31/07/2025
১.
পিপড়ার লাইন দেখেছেন নিশ্চয়? খাবারের পাশে কিংবা দেয়াল জুড়ে?
পিঁপড়া যখন খাবার খুঁজে পায় তখন শরীর থেকে এক ধরনের গন্ধ ছাড়ে, যাকে বলে ফেরোমোন। এই গন্ধের পথ ধরে অন্য পিঁপড়ারা খাবারের কাছে যায়।
পিঁপড়াদের খাবার খুঁজতে ও সংগ্রহ করতে এই সিস্টেমটা খুব কাজে দেয়।
কিন্তু মাঝে মাঝে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে সৈনিক পিঁপড়াদের ক্ষেত্রে।
কোনো কারণে একটা পিঁপড়া যদি তার পেছনের পিঁপড়ার গন্ধ পায়, তখন পুরো সারিটা গোল হয়ে যায়। পিঁপড়ারা গোল হয়ে ঘুরতে থাকে।
একটি পিঁপড়া আরেকটাকে অনুসরণ করে, সেই পিঁপড়া অনুসরণ করে তার পরেরটাকে। এভাবে তারা একই বৃত্তে ঘুরতে থাকে। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে অনেক সময় মরে যায়।
পিঁপড়ার এই গোল চক্করকে বলে ‘অ্যান্ট মিল’, ডেথ স্পাইরাল বা 'সার্কেল অফ ডেথ'। মৃত্যু চক্র।
যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৈনিক পিপড়াগুলো খাবারের সন্ধান পায়, সেই প্রক্রিয়াই অনেক সময় মৃত্যু ডেকে আনে। ব্যাপারটা বিচিত্র।
২.
এই কওম আর এই যমীনের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সাথে পিঁপড়ার ওই সার্কেল অফ ডেথের একটা অদ্ভুত মিল আছে।
এই যমীনের মানুষ বারবার যুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবাদ করেছে, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আমরা বারবার রক্ত দিয়েছি, কোরবানি করেছি।
আমরা ব্রিটিশ আমলে ফিরিঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়েছি। যার দৃষ্টান্ত আমরা দেখি ফকির মজনু শাহ থেকে হাজী শরীয়াতুল্লাহ, তিতুমীর থেকে শুরু করে দুদু মিয়াঁ, উলামা ও পীরমাশায়েগণের প্রতিরোধে; রাহিমাহুমুল্লাহ।
তারপর ৪৭, ৬৯, ৭১, ৯০—এ আমরা আন্দোলন করেছি বারবার।
কিন্তু মানুষের চাওয়া পূরণ হয়নি না। প্রতিবারই অল্প অল্প পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি এই কওম। আমরা একই চক্রের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি।
আমরা আবার রক্ত দিয়েছি ২০২৪-এ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ২৪-এর পরেও আমরা সেই বৃত্তের বাইরে আসতে পারিনি। সমাজ ও রাজনীতির যে ময়লা-আবর্জনাগুলো জুলাইয়ের প্রকম্পনে সরে গিয়েছিল, তার অনেক কিছুই আবার পুরনো রূপে ফিরে আসছে, আসবে।
৪৭, ৬৯, ৭১, আর ৯০ এর সংগ্রামের পর যে ব্যর্থতা এই যমীনকে গ্রাস করেছিল, আবারও তার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
৩।
যখন অন্যায়-অত্যাচার যমীনে ছড়িয়ে পড়ে, যখন মঞ্জিলে মাকসুদ দেখা যায় না, যখন মানুষ হতাশ হয়ে পড়ে, যখন ইসলামের ‘শাআইর’ভূলণ্ঠিত হয় এবং সবখানে কুফর মাথাচাড়া দিয়ে উঠে— তখন করণীয় কী?
তখন আল্লাহর হুকুম কী?
আজ থেকে তিনশো বছর আগে এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন এই উপমহাদেশের অনন্য মহীরুহ ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহেলভী রাহিমাহুল্লাহ।
তিনি বলেছিলেন, এমন অবস্থায় সমাধান হলো—
ফুক্কা কুল্লা নিযাম
ভেঙে দাও বিদ্যমান সকল ব্যবস্থা।
ফুক্কা কুল্লা নিযাম অর্থ—যে সমাজনীতি, শাসননীতি ও অর্থনীতি আমরা আঁকড়ে আছি, একে সংশোধন করা সম্ভব না। সংস্কারের কোন সুযোগ নেই।
মুক্তি চাইলে একে ভেঙে দাঁড় করাতে হবে নতুন কাঠামো। আর সেই নকশাতেই হবে নয়াযুগের জীবনধারার নির্মাণ।
এই পরিবর্তন কিভাবে আসবে তাও তিনি বলেছেন।
- প্রয়োজন প্রথমে দাওয়াতের মাধ্যমে ব্যক্তির পরিবর্তন ও সমাজের পরিবর্তন।
- আর তারপর আসবে ব্যবস্থার পরিবর্তন।
যে পরিবর্তন আমাদের এই দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত করবে।
৪।
কিন্তু আমরা দুটো ভুল করছি।
আমরা আন্দোলন করছি, কুরবানী করছি, রক্ত দিচ্ছি। কিন্তু সঠিক আদর্শকে সামনে রাখছি না। সঠিক ব্যবস্থা তথা নিযামের জন্য আমরা কাজ করছি না।
আমরা তাৎক্ষণিক উপশমের দিকে নজর দিচ্ছি, রোগ নিরাময়ের দিকে নজর দিচ্ছি না।
দ্বিতীয় ভুল হলো, আমরা ব্যক্তি আর সমাজের পরিবর্তনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছি না। এই পরিবর্তনকে বাদ দিয়েই আমরা রাজনীতি এবং শাসনের পরিবর্তন চাচ্ছি। যা আসলে সম্ভব না।
৫.
পিপড়ার মৃত্যুচক্র থেকে মুক্তি পেতে চাইলে আমাদের ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসের বলা বৈপ্লবিক রূপান্তরের ফিকিরকে আকড়ে ধরতে হবে।
সাহাবী রিব’ঈ ইবনু আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর মতো আমাদেরকেও বলতে হবে,
আমরা এমন সমাজ চাই যেখানে ---
-মাখলুকের গোলামী থেকে বের হয়ে মানুষ এক আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করবে
- দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতের প্রশস্ততার দিকে ধাবিত হবে,
- নানা ধর্ম বাদমতবাদ, তন্ত্রমন্ত্রের গোলকধাঁধা আর অন্যায়, অবিচার থেকে বের হয়ে মানুষ ইসলামের আদলের দিকে ফিরে আসবে
যদি আমরা এই দায়িত্ব কাঁধে নিতে পারি, ইন শা আল্লাহ্ তাহলেই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসতে পারে। মৃত্যুচক্র বন্ধ হতে পারে। আর যদি আমরা তা না করি, তাহলে সৈনিক পিপড়ার ডেথ স্পাইরালই হয়তো হবে আমাদের নিয়তি।