13/09/2025
ডিপ্রেশন যে কি ভয়াবহ মানসিক ব্যাধি যারা এ রোগে ভুগছেন তারা তাদের কোন কাজ করতে পারেন না, কোন কিছুতে উৎসাহ পান না, ঠিকমত কারো সাথে কথা বলেন না, সারাদিন কান্নাকাটি করেন। ভয়াবহ অবস্থা! প্রথমে কেউ বুঝতে পারেন না। দিন দিন অবস্থা আরও খারাপের দিকে নিয়ে যায়।শুধু বিষণ্নতা রোগের কারণে নিজের তো বটেই, তার কাছের মানুষগুলোর জীবন পর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়।
আমরা অনেক সময় দুঃখবোধ(Sadness)ও বিষণ্ণতাকে(Depression)এক বলে মনে করি। এ দুটো কিন্তু এক নয়।
দুঃখবোধ হলো সাময়িক মন খারাপ যা অল্প কিছু সময় পরেই ঠিক হয়ে যায়। এর জন্য কোন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না।
অন্যদিকে, ডিপ্রেশন দীর্ঘকালীন সমস্যা। যা থেকে মুক্তি পাবার জন্য উপযুক্ত চিকিৎসার ও পরামর্শের প্রয়োজন হয়ে থাকে।
ডিপ্রেশন খমারাত্মক একধরণের মানসিক ব্যাধি যা আপনার অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা ও কাজকর্মের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কেন এ রোগ হয় নির্দিষ্ট করে কারো পক্ষেই তা বলা সম্ভব না। তবে অনেকের ক্ষেত্রেই কিছু কমন কারণ থাকে যার জন্য এ রোগের উৎপত্তি হতে পারে।
১. অপমানবোধ
মানসিক বা শারীরিকভাবে অবমাননার স্বীকার হলে অনেকে ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়।
২. নিরাপত্তাহীনতা বা একাকীত্ব
সামাজিক ও পারিবারিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেকে বিষণ্নতার স্বীকার হয়। তাছাড়া, বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব বা অন্যান্য কাছের মানুষদের সাথে সম্পর্কহীনতা বা মতবিরোধ থেকেও অনেকে বিষণ্ণতায় ভুগে থাকে।
৩. মৃত্যুশোক
কাছের মানুষের মৃত্যু অনেকের ক্ষেত্রে বিষণ্ণতার ঝুঁকি বাড়ায়।
৪. বংশগত প্রভাব
পরিবারে কারো ডিপ্রেশন থাকলে তা অন্যদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
৫. জীবন পদ্ধতিতে বড় ধরণের পরিবর্তন
জীবনে বড় কোন পরিবর্তন ঘটলে তা থেকে অনেকে বিষণ্ণতায় ভুগে। চাকরি হারালে, অবসরে গেলে, আয় কমে গেলে, জায়গা পরিবর্তন করলে, বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে, এমনকি, নতুন বিয়ে করলেও অনেকে ডিপ্রেশনের শিকার হয়।
৬. বড় কোন রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
বড় ধরণের কোন রোগ থাকলে রোগী ডিপ্রেশনের শিকার হতে পারে।
৭. ঔষধের প্রভাব
নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ সেবনের ফলেও কেউ কেউ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়। যেমন, ব্রণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত আইসোট্রেটিনিয়ন বা অ্যান্টিভাইরাল “ইন্টারফেরন-আলফা” জাতীয় ঔষধ সেবনেও অনেকে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়।
এছাড়াও আরও বিভিন্ন কারণে মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগে থাকে। ব্যক্তিভেদে বিষণ্ণতার কারণে পার্থক্য দেখা যায়।
কী করে বুঝবেন যে আপনি বিষণ্ণতায় ভুগছেন?
১. কাজের প্রতি অনীহা
আপনার শখের কাজগুলোতে আপনি ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে শুরু করবেন। কোন কাজেই উৎসাহ পাবেন না। সারাদিন শুয়ে-বসে থাকাকেই মনে হবে সবচেয়ে সহজ কাজ এবং এর বাইরে সকল কাজকেই বোঝা মনে হবে। এক সময় যে কাজে খুব আনন্দ পেতেন ডিপ্রেসশড্ হয়ে যাবার পর সে কাজেও কোন আগ্রহই খুঁজে পাবেন না।
২. খাদ্যাভাসে পরিবর্তন
ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হলে আপনার রেগুলার খাদ্যাভাসে পরিবর্তন দেখা দেবে। হয় আপনি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খাবেন আর নয়তো আপনার খাবারে অরুচি দেখা দেবে। এ ফলে আপনার ওজন দ্রুত বাড়বে বা কমতে থাকবে যা আপনার শরীরে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি করবে।
৩. দীর্ঘকালীন অনিদ্রা
দীর্ঘ সময় ধরে অনিদ্রা বিষণ্ণতার একটি লক্ষণ। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যারা বিষণ্ণতায় ভুগছেন তাদের আশি ভাগেরই অনিদ্রার সমস্যা রয়েছে। যেসব রোগীর দীর্ঘকালীন অনিদ্রাজনিত সমস্যা রয়েছে তাদের বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবতা তাদের চেয়ে তিন গুণ বেশি যাদের এ সমস্যা নেই। অনেক চিকিৎসকরা বিশ্বাস করেন, অনিদ্রা রোগের যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে বিষণ্ণতা রোগের তীব্রতা প্রশমন করা সম্ভব। যদি আপনার দীর্ঘকালীন নিদ্রাহীনতাজনিত সমস্যা থেকে থাকে, তবে আপনি হয়তবা বিষণ্ণতা রোগে ভুগছেন।
৪. অবসাদ
বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হলে অবসাদ আপনাকে গ্রাস করবে। তাই যখন দেখবেন আপনি অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন, কোন কিছুতেই উৎসাহ পাচ্ছেন না তখন বুঝবেন আপনি একজন ডিপ্রেশনের রোগী।
৫. নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাওয়া
বিষণ্ণতার কারণে আপনি নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে ফেলতে থাকবেন। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গ ভালো লাগবে না। সামাজিকতা অনেক সময় অসহনীয় হয়ে দেখা দেবে। একাকীত্ব ঘিরে ফেলবে আপনাকে যা আপনার অসুস্থতা আরো বাড়িয়ে তুলবে।
৬. সবকিছুতেই মনোযোগের অভাব
বিষণ্ণতার ফলে আপনি একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে যেতে থাকবেন। কোন কিছুতেই ঠিকভাবে মনোনিবেশ করতে পারবেন না। অন্যদের কথা মন দিয়ে শুনতে পারবেন না বা কোন আলেচনায় অংশ নিতে পারবেন না।
৭. সব বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব
দুঃখবোধ, আশাহীনতা ও হতাশা আপনাকে ঘিরে ফেলবে। সবকিছুতেই নেতিবাচক মনোভাব দেখা দিতে থাকবে।
৮. মাথা ব্যথা ও গাস্ট্রিকের সমস্যা
নিয়মিত মাথা ব্যথা ও হজমে সমস্যাও ডিপ্রেশনের লক্ষণ।
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায়:
1.মেডিসিন
2.সাইকোথেরাপি/cognitive behavior therapy(CBT)
ডিপ্রেশন আপনাকে অসহায় অবস্থায় পতিত করবে। ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন ধরণের থেরাপি ও চিকিৎসার পাশাপাশি নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। নিজের চেষ্টা না থাকলে এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। নিজের প্রতিদিনের কাজকর্ম, খাওয়া-দাওয়া, জীবনপ্রণালী এমনকি চিন্তা-ভাবনায় ও পরিবর্তন আনতে হবে ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির জন্য।
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির জন্য নিচের পয়েন্টগুলো সহায়ক হতে পারে-
১. রুটিনমাফিক চলা
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পেতে প্রতিদিনের জীবনকে একটা রুটিনের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। প্রতিদিনের কাজ-কর্মকে যদি একটা নিয়মের মধ্যে বেঁধে ফেলা যায় তবে তা ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে।
২. লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা
লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। ডিপ্রেশনে যেহেতু কোন কাজ করতে ইচ্ছা করে না তাই প্রতিদিন একটু একটু করে কাজ করার জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।
ধরা যাক, প্রথম দিন আপনি ঠিক করলেন আপনি আজ একটা মজার কিছু রান্না করবেন। যদি আপনি সেই কাজটা ঠিক মত করতে পারেন তবে পরের দিন আর একটু বেশি কিছু করার কথা চিন্তা করতে হবে। এভাবে ধীরে ধীরে কাজের সাথে সম্পৃক্ততা বাড়াতে পারলে এক সময় ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
৩. নিয়মিত ব্যায়াম করা
প্রতিদিন অল্প কিছু সময় ব্যায়াম করলে তা আপনার শরীর এবং মনকে সুস্থ রাখবে। ব্যায়াম করা মানে, ম্যারাথন দৌড় টাইপ কিছু না, আপনি যদি প্রতিদিন কিছু সময় হাঁটাহাটি করেন তবুও তা আপনার মস্তিষ্কে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যা আপনাকে ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করবে।
৪. সুষম খাদ্য গ্রহণ
সুষম খাদ্য গ্রহনের মাধ্যমে ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি মেলে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন খাবারে প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ থাকে। সাইক্রিয়াটিস্টদের মতে, যেসব খাবারে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এ্যাসিড এবং ফলিক এসিড থাকে সেসব খাবার ডিপ্রেশন কমাতে সহায়তা করে।
৫. অনিদ্রা দূর করা
পর্যাপ্ত ঘুম ডিপ্রেশন কমায়। ডিপ্রেশনের রোগীদের নিদ্রাহীনতা দেখা দেয়্। তাই, প্রথমেই ঘুম সমস্যার সমাধান করতে হবে। প্রতিদিনের জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে নিদ্রাহীনতা দূর করা সম্ভব। প্রতিদিন ঠিক সময়ে ঘুমোতে যাওয়া এবং সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। দিনের বেলার হালকা ঘুমের অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে। শোবার ঘর থেকে টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল এগুলো সরিয়ে রাখতে হবে। এভাবেই অনিদ্রা রোগ ধীরে ধীরে দূর করা সম্ভব।
৬. ইতিবাচক চিন্তা করা
ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকলে মানুষের মনে বিভিন্ন রকম নেগেটিভ চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। যেমন, আমিই বুঝি সবচেয়ে খারাপ, আমার মত দুঃখ কারো নেই, আমি সবার চেয়ে অসুস্থ, আমি ব্যর্থ একজন মানুষ- এই ধরণের চিন্তাগুলো সুস্থ হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। তাই, এই নেগেটিভ চিন্তাগুলোকে মন থেকে দূর করে পজিটিভলি চিন্তা করার চেষ্টা করতে হবে। যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিচার করতে হবে। আশাহত হওয়া যাবে না কোনভাবেই।
৭. আনন্দদায়ক কাজের মধ্যে সময় কাটানো
নতুন কিছু করার চেষ্টা করতে হবে। মজার কোন কাজ। যেমন, নতুন কোথাও ঘুরতে যাওয়া, মজার কোন বই পড়া, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া। মন ভালো রাখার সবরকম চেষ্টা করতে হবে। মন ভালো থাকলে ডিপ্রেশন কেটে যাবে একসময়।
৭. Psychiatrist ও সাইকোলজিস্টের পরামর্শ গ্রহণ ডিপ্রেশন পুরোপুরি না ভালো হওয়া পর্যন্ত পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।
ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা যে একটা রোগ, এদেশে সেটাই অনেকে বোঝে না। বা বুঝলেও তা স্বীকার করতে চায় না।