24/12/2023
যথাসময়ে চিকিৎসা হলে
স্তন ক্যান্সার নিরাময় করা যায়।
ডা. মো. মামুন অর রশীদ
স্তন ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য। তবে এর জন্য প্রয়োজন সময়মত যথাযথ চিকিৎসা। বর্তমানে স্তন ক্যান্সারের পরিপূর্ণ চিকিৎসা বাংলাদেশেই সম্ভব।
চিকিৎসায় অধিকাংশ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। শতকরা ৯৯ ভাগ স্তন ক্যান্সার নারীদের হয়ে থাকে আর এর বিপরীতে পুরুষের আক্রান্তের হার মাত্র ১ শতাংশ। অতএব সংখ্যায় কমহলেও যেনে রাখা ভালো পুরুষরাও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় ।
বিশ্বব্যাপী ক্যান্সারজনিত কারনে নারী মৃত্যুর দ্বিতীয় স্থানে আছে স্তন ক্যান্সার। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বছরে বিশ্বে প্রায় ১৩ লক্ষ নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় আর প্রায় ৬ লাক্ষের অধিক নারী এ কারণে মৃত্যুবরন করে । বয়স, জাতি, বর্ণ ও অঞ্চল ভেদে এই রোগে আক্রান্তের হারে তারতম্য রয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের থেকে এশিয়ায় আক্রান্তের হার তুলনামূলকভাবে কম ।
নারীদের জীবনযাত্রা, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক উন্নায়নের ফলে প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষভাবে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি আগের থেকে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়ন আর অগ্রগতির ফলে গত তিন দশকে এই ক্যান্সারে মৃত্যুর হার তুলনামূলক ভাবে কিছুটা কমে আসছে।
বাংলাদেশে প্রতি এক লক্ষ নারীদের মাঝে ১৯ জন স্তন ক্যান্সার আক্রান্ত হয়। আর প্রতি ৮ জনের মধ্যে একজন নারী তার জীবদ্ধশায় এ ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকেন। এবং বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই আক্রন্তের ঝুঁকিও বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১৩ হাজার নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় সাত হাজার মৃত্যুবরন করে ।
এই ক্যান্সার প্রতিরোধ আর নিরাময়ের জন্য প্রয়োজন নারীদের সচেতনতা। আর এর জন্য স্তন ক্যান্সারের কারন গুলো নারীদের জানা খুবই প্রয়োজন: কারণ গুলোকে আমরা মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। এক, ঐচ্ছিক যা ব্যক্তি নিজের ইচ্ছায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যেমন হরমোন থেরাপি গ্রহণ, শরীরের বাড়তি ওজন, অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার, নিয়মিত শরীরচর্চা না করা, তামাক জাতীয় পণ্য গ্রহণ, মদ্যপান, কম ফলমূল ও শাকসবজি খাবার কম খাওয়া ইত্যাদি।দুই, অনৈচ্ছিক যেসকল কারন ব্যক্তির নিজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে ।যেমন, নারী-পুরুষের মধ্যে স্তন ক্যান্সার আক্রান্তের তারতম্য, ঋতুশ্রাব, পারবারিক ক্যান্সারের ইতিহাস, মাতৃদুগ্ধ পানের অভ্যাস, জিনের মিউটেশন ইত্যাদি।
স্তন ক্যান্সারের লক্ষণগুলো কি? কিভাবে রোগী বুঝতে পারবেন তিনি এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগী তার স্তনে চাকা কিংবা গোটা অনুভব করেন। স্তনের চামড়া কমলার খোসার মত কুঁচকে যায়, স্তনের বোটা দিয়ে রক্ত, পুঁজ বের হয় কিংবা বিকৃত হয়ে যায় এবং স্তনে অতিরিক্ত চুলকানি নিয়েও প্রকাশ করতে পারে।
কারো উল্লেখিত লক্ষণ গুলো দেখা দিলে অবশ্যই একজন সার্জন কিংবা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিবেন। তবে উল্লেখ্য যে, স্তন ক্যান্সার গাইনি চিকিৎসকের বিষয় নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় মহিলারা স্তনের কোন সমস্যা হলেই গাইনি বিশেষজ্ঞের কাছে যান। এটি সবার যেনে রাখা ভালো, স্তনের রোগ মূলত সার্জারী বিশেষজ্ঞদের বিষয় ।
স্তন ক্যান্সারের পরিপূর্ণ চিকিৎসা বাংলাদেশ হয়। সার্জারী, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপির ও হরমোন থেরাপি মাধ্যমে মূলত স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা করা হয়। তবে একজন রোগীর সব সময় এই সকল ব্যবস্থার দরকার হয় না। যেমন রোগ প্রাথমিক পর্যায় থাকলে কেবল আপারেশনের মাধ্যমেই নিরাময় করা যায় এবং ক্ষেত্র বিশেষ রেডিয়েশন ও কেমোথেরাপি থেরাপির এড়ানো যায় । যার কারনে চিকিৎসা জনিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও কম হয়। অতএব ক্যান্সার রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রাথামিক পর্যায় চিকিৎসা করার গুরুত্ব অনেক বেশি। অধিকন্তু স্তন ক্যান্সার অ্যাডভান্স পর্যায় সনাক্ত হলেও অনেক রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়। তবে এক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের সাথে কেমোথেরাপি আর রেডিয়েশন থেরাপি বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। ফলস্রুতিতে চিকিৎসার ব্যয় আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও তুলনামূলকভাবে বেশি হয়।
স্তন ক্যান্সার শনাক্ত আর চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারনে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়, আর এসব দেশেই সম্ভব। চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী, একজন রোগীর সম্পূর্ণ চিকিৎসা শেষ হতে সময় লাগে প্রায় ৬ মাস । অধিকতর মূল চিকিৎসার পরে রোগীদের পরবর্তী ৫ থেকে ১০ বছরের জন্য নিয়মিত চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে থাকতে হয়। তাই এত দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা দেশের বাইরে থেকে নেয়া অনেকর পক্ষে সম্ভবপর নয় ।
স্তন ক্যান্সার প্রতিকারের জন্য টিকার মত সুনির্দিষ্ট কোন প্রতিষেধক নেই। তাই উপরে উল্লেখিত ঐচ্ছিক বিষয়গুলো সম্পর্ক সচেতন থেকে নারীরা তাদের জীবনের ঝুঁকি কমাতে পারেন । আর নারীরা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কিভাবে কমাবে । এর উত্তর, উপরে বর্নিত ক্যান্সারের কারণগুলো ভালোকরে জানা ও মেনে চলা।
বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন হাসপাতালে স্তন ক্যান্সার সনাক্ত করন কার্যক্রম (স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম) চালু রয়েছে। ৪০ বছর বয়স থেকে প্রতি নারী বছরে একবার করে স্তনের একপ্রকার এক্স-রে (Mammogram) ও চিকিৎসকের মাধ্যমে স্তন পরীক্ষা (Clinical breast examination) এবং বাড়িতে থেকে নারীরা নিজেরাই নিজেদের স্তন পরীক্ষা (Self breast examination ) করবে।
তবে যে সকল নারীদের পরিবারে স্তন ক্যান্সারের ইতিহাস আছে তারা ৩৫ বছর বয়স থেকে এই সনাক্তকরন পরীক্ষাগুলো শুরু করতে হবে । আর যেকোন সময় কারো স্তনে সন্দেহজনক উপসর্গ দেখা দিলে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ কিংবা বিশেষজ্ঞ সার্জনের পরামর্শ নিতে পারেন।
সর্বোপরি নিরাময়যোগ্য এই স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে আমরা সবাই সচেতন হই, এবং পরিবার ও সমাজে এই বার্তা পৌঁছে দেই : স্তন ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য, রোগ লক্ষণ প্রকাশের শুরুতে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হলে খুব সহজেই স্তন ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ করা যায়, চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাবার কোন প্রয়োজন নেই আর সচেতনতাই স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশ কমাতে পারে।
ডা. মো. মামুন অর রশিদ
সহযোগী অধ্যাপক, অনকোলজি বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।