25/08/2025
থাইরয়েড: হরমোনের ভারসাম্যহীনতার লক্ষণ ও আধুনিক চিকিৎসার পথ
#থাইরয়েড
থাইরয়েড রোগ হলো থাইরয়েড গ্রন্থির কর্মক্ষমতার ব্যাঘাত, যা শরীরের বিপাকীয় ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন উৎপাদন করে। এই গ্রন্থি গলার নিচে, ঘাড়ের সামনে অবস্থিত এবং থাইরক্সিন (T4) ও ট্রাইআয়োডোথাইরোনিন (T3) হরমোন নিঃসরণ করে। বাংলাদেশে থাইরয়েড রোগ ক্রমশ বাড়ছে, বিশেষ করে নারীদের মধ্যে। ২০২৪ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের প্রায় ১৫% প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী কোনো না কোনো ধরনের থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছে। প্রধান দুটি রোগ হলো হাইপোথাইরয়েডিজম এবং হাইপারথাইরয়েডিজম। সঠিক নির্ণয় ও চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
হাইপোথাইরয়েডিজম: লক্ষণ ও কারণ
হাইপোথাইরয়েডিজম এমন একটি অবস্থা, যেখানে থাইরয়েড গ্রন্থি পর্যাপ্ত হরমোন উৎপাদন করতে পারে না। এটি বিপাকীয় ক্রিয়াকে ধীর করে দেয়, যার ফলে শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়।
লক্ষণ
• ক্লান্তি ও দুর্বলতা: সারাক্ষণ ক্লান্তি বা শক্তিহীনতা অনুভব।
• ওজন বৃদ্ধি: বিনা কারণে ওজন বেড়ে যাওয়া।
• ত্বক ও চুলের সমস্যা: শুষ্ক ত্বক, চুল পড়া, বা ভঙ্গুর নখ।
• ঠান্ডা সহ্য না করা: ঠান্ডা আবহাওয়ায় অস্বস্তি।
• কোষ্ঠকাঠিন্য: হজমের সমস্যা।
• মানসিক সমস্যা: বিষণ্ণতা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, বা মনোযোগের অভাব।
• অনিয়মিত ঋতুচক্র: নারীদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাবের সমস্যা।
• পেশিতে ব্যথা বা জয়েন্টে শক্তভাব: হাঁটু বা কোমরে অস্বস্তি।
কারণ
• অটোইমিউন রোগ: হাশিমোটো’স থাইরয়েডাইটিস, যেখানে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাইরয়েড গ্রন্থিকে আক্রমণ করে।
• আয়োডিনের অভাব: বাংলাদেশে আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে এটি কমেছে, তবে এখনো কিছু এলাকায় সমস্যা রয়েছে।
• ওষুধ বা চিকিৎসা: কিছু ওষুধ (যেমন লিথিয়াম) বা ক্যান্সারের রেডিয়েশন থেরাপি।
• জন্মগত ত্রুটি: জন্ম থেকে থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা।
• পিটুইটারি গ্রন্থির সমস্যা: পিটুইটারি গ্রন্থি থাইরয়েডকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলে।
হাইপারথাইরয়েডিজম: লক্ষণ ও কারণ
হাইপারথাইরয়েডিজমে থাইরয়েড গ্রন্থি অতিরিক্ত হরমোন উৎপাদন করে, যা বিপাকীয় ক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
লক্ষণ
• ওজন হ্রাস: বিনা কারণে ওজন কমে যাওয়া।
• হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি: দ্রুত বা অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন (পালপিটেশন)।
• উদ্বেগ ও অস্থিরতা: অতিরিক্ত ঘাম, নার্ভাসনেস, বা ঘুমের সমস্যা।
• তাপ সহ্য না করা: গরমে অস্বস্তি বা অতিরিক্ত ঘাম।
• ক্ষুধা বৃদ্ধি: খাওয়ার পরিমাণ বাড়লেও ওজন কমা।
• চোখের সমস্যা: গ্রেভস ডিজিজের ক্ষেত্রে চোখ ফুলে যাওয়া বা বাইরে বেরিয়ে আসা।
• চুল পড়া বা ত্বক পাতলা হওয়া: ত্বকের পরিবর্তন।
কারণ
• গ্রেভস ডিজিজ: একটি অটোইমিউন রোগ, যা থাইরয়েডকে অতিরিক্ত হরমোন উৎপাদনে উদ্দীপিত করে। বাংলাদেশে এটি হাইপারথাইরয়েডিজমের প্রধান কারণ।
• থাইরয়েড নডিউল: গ্রন্থিতে অস্বাভাবিক গোটা বা টিউমার।
• থাইরয়েডাইটিস: গ্রন্থির প্রদাহ, যা অস্থায়ী হাইপারথাইরয়েডিজম সৃষ্টি করতে পারে।
• অতিরিক্ত আয়োডিন: আয়োডিনযুক্ত ওষুধ বা খাবার।
থাইরয়েড রোগের নির্ণয়
থাইরয়েড রোগ নির্ণয়ে রক্ত পরীক্ষা সবচেয়ে কার্যকর। প্রধান পরীক্ষাগুলো হলো:
• TSH টেস্ট: থাইরয়েড-স্টিমুলেটিং হরমোনের মাত্রা পরিমাপ করে। হাইপোথাইরয়েডিজমে TSH বেশি এবং হাইপারথাইরয়েডিজমে কম থাকে।
• T3 ও T4 টেস্ট: হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা।
• অ্যান্টিবডি টেস্ট: অটোইমিউন রোগ শনাক্তকরণে।
• আল্ট্রাসাউন্ড বা বায়োপসি: থাইরয়েডে নডিউল বা ক্যান্সারের ঝুঁকি পরীক্ষা।
বাংলাদেশে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে এই পরীক্ষাগুলো সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যায়। তবে, গ্রামীণ এলাকায় সচেতনতা ও সুবিধার অভাব এখনো চ্যালেঞ্জ।
চিকিৎসার পদ্ধতি
হাইপোথাইরয়েডিজমের চিকিৎসা
• হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি: লেভোথাইরক্সিন (Levothyroxine) হলো সবচেয়ে সাধারণ ওষুধ, যা হরমোনের ঘাটতি পূরণ করে। বাংলাদেশে এটি সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী।
• নিয়মিত পর্যবেক্ষণ: TSH মাত্রা পরীক্ষা করে ডোজ সামঞ্জস্য করা হয়।
• খাদ্যাভ্যাস: আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার (যেমন সামুদ্রিক মাছ, আয়োডিনযুক্ত লবণ) গ্রহণ। তবে, অতিরিক্ত সয়াবিন বা ক্রুসিফেরাস শাকসবজি (যেমন ফুলকপি) এড়ানো উচিত, কারণ এগুলো হরমোন শোষণে বাধা দিতে পারে।
• জীবনযাত্রা: নিয়মিত ব্যায়াম ও ওজন নিয়ন্ত্রণ ক্লান্তি ও ওজন বৃদ্ধি কমায়।
হাইপারথাইরয়েডিজমের চিকিৎসা
• অ্যান্টি–থাইরয়েড ওষুধ: মেথিমাজল বা প্রোপাইলথাইওইউরাসিল হরমোন উৎপাদন কমায়।
• রেডিওঅ্যাকটিভ আয়োডিন থেরাপি: অতিরিক্ত সক্রিয় থাইরয়েড কোষ ধ্বংস করে। বাংলাদেশে এটি কিছু বিশেষায়িত হাসপাতালে পাওয়া যায়।
• সার্জারি: গুরুতর ক্ষেত্রে থাইরয়েড গ্রন্থির অংশ বা সম্পূর্ণ অপসারণ (থাইরয়েডেক্টমি)।
• বিটা–ব্লকার: হৃৎস্পন্দন বা উদ্বেগ কমাতে (যেমন প্রোপ্রানোলল)।
• খাদ্যাভ্যাস: অতিরিক্ত আয়োডিনযুক্ত খাবার এড়ানো এবং ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ, কারণ হাইপারথাইরয়েডিজম হাড়ের ক্ষয় ডেকে আনতে পারে।
নতুন চিকিৎসা ও গবেষণা
• প্রিসিশন মেডিসিন: জিনগত পরীক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসা। বাংলাদেশে এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে।
• টেলিমেডিসিন: অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে থাইরয়েড বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রামীণ রোগীদের জন্য উপলব্ধ হচ্ছে।
• হরমোন প্যাচ: ট্যাবলেটের পরিবর্তে ত্বকের মাধ্যমে হরমোন প্রয়োগের গবেষণা চলছে, যা শীঘ্রই বাংলাদেশে পাওয়া যেতে পারে।
• অটোইমিউন থেরাপি: হাশিমোটো ও গ্রেভস ডিজিজের জন্য ইমিউনোমডুলেটরি ওষুধ নিয়ে গবেষণা।
প্রতিরোধ ও জীবনযাত্রা
• আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার: আয়োডিনযুক্ত লবণ ও সামুদ্রিক মাছ খান।
• নিয়মিত পরীক্ষা: ৩৫ বছরের পর নিয়মিত TSH টেস্ট করান, বিশেষ করে নারীরা।
• স্ট্রেস ব্যবস্থাপনা: যোগব্যায়াম, ধ্যান, বা পর্যাপ্ত ঘুম মানসিক চাপ কমায়।
• ধূমপান ত্যাগ: ধূমপান থাইরয়েড ফাংশনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
• ওজন নিয়ন্ত্রণ: স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন।