21/05/2025
ডায়াবেটিক ফুট কেয়ার। একটি জনসচেতনা মূলক পোষ্ট।
আমাদের শরীরের অতিপ্রয়োজনীয় অঙ্গ পা। এটি ছাড়া মানুষ অচল। তাই সব সময় পায়ের যত্ন নিতে হবে। ডায়াবেটিস রোগীকে পায়ের আরও বেশি যত্ন নিতে হবে সঙ্গত কারণেই।
‘ডায়াবেটিক ফুট : এটি একটি ডায়াবেটিস রোগজনিত পায়ের রক্তনালির জটিলতা। এ রোগে আক্রান্ত ১৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিতে পারে। পৃথিবীতে যত রোগীর পা কাটার প্রয়োজন হয়, তার মধ্যে ৮৪ শতাংশ হলো ডায়াবেটিক পা। ডায়াবেটিস রোগীর পায়ে আঘাত লাগলে বা ক্ষত হলে সেখানে ক্ষুদ্র রক্তনালির বিকাশ, এক্সট্রাসেলুলার ম্যাট্রিক্স, ত্বক ইত্যাদির বৃদ্ধি ধীরগতিতে হয়। ফলে ক্ষত নিরাময় প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় এবং ক্ষত শুকাতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এতে জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতস্থানে দুর্গন্ধযুক্ত পচন (গ্যাংগ্রিন) ধরে যায়। রোগীর জীবন রক্ষার্থে অনেক সময় পা বা পায়ের কিছু অংশ কেটে বাদ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
ঝুঁকি : ডায়াবেটিস রোগীর পায়ে ক্ষত তৈরিতে প্রধান কারণগুলো হলো
ক. ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি;
খ. কম রক্ত চলাচল এবং
গ. জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা।
ঝুঁকিপূর্ণ পা : পায়ে আগের কোনো ক্ষত বা পায়ের কোনো অংশের অঙ্গ ছেদ থাকলে। মোটা নখ, পায়ের হাড়ের জোড়ার সীমিত নড়াচড়া, হাড়ের অঙ্গবিকৃতি থাকলে। পায়ে জীবাণুর সংক্রমণ বা অন্যান্য সমস্যা, যেমন লাল চাকা, গরম হওয়া, কড়া পরা বা কড়ার নিচে রক্ত জমাট বাঁধা থাকলে। পায়ের বিভিন্ন রক্তনালির পালস বা ধমনির গতি না পাওয়া গেলে। পায়ের স্পর্শ অনুভূতি না থাকলে। পায়ের তাপ অনুভূতি না থাকলে। পায়ের কম্পন অনুভূতি না থাকলে। এ ছাড়াও পায়ের অঙ্গবিকৃতির কারণেও পা ঝুঁকিপূর্ণ হয়। যেমন পায়ের কোনো আঙুলের সামনের অংশ নিচের দিকে বেঁকে থাকা, পায়ের মেটা-টারসাল হাড় উঁচু হয়ে থাকা, পায়ের বৃদ্ধাঙুল দ্বিতীয় আঙুলের দিকে বেঁকে থাকা, পায়ের কনিষ্ঠ আঙুলের গোড়া ফুলে লাল হয়ে থাকা, পায়ের ছোট ছোট ওজনবাহী হাড়ের ক্ষয়জনিত পদবিকৃতি ইত্যাদি।
চিকিৎসা: সংক্রমণ ছাড়া পায়ের ছোটখাটো ক্ষত থাকলে অ্যান্টিসেপটিক সলিউশন, নিয়মিত ড্রেসিং ও পায়ের বিশ্রাম দিতে হবে। সংক্রমিত ক্ষত থাকলে তা চিকিৎসা কেন্দ্রের মাধ্যমে চিকিৎসা দিতে হবে। প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ, জীবাণুমুক্ত গজ ও যন্ত্রপাতির সাহায্যে ক্ষতস্থানের ড্রেসিং ও মৃত টিস্যু কেটে ফেলে দিতে হবে। পায়ের ক্ষত বেশি খারাপ হলে প্রয়োজনে নির্দিষ্ট অংশ কেটে বাদ দিতে হবে। পায়ের ওপর থেকে যে কোনো ধরনের চাপ কমাতে হবে। প্রয়োজন হলে ভাস্কুলার সার্জারি (পায়ের রক্তনালির অপারেশন) করাতে হবে। একই সঙ্গে ডায়াবেটিস পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ওজন কমাতে হবে। ডায়াবেটিক পায়ের চিকিৎসা চলাকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত ইনসুলিন নিলে ক্ষত দ্রুত শুকিয়ে যায়।
ওয়াগনারের শ্রেণীবিভাগ (০-৫) অনুযায়ী ডায়াবেটিক রোগীর পায়ের ক্ষত পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করা হয়।
গ্রেড ০ = নিখুঁত চামড়া, কোনও ক্ষত নেই তবে ঝুঁকিপূর্ন পা
গ্রেড ১ = চামড়া বা চামড়ার নীচের টিস্যুর ক্ষত
গ্রেড ২ = গভীর ক্ষত কিন্তু হাড় অনাক্রান্ত, কোনও ফোঁড়া/পুঁজ হয়নি
গ্রেড ৩ = অস্থির প্রদাহ সঙ্গে গভীর ক্ষত, বা ফোড়া/পুঁজ হয়েছে
গ্রেড ৪ = পচা ঘা (পায়ের আঙ্গুল ও পায়ের সামনের অংশ)
গ্রেড ৫ = পচা ঘা (সম্পূর্ণ পা)
চিকিৎসা
– সংক্রমন ছাড়া পায়ের ছোটখাট ক্ষত থাকলে এন্টিসেপটিক সলিউশন, নিয়মিত ড্রেসিং ও পায়ের বিশ্রাম দিতে হবে।
– সংক্রমিত ক্ষত থাকলে তা চিকিৎসা কেন্দ্রের মাধ্যমে চিকিৎসা দিতে হবে। প্রয়োজনীয় এন্টিবায়োটিক ঔষধ, জীবাণু মুক্ত গজ ও যন্ত্রপাতীর সাহায্যে ক্ষতস্থানের পরিচর্যা ও মৃত টিস্যু কেটে ফেলে দিতে হবে, পায়ের ক্ষত বেশী খারাপ হলে প্রয়োজনে নির্দিষ্ট অংশ কেটে বাদ দিতে হবে।
– পায়ের উপর থেকে যে কোনও ধরণের চাপ কমাতে হবে।
– প্রয়োজন হলে ভাস্কুলার সার্জারী (পায়ের রক্ত নালীর অপারেশন) করাতে হবে।
– একই সাথে ডায়াবেটিস পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ওজন কমাতে হবে।
– ডায়াবেটিক পা এর চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত ইনসুলিন নিলে ক্ষত সাধারনতঃ দ্রুত শুকায়।
ডায়াবেটিক রোগীর পায়ের যত্নঃ (Foot care for Diabetic Patients)
– অতিরিক্ত গরম পানি দিয়ে গোসল করবেন না, এতে পায়ের পাতা বা কোনও অংশ পুড়ে গেলে বা ফোস্কা পড়লেও পায়ের অনুভুতি কম থাকার কারনে বোঝা যায় না। তাই গরম পানি ব্যবহার করার সময় নিজে না দেখে ডায়াবেটিস নেই এমন কাউকে দিয়ে দেখতে হবে পানি বেশী গরম কিনা।
– হিটার বা আগুনের খুব কাছে বসবেন না, এতে অজান্তে পা পুড়ে যেতে পারে।
– পায়ে বেশী গরম পানির সেক দিবেন না, এতে ফোস্কা পড়তে পারে।
– ঘুমানোর সময় বিছানায় গরম পানির বোতল, বৈদ্যুতিক কম্বল ইত্যাদি ব্যবহার করবেন না।
– পায়ে যে কোনও ধরনের আঘাতের সম্ভাবনা এরিয়ে চলবেন। যে সব খেলা ধুলায় পায়ে আঘাত লাগার সম্ভাবনা থাকে, সে সব খেলা ধুলা পরিহার করতে হবে। এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা দিয়ে না হেঁটে ভালো রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে চেষ্টা করবেন। ভিড়ের মধ্যে হাঁটার সময় খেয়াল রাখবেন যাতে আপনার পায়ের উপর অন্য কারও পায়ের পাড়া না পরে।
– ঘরে সবসময় কাপড়ের জুতা বা নরম রাবারের জুতা পড়বেন। নরম স্পঞ্জের স্যান্ডেল পড়তে পারেন। তবে স্যান্ডেল না পড়াই ভালো, কারণ, ডায়াবেটিস রোগীর পায়ের অনুভুতি কম থাকার ফলে পা থেকে স্যান্ডেল খুলে গেলেও তারা বুঝতে পারেন না।
– বাইরে বের হলে অবশ্যই ডায়াবেটিক জুতা-মোজা পরে বের হবেন। জুতা পড়ার সময় জুতার ভিতর ঝেড়ে নিতে হবে যেন ভিতরে কোন ইট, লোহা বা কোন কিছুর টুকরা না থাকে।
– গোসলের পর নখ কাটবেন, এসময় নখ নরম থাকে এবং সহজে কাটা যায়।
– নখ সব সময় সোজা করে কাটবেন, গভীর করে নখ কাটবেন না, নখের কোণা কাটবেন না।
– শেভিং ব্লেড দিয়ে নখ না কেটে নেইল কাটার দিয়ে সব সময় নখ কাটবেন। না হলে নখ বেশী কাটা হয়ে যেতে পারে এবং আঙ্গুলের চামড়া বা মাংশে ক্ষত সৃস্টি হতে পারে।
– পায়ের উপর পা রেখে বসা বা ঘুমানোর অভ্যাস ত্যাগ করুন। এতে পায়ে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
– পায়ের কড়া বা নখকুনী থাকলে নিজে নিজে তা কাটতে যাবেন না। আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
– ধাতব কোনও বস্তু দিয়ে নখের নীচ পরিস্কার করবেন না।
– নখ কাটতে ব্যথা অনুভব করলে অথবা রক্ত বের হলে আপনার চিকিৎসকের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করুন।
– সম্ভব হলে প্রতিদিন আপনার পায়ের তলা, পায়ের আঙ্গুল, আঙ্গুলের ফাঁক পরীক্ষা করুন। এজন্য আয়না ব্যবহার করতে পারেন অথবা অন্য কাউকে দেখে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করুন।
– পায়ে নিয়মিত ভালো কোনও ময়েশ্চারাইজার মাখতে পারেন। কিন্তু পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে মাখবেন না।
– বৃস্টির পানিতে পা ভেজাবেন না।
– শীত কালে রাতে ঘুমানোর সময় ঢিলা মোজা পরে ঘুমান।
– পা ফাটা থাকলে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন, নিজে নিজে কোনও চিকিৎসা করবেন না।
– দীর্ঘ সময় জুতা-মোজা পড়ার প্রয়োজন হলে ২ ঘণ্টা পর পর কিছু সময়ের জন্য জুতা-মোজা খুলে আবার পড়বেন। সম্ভব হলে কয়েক জোড়া জুতা-মোজা কিনে রাখবেন। প্রতিদিন একই জুতা না পরা ভালো।
– ভেজা পায়ে জুতা-মোজা পড়বেন না। ভেজা মোজা পড়বেন না।
– ভেজা পা আলাদা তোয়ালে দিয়ে চাপ দিয়ে চাপ দিয়ে মুছবেন, কখনই ঘষে ঘষে মুছবেন না।
ডায়াবেটিক জুতা ও মোজাঃ
সঠিক আকার ও সাইজের চামড়ার জুতা কিনতে হবে, যাতে জুতা টাইট বা বেশী ঢিলা না হয়। সম্ভব হলে অর্ডার দিয়ে জুতা বানিয়ে নিতে পারেন। সমান তল ও মোটা সোল বিশিষ্ট জুতা সব চেয়ে ভালো। জুতার সামনের অংশ চওড়া হতে হবে যাতে পায়ের আঙ্গুলগুলোর উপর চাপ না পরে। সামনের অংশ চিকন – এ ধরণের জুতা পড়বেন না। উঁচু হিলের জুতা বর্জন করুন। জুতা কিনবেন বিকাল বা সন্ধ্যার সময়। কারন এ সময় পায়ের মাপ সর্বোচ্চ থাকে। মোজা কিনবেন সুতী দেখে। মোটা মোজা পরিধান করা উচিৎ। মোজা পড়ার সময় খেয়াল রাখবেন যেন মোজা কোথাও ছেঁড়া না থাকে। প্রতিদিন ধোয়া ও শুকনা মোজা পড়বেন।
সব শেষে আবারও মনে করিয়ে দেই, ডায়াবেটিস রোগীদের পা কেটে ফেলার সম্ভাবনা সাধারণ রোগীর তুলনায় ২০ গুন বেশী। তাই ডায়াবেটিস পূর্ন নিয়ান্ত্রনে রাখতে হবে, ওজন কমাতে হবে, ধুমপান, সাদাপাতা/জর্দা দিয়ে পান খাওয়া বা মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা পরিত্যাগ করতে হবে। না হলে এত কষ্ট করে পায়ের যত্ন নিয়েও কোনও লাভ হবে না। ছবি ও তথ্য সূত্র ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
ডাঃ ইমরান চৌধুরী
অধ্যাপক ও রিকনস্ট্রাকটিভ প্লাস্টিক সার্জন
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ধানমন্ডি, রোড নং ৮, ব্লক - এফ, রুম নং- ৬৩০৫, ৩য় তলা।
কনট্যাক্ট পারসন: জনাব মিজান
এপয়েনটমেনট নিতে ফোন করুন এই মোবাইল নম্বর গুলোতে: 01706401952 ও 01806420515