধরনের ভ্যারিয়েন্ট বেশি দেখা যায়?
বাংলাদেশে ওরাল ক্যান্সারের প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশই স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা (SCC), এছাড়াও Verucose Carcinoma, Adenoid Cystic Carcinoma, Mucoepidermoid Carcinoma, Melanoma ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
🔘ওরাল ক্যান্সারের লক্ষন কি কি? বা দেখতে কেমন?
প্রাথমিক অবস্থায় সাধারণত কোন ব্যথা থাকেনা। শুরুর দিকে সাদা, কিংবা লাল প্রলেপের মত দেখা যেতে পারে মুখের ভেতরের যেকোন স্থানে। কিংবা ছোট কোন প্রবৃদ্ধি বা গ্রোথও দেখা যেতে পারে। যেখানে পরবর্তীতে ক্ষত তৈরী হয়ে যায়, যা আলসারে রূপ নিতে পারে। সেটা একসময় গভীর হতে হতে তার নিচের স্ট্রাকচারের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে যায়। এরপর আশেপাশের লসিকা প্রন্থি গুলো স্ফীত হয়ে উঠতে পারে।
এডভান্সড স্টেজে আক্রান্ত অংশ বেশ বড়, দানাদার, খসখসে, গর্তাকৃতির কিংবা ফুলকপি মত আকৃতির স্ফীত ঘা তে পরিণত হতে পারে, এবং সেখান থেকে রক্তক্ষরণও হতে পারে। এ পর্যায়ে এসে ব্যথাও হতে পারে।
মুখের নরম টিস্যু ভেদ করে হাড়কেও যুক্ত করে নিতে পারে মুখের ক্যান্সার আক্রান্ত টিস্যু। তখন আক্রান্ত চোয়ালের অংশের দাঁত নড়ে যেতে কিংবা সরে যেতে পারে। মুখ ও চোয়ালের স্নায়বিক অনুভূতিতে বিরূপ প্রভাব দেখা যেতে পারে। যেমন ঠোঁট ভারি লাগা, অবশ লাগা, ফোলা লাগা, ব্যথা করা, ঝিমঝিম করা, ইত্যাদি।
🔘কিভাবে শনাক্ত করা হয় মুখের ক্যান্সার?
মুখের ক্যান্সার আক্রান্ত টিস্যুর বায়োপসি নিয়ে হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষা করেই মূলত ক্যান্সার নিশ্চিত করা হয়। এছাড়াও সিটি স্ক্যান ও MRI করে ক্যান্সার আশেপাশে কতটুকু অংশকে ইনভলভ করেছে , বা কোন পর্যন্ত ছড়িয়েছে তা নিরূপণ করা যায়।৷ PET Scan করে ক্যান্সার শরীরের অন্যান্য অংশে আদৌ ছড়িয়েছে কিনা, কিংবা কতটুকু ছড়িয়েছে, তা দেখা যায়। এছাড়াও FNAC করে ক্যান্সার ঘাড়ের লসিকাগ্রন্থিতে ছড়িয়েছে কিনা বোঝা সম্ভব।
🔘মুখ ও চোয়ালের ক্যান্সারের চিকিৎসা-
মুখ ও চোয়ালের ক্যান্সারের চিকিৎসা সাধারণত মাল্টিডিসিপ্লিনারি এপ্রোচেই করা হয়, যার মধ্যে ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জন, প্লাস্টিক সার্জন, অংকোলোজিস্ট, রেডিওথেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্টসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞ বৃন্দ অন্তর্ভুক্ত থাকেন।
কোন ধরনের চিকিৎসা করা হবে, তা কয়েকটা বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন, রোগীর বয়স, পছন্দ, শারীরিক অবস্থা, ক্যান্সার আক্রান্ত অংশের অবস্থান এবং সেটা কোন স্টেজে আছে, ঘাড়ের আশেপাশের লসিকাগ্রন্থি গুলো ইনভলভ হলো কিনা, শরীরের অন্য কোন অংশে ক্যান্সার ছড়িয়ে গেছে কিনা, ইত্যাদি।
মূল ক্যান্সার আক্রান্ত অংশ এবং ঘাড়ের আক্রান্ত লসিকাগ্রন্থি গুলোর চিকিৎসা একসাথেই করা হয়। এক্ষেত্রে সার্জিকাল চিকিৎসাই প্রধান ও সুনিশ্চিত চিকিৎসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। Wide 3D Surgical Excision followed by Neck Dissection এখনো মুখ ও চোয়ালের ক্যান্সারের চিকিৎসার মূল প্রটোকল হিসেবে বিবেচিত হয়, যদি উদ্দেশ্য থাকে কিউরেটিভ বা ক্যান্সারমুক্ত করার।
তবে সার্জারীর পর Adjuvant রেডিয়েশন থেরাপি কিংবা কেমোথেরাপি অথবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুটোই একসাথে দেয়া খুবই জরুরী। মূলত Micrometastasis বা ক্যান্সার সেল ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে রেডিওথেরাপি /কেমোথেরাপি দেয়া হয়। শরীরের দূরবর্তী অংশে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়লেও কেমোথেরাপি দিতে হয়। তবে মুখের ক্যান্সারে রেডিওথেরাপিই বেশি সেন্সিটিভ।
তবে যদি কোন রোগীর মুখ ও চোয়ালের ক্যান্সার আক্রান্ত অংশটি কোন কারনে সার্জিকাল অপারেশনের অযোগ্য হয়, সেক্ষেত্রে রেডিওথেরাপি এবং কেমোথেরাপিই মূল চিকিৎসা হিসেবে বিবেচিত হয়। কখনো কখনো এমন রোগীর দুর্দশা লাঘবের জন্য প্যালিয়েটিভ সার্জারীও করা হয়।
🔘মুখ ও চোয়ালের আধুনিক সার্জিকাল চিকিৎসা ও বাংলাদেশ-
মুখ ও চোয়ালের ক্যান্সারের যেকোন সার্জারীতেই ক্যান্সার আক্রান্ত অংশ 3D Wide Surgical Excision এর মাধ্যমে সফট টিস্যু ও আক্রান্ত হাড়ের অংশ সহ অপসারন করা হয়। এটাই ওরাল ক্যান্সারের মূল চিকিৎসা পদ্ধতি। একটা সময়ে শুধু আক্রান্ত অংশের সার্জিকাল অপসারন করাটাকেই যথেষ্ট মনে করা হতো। কিন্তু যে বিশাল একটা অংশ ফেলে দেয়া হলো, সে অংশকে পরিপূর্ণ ভাবে প্রতিস্থাপন করা যেতো না। ফলে, রোগীর মুখ ও চোয়ালের কর্মক্ষমতা অনেকাংশেই কমে যেতো, স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হতো। মুখে বিকৃতি দেখা দিতো, চোয়ালের অংশ অপসারণ করায় কথা বলতে কিংবা খাবার খেতে রোগীদের খুবই অসুবিধা হতো। জিহবার ক্যান্সারে জিহবার বড় একটা অংশ ফেলে দিলে রোগীর ঢোক গিলতে, খেতে, কথা বলতে ভীষণ কষ্ট হতো।
বাংলাদেশের অবস্থাও এমনই ছিলো। কিন্তু মাইক্রোভাসকুলার সার্জারীর আগমন মুখের ক্যান্সার চিকিৎসায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। মাইক্রোভাসকুলার রিকন্সট্রাকশনের ফলে গত দুই দশকে রিকন্সট্রাক্টিভ সার্জারী এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। ফলে, শুধু অপসারিত সফট টিস্যুই নয়, বরং চোয়ালের হাড়ের যে অংশটুকু ফেলে দেয়া হয়, সেই হাড়কেও প্রতিস্থাপন করা যায় শরীরের অন্য অংশ(ডোনার সাইট) থেকে ফ্ল্যাপ (হাড় ও মাংসপিণ্ড) নিয়ে। ফলে ওরাল ক্যান্সার অপারেশনের রোগীর মুখ ও চোয়ালের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে। সঠিকভাবে খাওয়া, কথা বলা, ঢোক গিলতে পারা আর কোন সমস্যা নয় মুখ ও চোয়ালের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য। আমাদের দেশে এখন অহরহই হচ্ছে মাইক্রোভাসকুলার রিকন্সট্রাকশন।
কোন ধরনের রিকন্সট্রাক্টিভ সার্জারী করা হবে, তা কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন, ক্যান্সার আক্রান্ত অংশের টিস্যুর ধরন (হার্ড/সফট), ডিফেক্ট এর আকৃতি, কি ধরনের আউটকাম রোগী/সার্জন প্রত্যাশা করে, ডোনার সাইটের অবস্থা, রোগীর কো-মরবিডিটি। এসবের সাথে সাথে সার্জনের অভিজ্ঞতা, ট্রেনিং এবং স্কিল অনুসারে অনেক ধরনেরই রিকন্সট্রাক্টিভ সার্জারী করা যায়।
অপসারিত অংশের মধ্যে হাড় না থাকলে কিংবা খুব বড় অংশ যদি অপসারন করা না লাগে, সে ক্ষেত্রে আমরা আশেপাশের এলাকা থেকে লোকো-রিজিওনাল ফ্ল্যাপ নিতে পারি। যেমন, সাবমেন্টাল আইল্যান্ড ফ্ল্যাপ, প্রেকটোরালিস মেজর মায়োকিউটেনিয়াস ফ্ল্যাপ। এসব ফ্ল্যাপ মূলত মাংসপেশি দিয়ে গঠিত। অপসারিত সফট টিস্যুকে এদের দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়।
আর, সার্জিকালি যদি বেশ বড় অংশ অপসারন করতে হয়, কিংবা অপসারিত স্পেসিমেনের বড় একটা অংশ যদি চোয়ালের হাড় হয়, সেক্ষেত্রে ফ্রি ফ্ল্যাপই হচ্ছে উপযুক্ত সমাধান। এক্ষেত্রে ফ্রি ফিবুলা ফ্ল্যাপ, এন্টেরোল্যাটেরাল থাই ফ্ল্যাপ, রেডিয়াল ফোরআর্ম ফ্ল্যাপ উল্লেখ যোগ্য। মাংসপেশি ও হাঁড়ের পাশাপাশি ফ্ল্যাপের মুল রক্তনালীকেও অক্ষত অবস্থায় এনে মুখের আক্রান্ত অংশের রক্তনালীর সাথে মাইক্রোভাসকুলার এনাস্টোমোসিস করে জোড়া লাগানো হয়। ফ্ল্যাপের বড় সুবিধা হলো, অনেক বড় ডিফেক্ট পূরণ করার পাশাপাশি এর মাধ্যমে মাংসপেশির বদলে মাংসপেশি, হাড়ের বদলে হাড় প্রতিস্থাপন করা যায়।
অনেক সময় আমরা অপসারিত হাড়ের পরিবর্তে হাড় ব্যবহার না করে রিকন্সট্রাকশন প্লেটও ব্যবহার করতে পারি। তবে পারত পক্ষে হাড়ের প্রতিস্থাপন হাড় দিয়ে করাই উত্তম।
আমাদের দেশে মুখের ক্যান্সারের চিকিৎসা উন্নত বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে অনেকদূর এগিয়েছে। মুখ ও চোয়ালের ক্যান্সার আক্রান্ত অংশের প্রতিস্থাপনে দক্ষতার সাথে মাইক্রোভাসকুলার রিকন্সট্রাকশন করায় আমাদের দেশের ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জনরাও পিছিয়ে নেই।
তাই, ক্যান্সার মানেই ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু নয়। বরং সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করা গেলে মুখের ক্যান্সার সম্পূর্ণভাবে নিরাময় করা সম্ভব, এবং এ দেশেই সম্ভব।
CR: Fakhrul munna