11/10/2025
# ডিভোর্স
প্রশ্নটা শুনে চমকে উঠলাম।
- স্যার আপনার সাথে কোন ডিভোর্স লইয়ারের পরিচয় আছে?
বয়সে তরুণ জাহাজের সেকেন্ড অফিসার, মাত্র ত্রিশের কোঠা পেরিয়েছে।
বিয়ে করেছে সম্ভবত বছর তিনেক হবে। একটা ছোট মেয়েও আছে এক বছর বয়সী......
ছেলেটাকে বেশ কিছুদিন ধরেই উদ্ভ্রান্ত দেখছি। চোখ কিছুটা লালচে থাকে, হয়ত রাতে ভাল ঘুমও হচ্ছে না। সবসময় তো আর ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্ন করা যায় না, যতক্ষণ নিজ হতে মুখ না খোলে।
জাহাজ খুব ছোট জায়গা। মানসিক অবস্থা কলিগদের কাছ থেকে বেশীক্ষণ লুকিয়ে রাখা কঠিন।
তবে জাহাজের একটা ইউনিক বৈশিষ্ট্য হল, এখানে সবাই খুব খোলামনে একে অপরের সাথে ব্যক্তিগত জীবনও শেয়ার করে।
এর দুটো কারণ থাকে। প্রথমত পারিবারিক সম্পর্ক না থাকায় কোন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।
দ্বিতীয়ত একটা নির্দিষ্ট সময় পরে সবাই যার যার গন্তব্যে চলে যায়, হয়ত এই জীবনেই আর দেখা হয় না৷
আজকাল খুব বেশী হলে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে একে অপরকে এড করে নেয়।
কাছে ডেকে বসালাম।
- কি সমস্যা বল তো?
- স্যার আমার ওয়াইফের সাথে আর সংসার করা সম্ভব না। এত সমস্যা নিয়ে কারো সাথে এক ছাদের নিচে থাকা যায় না।
- তোমাদের তো ছোট্ট একটা রাজকন্যা আছে...৷
- স্যার তাই বলে আমাদের নিজেদের জীবনও নষ্ট করব? আমার মেয়ে যে ভাগ্য নিয়ে এসেছে তাই হবে। এত যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না৷
- তোমার ওয়াইফের অপরাধগুলো কি কি বল তো।
- আমাদের বাসায় থাকতে চায় না। আমার মা আর ভাই বোনদের সাথে দুর্ব্যবহার করে। আমাকে না বলে বাবার বাড়ি চলে যায়।
বাচ্চাকে ওর মায়ের কাছ রেখে অফিস করে, আমার মায়ের কাছে দেয় না। একেকবার গেলে এক সপ্তাহ আর আসার নাম করে না।
- কিন্তু তুমি তো শিপে।
- হ্যাঁ, কিন্তু আমার বউ আমার বাসায় থাকবে না?
এখন মাথা গরম। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু না বলাই ভাল। মাথা ঠান্ডা হোক আগে।
ওকে আশ্বস্ত করলাম যে, একবার ল্যান্ডে নেমে নেই, ডিভোর্স নিশ্চিত।
বেশ কদিন বিভিন্ন অজুহাতে ওর সাথে গল্প করার পর কাহিনী ধীরে ধীরে পরিস্কার হল।
সেকেন্ড অফিসারের নাম সৈকত।
- আচ্ছা সৈকত, আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিবে?
- জি স্যার বলেন।
- তোমার বিয়ের তিন বছর পেরিয়েছে, বউ আর বাচ্চার হাতখরচ মায়ের মাধ্যমে কেন দাও?
- বিয়ের আগে হতেই মায়ের সাথে জয়েন্ট একাউন্ট...
- বিয়ের পর তোমার বউকে একটা একাউন্ট খুলে দিতে কিংবা তোমার সাথে আরেকটা জয়েন্ট একাউন্ট খুলতে পারত।
কোন বউয়ের তো শাশুড়ির কাছে বারবার হাত পাততে ভাল লাগবে না। আর তোমার বউ বাবার বাড়ি গেলে নাকি হাতখরচ আটকে রাখে।
- হ্যাঁ৷ স্যার। আমার বা আম্মার কথা না শুনলে কিসের হাতখরচ।
- আরে তোমার মেয়ে আর সংসারের খরচ আছে না। তোমার বউ কি টাকা নষ্ট করে কিংবা ঊড়ায়?
- তা উড়ায় না স্যার। কিন্তু কন্ট্রোলে তো রাখতে হবে।
- ভরণপোষণ তো ওদের অধিকার, কোন দয়াদাক্ষিণ্য না।
আচ্ছা, তুমি আমাকে সবসময় বউয়ের বদনাম কর। ওর কি কোন গুণই নাই?
- সেটা আছে স্যার। এমনিতে অনেক গুণ........
মেধাবী, স্বভাব চরিত্র ভাল, বাচ্চার যত্ন নেয়, দেখতে সুন্দরী... লম্বা...
আমি হা হয়ে গেলাম। গুণে গুণে ৮ টা ভাল দিক উল্লেখ করল সৈকত।
- এত গুণী একটা মেয়েকে ডিভোর্স দিতে চাইছ?
- জি স্যার, গত ৩ মাস ধরে শুধুই ঝগড়া হচ্ছে। আর পারি না।
- আচ্ছা, আমি জিজ্ঞেস করার আগ পর্যন্ত বউয়ের যত বদনাম করেছ এগুলো তুমি কিভাবে জেনেছ। তুমি তো ৫ মাস ধরে শিপে।
- স্যার, আমার মা আর ভাই বোনেরা বলেছে।
- আচ্ছা, ওরা কি কখনো তোমার বউয়ের প্রশংসা করে কখনো কিছু বলেছে?
খুব চিন্তায় পড়ে গেল সৈকত।
- জি না স্যার, মনে পড়ছে না।
- তোমার এত গুণী বউ, কিন্তু তোমরা কেউ কোন প্লাস পয়েন্ট পাও না? তোমার ফ্যামিলি আদৌ কি চায় তোমার সংসার টিকুক?
সারাক্ষণ তোমাকে নেগেটিভ কথা বলে কানভারি করতে থাকে। এখন হতে ওরা যখনই তোমার বউ সম্পর্কে কিছু বলতে যাবে, থামিয়ে দিবে। পারবে না?
মাথা নাড়ল সৈকত। দ্বিধায় আছে বুঝাই যাচ্ছে। তবে সুর নরম করল।
- জি স্যার।
- আচ্ছা, তুমি রোজার ঈদে নাম উল্লেখ করে টাকা পাঠিয়েছিলে। তবুও তোমার ফ্যামিলি তোমার শ্বশুর শাশুড়িকে কাপড় কিনে পাঠায়নি কেন? ওদের তো মন খারাপ হবার কথা।
তোমার ওয়াইফেরও মন ছোট হবে।
- সময় পায়নি মনে হয়।
যদিও মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে, ওর উত্তরটা নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না।
- তাহলে টাকাটা ওদের ভাবীকে দিয়ে দিত। তাও তো দেয়নি৷ বুঝাই যাচ্ছে, সংসারে খরচ করে ফেলেছে।
একটু থেমে আবার বললাম,
- তোমার বিয়ের গহনা তিন বছর হয়ে গেলেও এখনো তোমার ওয়াইফকে বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। তোমার মা রেখে দিয়েছেন।
এগুলা তো তোমার ওয়াইফের আমানত। ওকে তোমরা উপহার দিয়েছ কিংবা বিয়েতে পেয়েছে। এজন্য কাবিননামায় উসুলও কেটেছ।
এখন এগুলা আটকে রাখার যৌক্তিকতা কি? গহনা নিয়ে পালিয়ে যাবে? তোমার বউকে তোমার ফ্যামিলি বিশ্বাস করে না?
- ঠিক তা না... আর কথা খুঁজে পেল না সৈকত।
- তুমি কেমন হাজবেন্ড? তোমার ওয়াইফের সাথে ব্যাংক একাউন্ট নেই, টাকা পয়সা কিংবা গহনা আটকে রাখ, তোমার বউয়ের জন্য উপহার নিয়ে গেলে অন্যরা ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে যায়,
ফ্যামিলি হতে খুব আগ্রহ নিয়ে সারাক্ষণ বদনাম শুনে বিশ্বাস করে বউকে ফোন দিয়ে ঝগড়া কর,
তোমার অবিবাহিত ছোট বোনের নামে তোমার পাঠানো টাকার গরুতে কুরবানির ভাগ দেয়া হয় কিন্তু তোমার বউয়ের নাম কুরবানির লিস্টে দাও না,
এমনকি কুরবানির মাংস তুমি বলার পরও তোমার শ্বশুরবাড়িতে নানা অজুহাতে পাঠানো হয় না,
ওদের কথায় তোমার মেয়ের মাকে ডিভোর্স দিতে রাজি হয়ে যাও, তোমার ফ্যামিলি একবার তোমার ওয়াইফকে বাসা হতে বের হয়ে যেতে বললেও তুমি ফ্যামিলির পক্ষ নাও...
মাথা নিচু করে রইল সৈকত। পিঠে হাত বুলিয়ে হালকা স্বরে বললাম,
- এখনো সব শেষ হয়ে যায়
নি৷ তোমার ওয়াইফকে ফোন করে সব ভুলগুলো উল্লেখ করে সরি বল। ওয়াইফের দিকে তুমি এক কদম আগালে মেয়েটা তোমার দিকে দশ কদম আগাবে।।
মেয়েরা খুব বাধ্য না হলে ছোট বাচ্চা রেখে সংসার ভাঙ্গে না। আর তোমার ফ্যামিলির কেউ ফোন করলে ওদের ভাবীর প্রসঙ্গে একটা শব্দও শুনবে না।
বলবে, অন্য কথা থাকলে বল। আলাদা বাসা নেয়াও একটা সমাধান তবে এই বুদ্ধি দিচ্ছি না।
একা ছোট বাচ্চা নিয়ে চলাফেরাও কঠিন আর নিরাপদ না। সবাইকে চাপ দিয়ে ধীরে ধীরে তোমাদের বাসায় তোমার ওয়াইফের সম্মান ফিরিয়ে দাও।
যে ভুলগুলো হয়েছে, সব শুধরে নাও। তোমার ওয়াইফের আর্থিক স্বচ্ছলতা আর প্রাইভেসি যাতে বজায় থাকে সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্বও তোমার।
কয়েকদিন পর সৈকতের হাসিমুখ দেখেই বুঝলাম, পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। ছেলেটা পরের কদিনেই আমূল বদলে গেল।
একদিন কাছে এসে অশ্রুসজল চোখে লাজুক স্বরে বলল,
- স্যার আপনার বুদ্ধিতে কাজ হয়েছে।
ভুল বুঝাবুঝি আর নেই। এখন হতে সতর্ক হয়ে চলব। পরের কথা শুনার মাশুল এভাবে দিতে হবে ভাবি
নি। ওয়াইফকে সব খুলে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, এরকম ভুল আশা করি আর হবে না।
একটু থেমে যোগ করল,
আপনার পরিচিত ট্রাভেল এজেন্ট আছে? সাইন অফ করে মেয়ে আর ওয়াইফকে নিয়ে সপ্তাহখানেকের জন্য ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে ঘুরতে যাব।
ওর মনের ভাঙ্গা অংশও জোড়া লাগাবার চেষ্টা করব। বিয়ের পর ফ্যামিলির চাপে দেশের বাইরে যাওয়া হয়
নি।
আমি হেসে ফেললাম, স্বস্তির হাসি। ভাঙ্গনের মুখ হতে একটা পরিবার অন্তত বাঁচল।
সৈকতও হাসছে.....।
- এবার শক্ত করেই ওর হাত ধরেছি। ইনশাআল্লাহ ঝড়, বৃষ্টি কিংবা সাইক্লোনেও আর ছাড়ব না...!!
# ছোটগল্প
সত্য ঘটনা অবলম্বনে
Atique UA Khan