29/11/2025
আমার স্বামীর প্রিয় খাবার ছিলো, ইলিশ পোলাও।মাছ দিয়ে যে বিরিয়ানির মতো করে পোলাও রাঁধা যায় সেকথা আমি বিয়ের আগে জানতামই না।
শ্বাশুড়িমা একথার জের ধরে বলেছিলেন,ছোট খানদানের মাইয়া।পান্তা ভাত আর পুঁটি মাছ খাইয়া অভ্যাস, ভালো খাবার চিনবে কেমনে?
খুব লজ্জা লেগেছিলো সেদিন।
ঢোঁক গিলার মতো করে সেই লজ্জাটাকেও হয়তো গিলে নিয়েছিলাম।নাহলে কি আর সংসার করা হত?
মা-চাচী সকলে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েছেন, বড়োঘরে তোমার বিয়ে দিচ্ছি। মানিয়ে গুছিয়ে থাকবে। যা বলে তাই করবে।মনে রেখো লাল শাড়ি পরে যাচ্ছো ওবাড়িতে আর ফিরবে কিন্তু সাদা শাড়ি পরেই।
তখন আমার কতোই বা বয়স? বড়জোর ষোলো কিংবা সতেরো।
রঙিন সুতোয় যেমন করে নকশিকাঁথায় নকশা করতাম তেমন করেই তো সংসারটাকেও বুনতে চেয়েছিলাম।মনের সব রং,ভালোবাসা উপড়ে ঢেলে দিয়েছিলাম নিজের সংসারে।যদিও,কখনো হিসাব করা হয়নি ওটা আদতে কতটুকু নিজের সংসার ছিলো! হিসেবে বরাবরই বড্ড কাঁচা ছিলাম আমি।
দেখতে দেখতে দিন গেলো, মাস গেলো, বহু বহু বহু বছরও গেলো। সময় মানুষকে সব ভুলিয়ে দেয়, একথা সত্যিই। তবুও,হুটহাট করে মনের কোণে ডুবন্ত খন্ড খন্ড স্মৃতিরা উঁকিঝুঁকি দিয়ে বসে প্রায়শই।
এইতো আজ ভোর সকালে, আমার একমাত্র ছেলের বউ টেলিফোন করে হঠাৎ আমায় বললো,মা আপনার হাতের স্পেশাল ভুনা খিচুড়ি রান্নাটা আমায় একটু শিখিয়ে দিবেন প্লিইইজ?
এরকম ছেলেমানুষী কন্ঠের আব্দার শুনে হেসেই ফেললাম আমি।
বললাম,মা গো।তুমি এই যুগের মেয়ে।রান্নাবান্নার কৌশল আমার চেয়ে কি কম জানো? কিসব ইউটিউব ফিউব দেখো, কতো নামীদামী রাঁধুনীদের ভিডিও.......
সে অধৈর্য্য হয়ে মাঝপথেই থামিয়ে দিলো।বললো,মা রাগীব তো প্রায়শই আপনার রান্না করা খিচুড়ি, আচার,মাংস এসবের খুব খুব তারিফ করে। রেস্তোরাঁর রান্নাও নাকি ফেইল আপনার হাতের যাদুর কাছে।তাই,ভাবলাম বর্ষার মৌসুম তো এসেই পরছে।আমি আপনার থেকে সেই যাদু শিখে একদম ওকে তাক লাগিয়ে দিই।কি বলেন?
আমি হেসে ফেললাম।
- আচ্ছা এই কথা? তাহলে,আমি তোমায় বলছি কিভাবে রাঁধতাম, তুমি লিখে নাও।
.
রাগীব আমার একমাত্র ছেলে।আকাশে ইশান কোণে একটু মেঘ দেখলেও সে হুড়োহুড়ি করে এসে বলতো,আম্মা বৃষ্টি আসবে।বৃষ্টির দিনে একটু খিচুড়ি না হলে কি জমে?
এই একটা খাবারের মধ্যে ও যে কি পায় ঠিক আমি জানিনা।এত্তো পছন্দ করে!
সেই ছোট্ট থেকে আজ অবধি এই বিষয়টিতে একটুও বদল এলোনা।চাকরিসূত্রে ওরা দূরে থাকে। মন চায় পাখির মতো উড়ে চলে যাই ওদের কাছে।তবে,কেনো জানি শহরে নিজেকে বন্দি বন্দি লাগে।
গ্রামের মেয়ে আমি।কিষাণের মেয়ে।মাঠ ভরা সোনালী ধানের গন্ধ আমার চির চেনা।বর্ষার ব্যাঙের ডাক, টিনের চালে পরা বৃষ্টির রুমঝুম শব্দ, কাদামাটির সোঁদা গন্ধ, ঝুম দুপুরে ঘুঘুর ডাক - এইসবই আমার চিরচেনা সঙ্গী।তাইতো,ছেলে-বউমা শত জোরাজোরি করলেও ওদের কাছে খুব একটা যাওয়া হয়না।বরং ওরাই আসে ছুটিছাটায়।
কিন্তু,এবার মনে হলো ঘুরে আসি। বউমা যেভাবে আটঘাট বেঁধে প্রস্তুতি নিচ্ছে আমার মতো খিচুড়ি রেঁধে স্বামীকে চমকে দেবে সেই চমকের সাক্ষী হয়ে আমিও থাকি।
তাছাড়া,নিজের প্রথম জীবনের একটা স্মৃতির কথা খুব করে মনে পরে গেছিলো। ছেলের বউয়ের মধ্যে আমি যেনো তিরিশ বছর আগের সেই কিশোরী আমার একটা অংশকে দেখতে পেলাম হঠাৎ।
যে স্মৃতিতে ধুলো জমে ছিলো তা হঠাৎই উজ্জ্বল হয়ে ভেসে উঠলো মনের মধ্যে।
শ্বাশুড়ি মায়ের থেকে শিখেছিলাম ইলিশ পোলাও রান্নার কৌশল খুব আশা নিয়ে।এমন নয় যে তিনি খুব আগ্রহ ভরে আমায় শিখিয়েছিলেন।বরং,বেশ বিত্যক্তই ছিলেন। মুখ গোমরা করে কতো কি কথা শুনিয়েছিলেন।যার সারমর্ম এই যে,আমি ছোটলোক পরিবারের মেয়ে,আমার মা আমাকে ভালো মতো রান্নাবান্নাটাও শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠাননি শ্বশুর ঘরে।
তবে,,আমি সেসব কথা গায়ে মাখিনি।
খুব আগ্রহ আর আনন্দ নিয়ে রাগীবের বাবার জন্য ইলিশ পোলাও রেঁধেছিলাম নিজ হাতে।
ঠিক আজকের নিশার মতোই আমিও খুব করে অপেক্ষা করছিলাম মানুষটা ফিরে এসে যখন খেতে বসবে, তখন সে কতখানি চমকিত হবে.......
.
রাগীবের ফ্লাটের কলিংবেল বাজতেই নিশা অর্থাৎ আমার বউমা দরজা খুললো।দেখতে পেলাম তার ঘর্মাক্ত ক্লান্ত চেহারা।
আমাকে দেখে যারপরনাই অবাক হলো সে।কারণ,সাধারণত আরো বলে কয়েও শহরে আমাকে ঠিক সহজে আনা যায়না।
হেসে বললাম,তা হয়েছে রান্না তোমার?
এবার উৎফুল্ল হয়ে নিশা জবাব দিলো, হয়েছে তো।
উৎসাহ নিয়ে আমাকে সে দেখাতে লাগলো.....
ভূনা খিচুড়ি, টকমিষ্টি আচার,ডিমভাজা, বেগুন ভাজা আর মুরগির মাংস......
অবাক হয়ে বললাম,বাবা অনেক কিছু করে ফেলেছো দেখছি।
সে জানালো,হ্যাঁ মা এরজন্যই তো ক্লান্ত হয়ে পরেছি।এখন দেখা যাক আপনার ছেলে কতটুকু প্রশংসা করে।কে জানে ভালো লাগবে নাকি তার?
আমি স্বাদ চেখে বললাম,অবশ্যি তারিফ করবে মা।অনেক সুস্বাদু হয়েছে।
সে খানিকটা ভরসা পেয়ে হাসলো।
তবে খেতে বসে ছেলে তেমন একটা প্রতিক্রিয়া দেখালো না। নিশা খুব আগ্রহ নিয়েই সব তাকে সাজিয়ে খেতে দিলো।হাস্যমুখী হয়ে জানালো, আজ তার পছন্দের খাবারগুলি সে রেঁধেছে।
রাগীব অবশ্য শুকনো কন্ঠে বললো,আমি তো ভেবেছিলাম আম্মা বুঝি রেঁধেছে।
নিশা থতমত খেয়ে বললো,কেনো আমার রান্না ভালো হয়নি?
রাগীব বললো,হইছে ভালোই।কিন্তু,মায়ের রান্নার যা স্বাদ তার ধারে কাছেও নাই।
বলেই সে নির্বিকার ভঙ্গীতে খেতে লাগলো।
বউমার হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় মলিনতার ছাপ আমি স্পষ্ট দেখলাম।দেখলাম কি করে লজ্জা কিংবা অভিমানে সে মাথাটা নুইয়ে ফেললো।
আচ্ছা, আমার কি খুশি হওয়া উচিৎ? আমার ছেলে, আমার সন্তান আমার রান্নাকে সবার উপরে স্থান দিয়েছে। এভাবে বড়গলায় সে তারিফ করলো, আমার স্বাদের ধারেকাছেও বউমা যেতে পারবে না....এই তারিফে আমি কি খুশিতে আর কিছুটা আত্ম অহমিকায় সমুন্নত হবো?যেমনটা কোন এক কালে হয়েছিলেন আমার শ্বাশুড়ি?
সেই যে সেইদিনের ইলিশ পোলাও যা আমি রেঁধেছিলাম, সেই রান্নায় শুধু কি পোলাও চাল , ইলিশ,মশলাপাতি এইসবই মিশিয়েছিলাম? উঁহু মোটেও না।সঙ্গে তো হৃদয় নিংড়ানো অসীম ভালোবাসাও মিশিয়েছিলাম পরম যত্নে।
বলা বাহুল্য, সেই স্বাদ আমার স্বামীকে আকৃষ্ট করতে পারেনি।
এখন কি করতাম জানিনা, তবে সেসময় খুব আগ্রহ করে বারবার জানতে চাইছিলাম আমার রান্নাটা কেমন হয়েছে?
হয়তো,আমার বারবার জানতে চাওয়া তাকে বিরক্ত করে ফেলেছিলো।তিনি চেঁচিয়ে উঠেছিলেন জোরে।
ধমকে বলেছিলেন, এক্কেবারে উল্টায় ফেলছে অমৃত রেঁধে। যত্তোসব.... শিখতে পারো নাই ভালো করে আম্মার কাছে? তোমার রান্না কিছু হইছে? আম্মা কেমন রাঁধে দেখো না তুমি....
শ্বাশুড়িমা গর্বিত ভঙ্গীতে হেসে বলেছিলেন, কি আর করা ছোট খানদানের মাইয়া বইলা কথা।বাবা তুই কষ্ট করে আজকে খাইয়া নে।আমি তোরে পরে ভালোমতো রাইন্ধা খাওয়ামুনে.....
আমার রান্নার স্বাদ আসলে কতটুকু ছিলো আজ আর সেই তর্কে যাবোনা।তবে,খুউব কেঁদেছিলাম সেদিন।
হয়তো বাড়াবাড়ি,হয়তো অল্পতেই নেকামি করেছিলাম কিন্তু,কষ্ট পেয়েছিলাম এতো অমোঘ সত্যি।
রাগীবকে আমি বললাম, বউমা এতো কষ্ট করে রাঁধলো তোর জন্য আর তুই একটু দুইটা লাইন তারিফও করতে পারছিস না?
আমার কন্ঠে কিছু একটা ছিলো।রাগীব-নিশা দুজনেই অবাক চোখে আমার দিকে তাকালো।
আমি বললাম,, এভাবে ওর সাথে আমাকে তুলনা দিয়ে প্রশংসা করায় কিন্তু আমি মোটেও খুশি হইনি।
রাগীব একটু থতমত খেয়ে গেলো।বললো,আসলে ভালোই হয়েছে। আমি তো আর ওকে কষ্ট দিতে কথাটা বলিনি।আর,মা তুমি ভেবো নাহ।নিশা আজকালকার মেয়ে।ও এসবে কষ্ট পায়নি।
আমি বললাম, কষ্ট পেয়েছে কি পায়নি তা নিয়ে তুই পরে ভেবে দেখিস।এখন,আমি একটা কথা বলি শোন।কারো প্রশংসা করতে হলে কেবল তার প্রশংসাটুকুই করবি স্থান,কাল,পাত্র বুঝে। একজনের তারিফ করতে গিয়ে আরেকজনকে ছোট করবিনা। তোর মা ভালো রাঁধে, সেই কথা বলার সময় নিশ্চয়ই ফুরিয়ে যায়নি।বউ কষ্ট করে, ভালোবেসে রেঁধে এনেছে সেসময় একথা বলতে হবে কেনো?
রাগীব এবার খাওয়া থামিয়ে হেসে বললো,তোমরা মেয়েরা না মা অল্পতেই সিরিয়াস হয়ে যাও।
নিশাও খানিকটা এগিয়ে এলো।আমার হাত ধরে বললো,মা থাকনা।ও খাচ্ছে খাক।সমস্যা নেই।আমি কষ্ট পাইনি।আপনি আসলেও অনেক ভালো রাঁধেন,এটা তো সত্যিই।
আমি হেসে বললাম,তা তো সত্যি বটেই।প্রায় পয়ত্রিশ বছর ধরে রান্নাবান্না করছি,,আমার হাত তো পাকা হবেই।তোমার সদ্য বিয়ে হয়েছে, খুব একটা সময় তো হয়নি।তোমার সাথে আমার তুলনা দেওয়াটা তো বোকামি। তবে,শুরুর দিকে আমি তোমার চেয়ে ধরতে গেলে কম ভালোই রাঁধতাম।তুমি আজ চমৎকার রেঁধেছো আমি তো খেয়েছি।
রাগীবের খাওয়া শেষ হয়েছে।সে হাত ধুতে ধুতে বললো, আচ্ছা নিশা আমি স্যরি। আমি কথাটা আসলে অতো ভেবে বলিনি।তোমার রান্না বেশ ভালোই হয়েছে।
আমার আসলে বোঝা উচিৎ ছিলো,খাওয়াটা যতো সহজে হয়ে যায় রান্নাটা ঠিক ততোটাই কঠিন।এভাবে তুলনা দেওয়া আমার ঠিক হয়নি।
নিশা হাসলো।বললো,কোনো সমস্যা নেই।আমি কষ্ট পাইনি।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে শহরের দালানকোঠার ফাঁকফোকর দিয়ে আসা অস্তমিত সূর্যের আলো দেখছিলাম।
বউমা এসে আমার পাশে দাঁড়ালো।হাতে দুকাপ চা।
বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারে বসে বললো, মা আপনি ঠিকই বলেছিলেন, আসলেই আমার কষ্ট হয়েছিলো তখন।কিন্তু,কখনো ভাবিনি আপনি এভাবে আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলবেন....
আমি চায়ে চুমুক দিয়ে মৃদু হাসলাম।পাগল মেয়ে বলে কি! আমি তো ওর পক্ষ নয় আমি তো আমার পক্ষই নিলাম আজ।সেই যে আমি কতটা কেঁদেছিলাম একা একা।স্বামীর কথায়,শ্বাশুড়ির কথায়।
আজ,তো সেইদিনের সেই আমার পক্ষেই আমি কথা বললাম....
আমি তো শ্বাশুড়ি হবার আগে একজন বউ ছিলাম।আমি তো জানি একজন স্ত্রী,একজন বউ ঠিক কোন কথায় কষ্ট পায়,কোন সামান্য আঘাতে ভেঙে পরে কাঁচের মতো,কোন ব্যবহারটি তার দুচোখে জল আনে.....
চিরাচরিত নিয়ম হিসেবে যে কষ্ট আমি পেয়েছি, আমার শ্বাশুড়ি পেয়েছেন বউ থাকাকালীন কিংবা তারও আগের প্রজন্ম ; তা আমি আর বাহক হয়ে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছে দিতে চাইনা।এই প্রথার এখানেই সমাপ্তি ঘটাতে চাই।
কিছু_কথা
লেখিকা : লিলি
(অনুগল্প)
_______সমাপ্ত_______