23/06/2025
মোহাম্মদ আবরার রশিদ—জন্ম ২৫ জানুয়ারি, ২০১৭। প্রতিটি শিশুই তার বাবা-মায়ের পৃথিবী। কিন্তু যখন সেই শিশু শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মায়, তখন সেই যাত্রাপথ হয়ে ওঠে একটু ভিন্ন, অনেক বেশি সংবেদনশীল এবং অনেকটা নিঃশব্দ এক যুদ্ধ।
আবরারের বয়স যখন ২ বছর, তখন প্রথম নিয়ে যাওয়া হয় একজন ইএনটি (ENT) ডাক্তারের কাছে। তিনি Hearing Assessment করাতে বলেন। কিন্তু এই টেস্ট করাতে হলে বাচ্চাকে দীর্ঘসময় ঘুমে রাখতে হয়, যা বারবার চেষ্টার পরও সম্ভব হয়নি। অবশেষে চার বছর বয়সে সফলভাবে হিয়ারিং টেস্ট করা সম্ভব হয় এবং জানা যায় আবরারের শ্রবণজনিত জটিলতা রয়েছে।
তাঁর ককলিয়ার (Cochlea) ভালো থাকলেও সমস্যা ছিল অডিটরি নার্ভে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় Auditory Neuropathy—এ সমস্যায় মাঝে মাঝে শিশু খুব ভালো শুনতে পারে, আবার কখনো কখনো শুনতে পারে না। এই খবর শোনার পর আবরারের বাবা-মা ককলিয়ার ইমপ্লান্ট করার সাহসী সিদ্ধান্ত নেন।
পাঁচ বছর বয়সে আবরারের ককলিয়ার ইমপ্লান্ট সম্পন্ন হয়। সুইচ-অন হওয়ার দুই মাস পর শুরু হয় Auditory Verbal Therapy (AVT)। কিন্তু যাত্রাটি সহজ ছিল না। শুরু থেকেই আবরার কানে ডিভাইস পরতে চাইত না, থেরাপি সেশনে বসতো ১০-২০ মিনিট, এরপর সে আর কোনোভাবে মনোযোগ ধরে রাখতে পারত না, আর কিছুতেই সেশনটি সম্পন্ন করা যেত না। এইভাবে এক বছর কেটে যায়। থেমে যায় না বাবা-মায়ের আশা, কিন্তু বাড়তে থাকে হতাশা।
বিভিন্ন সেন্টারে নেওয়ার পরও সন্তোষজনক অগ্রগতি না দেখে আবরারের মা জানতে পারেন Hearing & Speech Solutions–এর কথা। আবরারকে সেখানে নিয়ে গেলে তাকে নতুন করে Assessment করা হয় এবং জানা যায়, সে কেবল হিয়ারিং ইমপ্লান্ট চাইল্ড নয়—তার Attention-Deficit Hyperactivity Disorder (ADHD)–ও রয়েছে।
ওর সমস্যাগুলো ছিল:
* কানে ডিভাইস না পরা
* অতিরিক্ত চঞ্চলতা
* আচরণ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা
* মনোযোগের অভাব
* অস্থিরতা
* কাজ শেষ না করতে পারা
* দীর্ঘসময় বসে থাকতে না পারা
* জেদি আচরণ
* Eye contact, tracking ও fixing সমস্যা
* Neck control, crawling ও walking সমস্যা
* Sensory, oral motor, এবং attention seeking সমস্যা
আবরারের বাব-মাকে পরামর্শ দেওয়া হয়:
* নিউরো-মেডিসিন ডাক্তার দেখানোর
* অকুপেশনাল থেরাপি (ওটি) শুরু করা
* নরমাল স্কুলে ভর্তি করা
* Auditory Verbal Therapy (AVT) চালিয়ে যাওয়া
সবকিছু শুনে তার বাবা মায়ের কপালে একটা চিন্তার ভাজ পড়লো, আমার বাচ্চা কি আদৌ কথা বলবে, স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবে সমবয়সি বাচ্চার মতো। পরামর্শ অনুযায়ী ওর মা-বাবা প্রতিটি গাইডলাইন মেনে চললেন। আবরারের ধীরে ধীরে উন্নতি হওয়া শুরু হলো। মাত্র ১ মাসের মধ্যেই সে মেশিন দিয়ে শুনতে পারে—এটা আবরার বুঝতে পারে এবং দিনে ১০-১২ ঘণ্টা ডিভাইস ব্যবহার করতে শুরু করে।
কিছুদিন পড়ে অডিওলজিষ্ট ধারণা করলেন ওর আরেক কানে হিয়ারিং এইড ব্যবহার করলে আবরারের উন্নতি হবে। তখন অডিওলজিষ্ট-এর পরামর্শে পরবর্তীতে আরেক পাশে হিয়ারিং এইড ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং ২৪-চ্যানেলের হিয়ারিং এইড দেওয়া হয়। এরপর আবরার দুই কানে শুনতে পায় এবং কথাও বুঝতে শুরু করে।
AVT থেরাপির মাধ্যমে আবরার যে-সব দক্ষতা অর্জন করেছে:
শব্দের মানে বুঝতে পারে
মেশিন ব্যবহার করলে যে শুনতে পারে এইটা বুঝতে পারে।
নিজের নাম শুনলে সাড়া দিতে পারে।
স্বরের আওয়াজের সাড়া নেয়।
শব্দ কোথা থেকে আসছে তার উৎপত্তি স্থল খুজে নেয় মাথা ও চোখ ঘুরিয়ে দেখে।
নতুন শব্দ শুনতে পছন্দ করে।
মাঝে মাঝে কথা শুনে কাজ করে
কিছু চাইলে মাথাও হাত নেড়ে সাড়া দিতে পারে।
অন্যদের কথার অনুকরণ করতে পারে
কথার সুর আসে শব্দের অংশ বিশেষ করে বার বার বলে
প, ব, ম, ড, ল ইত্যাদি অক্ষরের আওয়াজ বেশি ব্যবহার করে
রাস্তায় গাড়ির হর্ন দিলে শুনে পিপ পিপ বলে
বাসায় কলিং বেল বাজালে শুনে দরজা খুলে দেয়া
মায়ের ফোনে কল আসলে মাকে ফোন দিয়ে আসতে পারে।
সহজ কথা বুঝে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে
বাক্যের শেষের কথা শুনে মনে রেখে বলতে পারে।
অনেক কথা বলতে পারে অস্পষ্ট ভাবে
চেনা ছোট ছোট বাক্যের তফাত করতে পারে
চেনা বাক্য শুনে কাজ করতে পারে। যেমন: ব্রাশ করো, ভাত খাও, জুতা পড়ো, জামা পড়ো, গোসল করো, ঘুমাতে যাও, পানি খাও,
কোন কিছু চাইতে হলে হাত বাড়িয়ে দাও বলতে পারে এবং বুঝতে পারে।
কাজের শেষে শেষে ’বাই’ বলতে পারে
প্রতি সপ্তাহে নতুন শব্দ বুঝতে পারে ও বলতে পারে
এলোমেলো ও আওয়াজের মাধ্যমে আসল কথা বলতে শুরু করে।
শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম চেনে এবং বলতে পারে।
আঙুল দিয়ে চেনা জিনিস দেখায় এবং বলতে পারে
ঘরের প্রত্যেকটা জিনিসের নাম বলতে পারে এবং শুনে দেখাতে পারে।
বেশির ভাগ স্বরবর্ণ ব্যবহার করে কথা বলতে পারে।
শব্দের প্রথম ও শেষের ব্যঞ্জনবর্ণ ব্যবহার করতে পারে (প, ব, ম, ড, ল অক্ষরে শব্দ শব্দ বলতে পারে)।
একটির ওপর একটা ব্লক বসিয়ে ও রং দিয়ে কাগজে দাগ কাটতে পারে।
রঙের নাম বলতে পারে এবং শুনে নিদিষ্ট রং দিতে পারে
বড়, ছোট, মাঝারি এর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে এবং বলতে পারে
উপরে, নিচে, ভিতরে বাহিরে, নরম, শক্তের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে এবং সাথে বলতে পারে
ওয়ান সিলেবল ও টু সিলেবলের শব্দে বলতে পারে ও শুনে দিতে পারে।
এক সাথে দুইটা শব্দে শুনে মনে করে দিতে পারে। যেমন: আম আর আতা দাও
৪০০-৫০০ শব্দ বলতে পারে, বুঝতে পারে এবং সে অনুসারে কাজ করতে পারে।
অনেক শব্দই সঠিক ভাবে উচ্চারণ বলতে পারে।
আইটেম সিলেকশন করতে পারে যেমন: ফল ও সবজির আলাদা করতে
সমষ্টিগত নাম (Item Selection) ব্যবহার করতে পারে, যেমন: ফল, সবজি, হাউস হোল্ডার, খাবারের নাম, যানবাহন
ছেলে মেয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। যেমন: ছেলে বাচ্চাকে ভাইয়া বলে মেয়ে বাচ্চাকে আপু বলে)
নিজের প্রয়োজন সম্পর্কে বলতে পারে।
বাচ্চাদের সাথে মিশতে পছন্দ করে।
পরিবারে সদস্যদের মধ্যে কে কি হয় বলতে পারে। যেমন: বাবা, মা, ভাইয়া, আপু, দাদা নানা, নানু, মামা, মামি, চাচা, চাচি)
স্কুলে সব বাচ্চাদের সাথে মিশতে পারে।
টিফিনের সময় নিজের ব্যাগ খুলে একা টিফিন খেতে পারে
শিক্ষকদের কথা বুঝতে পারে এবং সে অনুসারে কাজ করতে পারে।
স্কুলে ড্রেস নিজে পড়তে পাড়ে এবং ব্যাগ গোছাতে পারে।
স্কুলে লিখতে দিলে দেখে দেখে লিখতে পারে।
স্কুল ছুটির পর ব্যাগ গুছিয়ে নিতে পারে
ক্লাসরুমে গিয়ে নিজের জায়গা চিনে বসতে পারে।
শেষকথা
আবরার শুধু শ্রবণ প্রতিবন্ধী ছিল না, ADHD-র মতো নিউরোডেভেলপমেন্টাল চ্যালেঞ্জ নিয়েও তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু তার বাবা-মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, প্রতিটি পরামর্শ মেনে চলা, নিরলস পরিশ্রম এবং Hearing & Speech Solutions–এর পেশাদার সেবা—সবকিছু মিলিয়ে আজ সে কথা বলতে পারে, শুনতে পারে, এবং স্বাভাবিক জীবনের পথে চলতে শিখছে।
আবরার আমাদের শেখায় — কোনো প্রতিবন্ধকতাই প্রতিবন্ধকতা নয় যদি তার সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নেয়া হয় এবং বাবা-মা পরামর্শ অনুসারে সব কাজ করেন।
---
, , , , , , , , , , , , , , , , , , ,