11/11/2025
ডা: জাহাঙ্গীর কবির নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানের ডাক্তার।
~কিন্তুু ডাক্তারী পেশাকে তিনি বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বন্ধক দিয়াছেন...এখন ডাক্তারীর চাইতে ঔষধ কোম্পানির এসআর হিসাবে কাজ করছেন....😀
~নিচের প্রেসক্রিপশনটা তার প্রমাণ:-
✍️ন্যুনতম স্ট্যান্ডার্ডে প্রেসক্রিপশনে অবশ্যই সম্ভাব্য রোগের নাম, রোগীর সমস্যা, ভাইটাল সাইন, জেনারেল ফাইন্ডিং এগুলো থাকতে হয়। এই প্রেসক্রিপশন দেখে বোঝার উপায় নেই কি সমস্যায় এসব ওষুধ দেয়া হয়েছে। ফলে ওষুধগুলো আসলেই প্রয়োজনীয় কিনা তা যাচাই করার সুযোগ নেই।
তারচেয়ে বড় কথা এখানের ৭টি ওষুধের মাঝে ৭টিই নানা ধরনের ভিটামিন/ফুড সাপ্লিমেন্ট যা উপযুক্ত খাবারের মাধ্যমেই পুরন করা সম্ভব। মুলত এই প্রেসক্রিপশনটি ফুড সাপ্লিমেন্ট এর ব্যবসা বর্ধক ফর্মুলা ছাড়া কিছুই না এবং এ কারনেই ওষুধ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুসারে চিকিৎসকদের ফুড সাপ্লিমেন্ট লেখা নিষেধ।
চলুন দেখু কি কি "ওষুধ" লেখা হয়েছে। প্রথমটি Cap Acteria, একটি প্রোবায়োটিক। এতে মূলত কয়েক ধরনের উপকারী বাক্টেরিয়া থাকে যার অধিকাংশ ল্যাক্টোব্যাসিলাস গ্রুপের যা প্রচুর পরিমানে থাকে দই তে। এই ওষুধের প্রতি ক্যাপসুলে ৪ বিলিয়ন ব্যাটেরিয়া আছে, প্রতিটার দাম ৪৫ টাকা, দিনে ২টা করে ৩ মাসে মোট খরচ ৮ হাজার টাকা। অন্যদিকে ১ চামুচ দই তে গড়ে ১-১০ বিলিয়ন বাক্টেরিয়া থাকে। এবার হিসাব করুন এ চামুচ দই এর দাম কত। উল্লেখ্য কোন নির্দিষ্ট রোগ সারাতে এর সরাসরি ব্যবহার উপযোগীতা নেই বরং স্বাস্থ্যকর খাদ্যভ্যাস এর অংশ হিসেবে নানাবিধ রোগের ঝুকি ও উপসর্গ কমাতে নিয়মিত এ ধরনের উপকারী ব্যাক্টেরিয়া খাবারের সাথে গ্রহন করা বেশি উপকারী।
২য় ওষুধ ভিটামিন ডি। সূর্যের আলোর ভিটামিন অর্থাৎ আমাদের চামড়ায় সূর্য্যের আলো পড়লে এই ভিটামিন শরীরে তৈরি হয়ম এছাড়াও নানাবিধ খাবারে ভিটামিন ডি থাকে যেমন তৈলাক্ত মাছ, ডিমের কুসুম, কলিজা ইত্যাদি। তবে বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষেরই শরীরে ভিটামিন ডি কম। তাই এই সাপ্লিমেন্ট এর অনেকের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় হতে পারে যদি খাবার ও সূর্যের আলোর মাধ্যমে পুরন না হয়। দাম হিসাব করলে প্রতি ক্যাপ্সুল ৩৫ টাকা, সপ্তাহে ১টা করে ৬ সপ্তাহে ২১০ টাকা।
৩য় ওষুধ Santogen A-Z, মাল্টিভিটামিন, ১১টাকা পিস, দিনে ১টা করে ৬ মাসে, প্রায় ২০০০ টাকা। মানুষের কোন রোগের জন্যই মাল্টিভিটামিন খাওয়ার কথা চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোন বই বা গবেষণাপত্রে লেখা নেই। মানুষের শরীরে একই সাথে সব ভিটামিন এর অভাব কখনো হয় না। যেগুলোর অভাব নেই সেগুলো খেলে মল মুত্রের সাথে বেরিয়ে যায় (কিছু কিছু লিভারে জমা হয়)। ফলে এই ওষুধের বেশিরভাগ উপাদানই শরীর থেকে বেরিয়ে যাবে। কারও যদি কোন একটি দুটি ভিটামিজ বা মিনারেল এর অভাব থেকেও থাকে তারও উপকার হবে না কেননা এই মাল্টিভিটামিন এর বড়িতে সব ভিটামিন এত কম মাত্রায় যা যে অভাবজনিত প্রয়োজনীয় ডোজ এর তুলনায় অনেক কম।
৪র্থ ওষুধ, Carniten, এটি মানবদেহে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া একটি এমাইনো এসিড এবং প্রায় সব ধরনের প্রাণিজ খাবারে এটি পাওয়া যায়। যাদের লিভার বা কিডনি মারাত্নক ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা খিচুনী রোগের কারনে বিশেষ ওশুধ খাচ্ছে বা রেয়ার কিছু জেনেটিক রোগ ব্যতীত এই জিনিসের অভাব মানবদেহে হয়না। কিডনি ড্যামেজ হওয়া ডায়ালাইসিস রোগীদের ক্ষেত্রে এটি সাধারনত ব্যবহার হতে দেখা যায়। প্রেসক্রিপশনটি যার নামে করা হয়েছে তার এ ধরনের রোগ আছে কিনা জানা যায় নি কারন রোগের বিবরন লেখা নেই প্রেসক্রিপশনে। আর যদি কিডনি বা লিভার ড্যামেজ থাকে তাহলে অন্য যেসব ডিব্বা খাওয়ানো হচ্ছে সেগুলো তার জন্য আরও ক্ষতিকর হবে। প্রতি পিস ৫ টাকা করে ৩মাসে এর পেছনে খরচ ৯০০ টাকা।
পরের ওষুধ Algecal Dx, ক্যালসিয়াম (600g)+ভিটামিন ডি। অর্থাৎ উচ্চমাত্রার ভিটামিন ডি ক্যাপ্সুল আলাদা করে দেয়ার পরেও এই ক্যালসিয়ামের সাথে ভিটামিন ডি আবারও দেয়া হচ্ছে। বড়ি প্রতি ১৬ টাকা করে ৬ মাসে খরচ ২৮৮০ টাকা। এই স্পেসিফিক ক্যালসিয়াম বড়ির বিশেষত্ব হলো এটি ক্যালসিয়াম কার্বোনেট যা সামুদ্রিক শেওলা থেকে বের করা। ক্যালসিয়াম বড়ি কম খরচে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট রূপে পাওয়া যায় ৫০০ গ্রাম ৫ টাকায়। ওষুধ কোম্পানি কিছুদিন পর পর নতুন নতুন ক্যালসিয়াম বড়ি নিয়ে আসে শেওলার ক্যালসিয়াম, ঝিনুকের ক্যালসিয়াম ইত্যাদি ইত্যাদি। দাবী করে এগুলো সাধারন ক্যালসিয়াম এর চেয়ে বেশি শোষন হয় শরীরে অথচ এর পক্ষে শক্ত বৈজ্ঞানিক প্রমান নেই, যেটুকু আছে তাতে শোষনের পার্থক্য খুব বেশি নয়। সুতরাং ৫ টাকার যায়গায় ১৬ টাকার বড়ির কোন মানে নেই। এছাড়ায় দুধ, ডিম, হাড়, গাঢ় সবুজ শাক, কলিজা, মাছ, মাংশ ইত্যাদিতেও ক্যালসিয়াম থাকে। বাংলাদেশের মানুষের শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব জনিত রোগের প্রকোপ বেশি তাই এটি জরুরী।
৬ নাম্বার ওষুধ, Ubi Q, এটি একটি এনজাইম CoQ10 এর এক্টি রূপ যা আমাদের শরীর নিজেই তৈরি করে। একবারে সুনির্দিষ্ট কিছু হৃদরোগ ছাড়া বাইরে থেকে এই সাপ্লিমেন্ট গ্রহনের পক্ষে কোন শক্ত ক্লিনিক্যাল এভিডেন্স নেই। ওষুধ কোম্পানি এটাকে "দুর্বলতা কমানো/বয়স ধরে রাখা/ইমিউনিটি বুস্টার" ইত্যাসি চটকদার উপায়ে প্রমোট করে। এসবের পক্ষে শক্ত বৈজ্ঞানিক প্রমান নেই। শরীর এটাকে নিজেই তৈরি করে। এই প্রেসক্রিপশনে ১০০ মিলিগ্রাম Ubi Q, ৪৫ টাকা পিস দরে, দিনে ২টা করে ৬ মাসে খরচ ১৬,২০০ টাকা! ওদিকে গরুর হার্টে প্রতি ১০০ গ্রামে ১০ মিলিগ্রাম, মাংসে ৩-৪ মিলিগ্রাম, মুরগিতে ২-৩ মিলিগ্রাম, তৈলাক্ত মাছে ৪-৮ মিলিগ্রাম, ডিমের কুসুমে ১-২ মিলিগ্রাম এই এনজাইম থাকে।
ফাইনালি ৭ নাম্বার হলো ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, ১০০০ মিলিগ্রাম। মাছের তেল ও ভেষজ তেল (সরিষা, সয়াবিন, চিয়া সিড, বাদাম) এ প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায়। ১০০ গ্রাম সরিষা তেলে ৫০০০ মিলিগ্রামের বেশি ওমেগা-৩ থাকে। ১০০ গ্রাম রুই মাছে ৬০০ মিগ্রা, ১০০ গ্রাম পাঙ্গাসে ১২০০ মিগ্রা ওমেগা-৩ পাওয়া যায়। এই বড়িতে ১১ টাকা প্রতি পিসে ৩মাসে ৩৩০ টাকা খরচ। এই সাপ্লিমেন্টও ওষুধ কোম্পানি ইমিউনিটি বুস্টার, বলকারক, প্রদাহ নিবারক, হৃদরোগ থেকে সুরক্ষা ইত্যাদি নানা দাবী করে বিক্রি করে। আপাত সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে এসব দাবীর পক্ষে কোন বৈজ্ঞানিক প্রমান নেই। সুনির্দিষ্ট কিছু রোগ যেমন উচ্চ মাত্রার ট্রাউগ্লিসারাইড কমাতে এই সাপ্লিমেন্ট ব্যবহারের পক্ষে কিছু প্রমান আছে।
সুতরাং সব মিলিয়ে এই প্রেসক্রিপশনে খরচ ৩০ হাজার টাকার বেশি! অথচ কি রোগ, কি বৃত্তান্ত কিছুই লেখা নেই। সব ক'টি ওষুধই ফুড সাপ্লিমেন্ট যা নিয়মিত খাবারের মাধ্যমেই অনেক অনেক কম খরচে গ্রহন করা সম্ভব আরও অনেক বেশি পুষ্টি উপাদান সহ। ওষুধ প্রশাসন এর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পুরো প্রেসক্রিপশন ভরে শুধুমাত্র ফুড সাপ্লিমেন্ট লিখে যাচ্ছে এই লোক। একদিকে অন্যান্য চিকিৎসকদের নিয়মিত বিষোদগার করছে আবার নিজেই ৩০ হাজার টাকার সাপ্লিমেন্ট ধরিয়ে দিচ্ছে। এই প্রতারনা নিয়ে অনেকে অনেকবার লিখেছেন কিন্তু তার সেলিব্রিটি স্ট্যাটাস তাকে ইমিউন করে রাখে আইনের হাত থেকে। সম্ভবত এই রোগীর কাছ থেকে তিনি কোন ভিজিট রাখেন নি, কোন টেস্ট দেন নি, ৩০ হাজার টাকা ধোকাবাজি বড়ি বিক্রি করেছেন শুধু। তাতেই রোগি শতভাগ খুশি হয়ে এই প্রেসক্রিপশন শেয়ার করেছেন ফেসবুকে।
ডা. মো: মারুফুর রহমান
চিকিৎসক ও গবেষক
দ্যা ইউনিভার্সিটি অফ শেফিল্ড, যুক্তরাজ্য
সিনিয়র পারফর্মেন্স মিজারমেন্ট স্পেশালিস্ট, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সাস্কাচুয়ান, কানাডা