22/01/2024
🟩হিষ্টিরিয়া (Hysteria)
ইহার বাংলা নাম মূর্ছাবায়ু। সংখ্যায় ইহা পুরুষদিগের অতি অল্প ও স্ত্রীলোকদেরই অধিক হয়। সাধারণতঃ ১৫ হইতে ৩০ বৎসর বয়সের মধ্যেই পীড়া হয়, ৮ হইতে ১৫ বৎসরের মধ্যেও কখন কখন হিষ্টিরিয়া হয়।
🟩হিষ্টিরিয়ার লক্ষণ দুইভাগে বিভক্ত:-
১। কন্ডন্সিভ-ফরম (Convulsive form)
২। নন্-কন্তুন্সিভা-ফরম (Non-convulsive form)
১। কন্ডন্সিভ ফরম্-ইহাতে ফিট বা মূর্ছা (Hysterical fit) হয়। সাংসারিক শোক সপ্তাপ নীরবে সহ্য করা, প্রণয়ে হতাশ, অতিরিক্ত ক্রোধ ইত্যাদিই এই পীড়ার কারণ। ফিট হইবার পূর্ব্বে রোগী কাঁদে, হাসে, গান গায়, নানাবিধ অসম্ভব প্রকারের কথা কয়, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, শ্বাসকষ্ট হয়, বুক ধড়ফড় করে, বমি হয়। কোন কোন রোগী বিবেচনা করে বায়ু কিম্বা গোলার মত একটা পদার্থ তলপেট হইতে গলার দিকে ঠেলিয়া উঠিলে শ্বাসবন্ধ করিবার চেষ্টা করিতেছে এই প্রকার লক্ষণকে-গ্লোবাস-হিষ্টেরিকাল (Globus Hysterical) কহে। ইহার পরেই জ্ঞানলোপ ও ফিট আরম্ভ হয়। ফিটের পূর্ব্বে রোগী কোনও একটি নির্দিষ্ট স্থানে যাইয়া শয়ন করে। ফিটের সময় অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, হাত-পা ছোড়ে, হাত মুঠা করে, চীৎকার করে, দাঁতী লাগে, পেট ফুলিয়া উঠে, এই প্রকার অবস্থা ২/৩ মিনিট হইতে ২/৩ ঘন্টা পর্য্যন্ত স্থায়ী হয়, পরে ধীরে ধীরে জ্ঞান হয়, ফিট নিবৃত্ত হয়, বর্ণহীন জলের মত প্রচুর পরিমাণে প্রস্রাব ত্যাগ করে। সাধারণতঃ নীচ সম্প্রদায়ের লোকেরা এই প্রকার অবস্থা দর্শন করিয়া রোগিনীকে ভূতে ধরিয়াছে বিবেচনা করিয়া ওঝা আনয়ন করে এবং নাকে হরিদ্রা পোড়া ইত্যাদির উত্তেজক ধূমাদি দিয়া বেচারীকে যৎপরোনাস্তি কষ্ট দেয়।
২। নন্-কন্ডন্সিতে ফরম-ইহাতে খেঁচুনি (convulsion) হয় না। পীড়া সামান্য প্রকারের হইলে-রোগিণী একবার হাসে, একবার কাঁদে, গ্লোবাস্- হিষ্টেরিকাল্ (ইহার লক্ষণ উপরে বলা হইয়াছে) মূর্ছা (fainting) উত্তেজিত ভাব, হর্ষ, বিষন্নভাবাদি, মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ইত্যাদি কতকগুলি লক্ষণ দৃষ্ট হয়।
🔷কঠিন প্রকারের পীড়ায়- মোহ (Trance); ক্যাটালেন্সি (Catalepsy) ইহার লক্ষণ রোগীর হাত পা বেশ নরম থাকে; কিন্তু যে অবস্থায় রাখা যায় ঠিক সেই অবস্থায় পড়িয়া থাকে; ষ্টেটাস্-হিষ্টেরিকাল (Status Hysterical) ইহাতে রোগী কতিপয় মাস বিছানায় পড়িয়া থাকে, স্মৃতিশক্তির লোপ হয়, সমস্ত ঘটনা ও বস্তুই বিস্মৃত হয়, নিশ্বাসে দুর্গন্ধ এবং বিকার ভাব- তাহাতে আত্মহত্যার ভাব প্রকাশ ইত্যাদির লক্ষণগুলি প্রকাশ পায়।
🔷উক্ত শ্রেণীর হিষ্টিরিয়ার প্রধান উপসর্গ সমূহ যথা:
পক্ষাঘাত-রোগী কখনও কেবলমাত্র পক্ষাঘাতিক অবস্থা প্রাপ্ত হয়, চলিত বা দাঁড়াইতে পারে না; কিন্তু বিছানায় শুইয়া বেশ পা নাড়াচাড়া করিতে পারে। কখনও দাঁড়ায়াল্লিজিয়া হয়, কোমর হইতে নীচের অংশের ক্ষমতার হ্রাস হয়; কখনও প্যামারজিয়া অর্দ্ধাঙ্গের পক্ষাঘাত, বেশীর ভাগ বামাঙ্গ আক্রান্ত হয়; গলনালীর হেমিপ্লিজিয়া গিলিতে পারে না; স্বরযন্ত্রের পক্ষাঘাত এথালার স্বর বন্ধ হয়, অস্ত্রের পক্ষাঘাত-স্বাভাবিক বায়ু বা মল নিঃসরণ হয় না; মূত্রথলীর পক্ষাঘাত-প্রস্রাব বন্ধ হয়।
🔷 হিষ্টেরিক্যাল-কনট্র্যাক্চারস (Hysterical Contractures)-ইহার লক্ষণ পেশীর সঙ্কোচ হয়, রোগীর হাত পা আঙুল বাঁকিয়া যায়, খোঁড়া হয়, কখনও কখনও ঘাড়, গলা, কাঁধ, মাঢ়ী ও জিহ্বা আক্রান্ত হয়। পেশীর উক্ত প্রকার সঙ্কোচভাব শীঘ্র দূর করা যায় না, ইহা কোনও ফিটের শেষে আরম্ভ হয় ও পরবর্তী ফিট পর্য্যন্ত স্থায়ী হয়, দ্বিতীয়বার ফিট হইলেই রোগী পরিত্রাণ পায়।
🔷ফ্যান্টম-ট্রিমার্ক্স (Phantom-tremors)-হিষ্টিরিয়াগ্রস্তা অনেক স্ত্রীলোকের ঋতু বন্ধ হইবার বয়সে কিম্বা ঋতুবন্ধ হইবার পর ঠিক গর্ভের লক্ষণসমূহ প্রকাশিত হয় তলপেট উঁচু হয়, স্তনে দুগ্ধ সঞ্চার হয় এবং গর্ভের অন্যান্য প্রায় সমস্ত লক্ষণ দৃষ্ট হয়, সমস্ত লক্ষণ দৃষ্ট হয়, এই প্রকার অবস্থায় প্রায় ১০০ বৎসরেরও অধিক সময় কাটিয়া যায়। কিন্তু সন্তান প্রসব হয় না। চিকিৎসক বা ধাত্রী পরীক্ষা করিয়া ভ্রূণের কোনও চিহ্ন পায় না। ডায়েফ্রাম ও উদরপেশীর সঙ্কোচ (কন্ট্রাক্সন) হওয়াই উক্ত প্রকার লক্ষণ প্রকাশিত হইবার কারণ, উহা প্রকৃত গর্ভ সঞ্চার নহে।
🔷হিষ্টেরিক্যাল্-ট্রিমার্ক্স (Hysterical tremors)-ইহার লক্ষণ-হাত কাঁপে; ক্বচিৎ মাথা, পা আক্রান্ত হয়। ইহা কখনও একা-কখনও প্যারালিসিস কিম্বা কনট্রাকচার্সের সঙ্গে দৃষ্ট হয়।
🔷হিষ্টেরিক্যাল্-য়্যানিস্থিসিয়া (Anaesthesia)-ইহার লক্ষণ শরীরের প্রায় সকল স্থানের কিম্বা কোনও অংশের চৰ্ম্মে ছুঁচ বিদ্ধ করিলেও রোগী কোনও প্রকার যন্ত্রণা অনুভব করে না। সাধারণতঃ শরীরের এক দিকের অঙ্গেই উক্ত প্রকার লক্ষণ অধিক দৃষ্ট হয়।
🔷হিস্টেরিক্যাল্-হাইপারিস্থিসিয়া (Hyperaesthesia)- ইহার লক্ষণ কখনও শরীরের কোনও এক অংশে; কখনও নানাস্থানে ভয়ঙ্কর বেদনা ও স্পর্শকাতরতা। মাথায়, ঘাড়ে, স্ত্রী-জননেন্দ্রিয়ে এবং বুক, পিঠ, হাত-পা, গাঁট প্রভৃতি স্থানে শূল-বেদনার মত, প্রাদাহিক বেদনার মত, ক্ষতের মত, পেরিটোনাইটীস, এপেন্ডিসাইটাস, গ্যাষ্ট্রাইটীসের মত ইত্যাদি নানা প্রকারে বেদনার মত বেদনা হয়।
🔷এপিলেপ্টি-ফরম্- হিষ্টিরিয়া। উহাতে অনেকটা এপিলেপ্সির মত কন্ডল্সন হয়, কেবলমাত্র ফিট অনেকক্ষণ স্থায়ী হওয়ায় ও ঘন ঘন আক্রমণ করায় হিষ্টিরিয়ায় সহিত প্রভেদ বুঝিতে পারা যায়। ডাঃ চার্লট এই পীড়াটির বিষয় প্রথম বর্ণনা করিয়াছিলেন।
🟩উপরোক্ত উপসর্গগুলি ভিন্ন-শ্বাসকষ্ট-শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড়ানি, বুকে এনজাইনা- পেক্টোরিসের মত বেদনা; ঋতুর রক্ত নাক মুখ দিয়া নির্গমন (Vicarious menstruation) পেটে বায়ু জমা ও পেটফোলা, পাকাশয় শূল-বেদনা (Gastralgia) বমি, কোষ্ঠবদ্ধ, হিক্কা প্রভৃতি অনেক প্রকার উপসর্গ উক্ত নন- কন্ডলসিত ফরমে দৃষ্ট হয়।
🟩হিস্টিরিয়া পীড়া উৎপত্তির কারণ।
এই রোগের বেশ কিছু কারণ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। নিউরো হরমোন ও মানসিক দ্বন্দ্বের কারণের পাশাপাশি আরো বেশ কয়েকটি কারণ আছে হিস্টিরিয়া রোগের পেছনে। সেগুলো হলোঃ
১। মানসিক চিন্তা, শোক, দুঃখ, গুপ্তপাপ অন্তরে চাপিয়া রাখা, ভয়, প্রেমে নিরাশ, প্রেমে হিংসা প্রভৃতি।
২। অনিয়মিত ঋতু, ঋতুবন্ধ, বন্ধ্যাদোষ।
৩। বহুদিন যাবৎ রতিক্রিয়ার অভাব (কৌমার্য্য ব্রত অবলম্বন)।
৪। জরায়ু ও ডিম্বকোষের কোনও প্রকার পীড়া।
৫। যৌবনকাল উত্তীর্ণ হইয়া বিবাহ।
৬। তরুণ দুর্ব্বলকর কঠিন পীড়া ভোগকালীন আঘাত ইত্যাদি।
🟩চিকিৎসা ও পথ্য
হিষ্টিরিয়া রোগীর মানসিক অবস্থায় অত্যন্ত গোলযোগ থাকে, তজ্জন্য তাহাকে কটুবাক্য প্রয়োগ বা যাহাতে মনে কষ্ট পায় এরূপ ব্যবহার করা উচিত নহে। চা, কফি প্রভৃতি উত্তেজক দ্রব্য এবং সুরা আফিম প্রভৃতি কোনও প্রকার মাদকদ্রব্য ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। এই পীড়ায় রোগীর প্রায় কোষ্ঠবদ্ধ থাকে; এবং কোষ্ঠ পরিষ্কার থাকিলে রোগী অনেকটা ভাল থাকিতে পারে, তজ্জন্য মৃদু বিরেচক দ্রব্য প্রয়োগ করিয়া কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখিলে অনেকটা পরিমাণে পীড়ার উপশম থাকিবে। অধিকাংশ স্ত্রীলোকের এই পীড়া-অতিরজঃ, স্বল্পরজঃ অর্থাৎ নানাবিধ ঋতুদোষের নিমিত্ত হয়, তজ্জন্য যাহাতে ঋতু স্বাভাবিক হয় লক্ষণ অনুযায়ী সেইরূপ ঔষধের ব্যবস্থা এবং শ্বেতপ্রদর থাকিলে যোনি ধৌত করা প্রয়োজন।
🔷ফিটের সময়-রোগিনীর-রোগিনীর গায়ের জামা-অন্ততঃ গলা ও বুকের বোতামগুলি খুলিয়া দেওয়া আবশ্যক, কোমরের কাপড়ও ঢিলা করিয়া দেওয়া প্রয়োজন। রোগিনীর চোখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দিলে অনেক সময় ফিটের উপকার হয়। ফিটের সময় রোগিণীকে একেলা রাখা ভাল, নিতান্ত প্রয়োজন হইলে একমাত্র শুশ্রষাকারী তাহার নিকট নিস্তব্ধভাবে থাকিবে ও অঙ্গরক্ষা করিবে। দাঁতী লাগিলে উহা খুলিবার চেষ্টা না করাই ভাল, তবে নিতান্ত প্রয়োজন হইলে ১০/১৫/২০ সেকেণ্ডের জন্য নাক মুখ টিপিয়া ধরিলে নিশ্বাস বন্ধ হইবে, তাহাতে দাঁতী আপনা হইতে খুলিয়া যাইবে এবং তৎসঙ্গে ফিটও বন্ধ হইতে পারে। ফিট অনেকক্ষণ স্থায়ী হইলে দুই কিম্বা একদিনের কুঁচকীর উপর ডিম্বকোষের স্থানে অর্থাৎ
ইলিয়্যাক-ফসার উপর হাত মুঠা করিয়া ২/৪ মিনিটকাল চাপিয়া রাখিলে ফিট শীদ্র বন্ধ হওয়া সম্ভব। এমিল-নাইট্রেট-০, ৫/৭ ফোঁটা রুমালে ঢালিয়া রোগীর নাকের গোড়ায় ধরিলে ফিটের প্রকোপ কমিতে পারে। লাইকার-এমোনিয়া, খেলিং সল্ট কিম্বা সমপরিমাণে চুণ ও নিশাদল একটি শিশির মধ্যে পুরিয়া উত্তমরূপে নাড়িয়া সেই শিশির মুখ রোগীর নাকের নিকট ধরিলেও শীঘ্র উপকার হয়, তবে ইয়া অধিকক্ষণ ব্যবহার করিবেন না, ইরিটেসন হইয়া হার্টের ও ব্রেণের অপকার হইবে। ২/৩টি রীটা ফল (যাহাতে পশমী বস্ত্রাদি কাচে) একট গরম জলে ঘসিয়া ফেণা বাহির হইলে সেই জলে একটু ন্যাকড়া ভিজাইয়া নাকের নিকট ধরিলেও ফিট ছাড়িয়া যায়।
হোমিওপ্যাথিক ঔষধে বিশেষ সুবিধা না হইলে-হিষ্টেরিক্যাল কনট্র্যাক্চারস (পেশী শক্ত হইয়া হাত পা আঙুল বাঁকিয়া যাওয়া) ও ফ্যান্টম ট্রিমারস (কৃত্রিম গর্ভের লক্ষণ) এই দুইটি উপসর্গে বা লক্ষণে কেবলমাত্র ক্লোরোফরম্ শোঁকাইলে অতি শীঘ্র উপকার পাইবেন। হিষ্টেরিক্যাল- প্যারালিসিসেও অনেক সময়-ক্লোরোফরম্ আঘ্রাণে উপকার হয়, ঠাণ্ডা স্থানে বাস, ঠাণ্ডা জলে স্নান, পাকা ফল, পেঁপে, বেল, ঘোল, কচি ডাবের জল পান, শাক-শজী এই পীড়ায় উপকারী। গরম মশলাযুক্ত দ্রব্য ও বায়ুবর্দ্ধক আহার একেবারে নিষিদ্ধ। পুরাতন তেঁতুল (১২ বৎসরের উর্দ্ধে) এক ভরি, দেড় পোয়া গরম জলে রাত্রিতে ভিজাইয়া রাখিয়া প্রাতে চট্কাইয়া একটু চিনি ও লবণসহ পান করিলে প্রত্যহ পেটে বায়ু জমা দূর ও কোষ্ঠ পরিষ্কার হইবে।
🔷এ রোগে হোমিওপ্যাথিক ভালো চিকিৎসা আছে তবে একজন ভালো ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, সিঙ্গেল মেডিসিন ব্যবহার করতে হবে এখানে কিছু মেডিসিনের নাম উল্লেখ করা আছে এছাড়াও সিন্ট্রম অনুযায়ী বিভিন্ন মেডিসিন আসতে পারে।
Aconite nap
Asafetida
Aurum met
Calca carb
Chamomilla
Lachesis
Lillium tig
Ignetia
Acid nit
Nux vom
কপিঃ এন সি ঘোস
ডাঃ সেলিম আহমেদ
ডিএইচএমএস ঢাকা