04/08/2025
আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান এর নিকট একজন গণমাধ্যম কর্মী "জুবায়ের ফয়সাল" এর খোলা চিঠি.........
📨 খোলা চিঠি
প্রাপকঃ
ডা. শফিকুর রহমান
আমীর, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
জনাব,
আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
আমি আপনার দলের নেতা তো দুর, নিদেনপক্ষে একজন কর্মীও নই। সুতরাং বাস্তবিক অর্থে এই চিঠির কোন মূল্য আদৌ আছে কি না, আমি নিশ্চিত নই। আমি এই চিঠি আপনাকে লিখছি, জন্মের পর থেকে দেখে আসা রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইচ্ছা অনিচ্ছায় নিয়ন্ত্রিত বাজারব্যবস্থার একজন নিপীড়িত ভোক্তা হিসেবে। যে বাজারে, যখন যে মহাজন এসেছেন, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তার উৎপাদিত ন্যারেটিভ-ই আমাদেরকে কিনতে এবং গিলতে বাধ্য করা হয়েছে ৫৪টা বছর ধরে। আমি জানি না, এই চিঠি আপনি পড়বেন কি না, অবশ্য না পড়লেও ক্ষতি নেই।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একবার বলেছিলেন, “আমি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেবো” ছোট্ট এই এক লাইনের স্পীচ, কতো মারাত্মক শক্তিশালী ছিলো তা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম ৮১’র এক বেদনাবিধুর সকালে। না, আমার তখন জন্ম হয়নি। বুঝতে শিখে পত্রিকার পাতায় হেডলাইন দেখেছি, “একটি কফিনের পাশে বাংলাদেশ” সেদিন র*ক্তপিপাসু হাসিনা-এরশাদ জোট শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতি জিয়ার ভিশন-ই ধ্বংস করে দেয়নি, বরং অন্ধ করে দিয়েছিলো গোটা বাংলাদেশের চোখ।
সেই ঘটনার প্রায় চার দশক পর সেদিন টেলিভিশনে আমি শহীদ জিয়ার একটা প্রতিচ্ছবি দেখলাম, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল মঞ্চে। ডা. শফিকুর রহমান নামের একজন সত্তোরোর্ধ তরুণ, সামনে দাঁড়ানো কয়েক লাখ মানুষ, দেশ ও দেশের বাইরের কোটি কোটি বাংলাদেশিকে সাক্ষী রেখে, শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে অঙ্গীকার করছেন যে, আমরা ক্ষমতা পেলে বিলাসী হবো না, সুযোগ পেয়েই দু হাতে অর্থ কামাবো না, সরকারি প্লট/ফ্লাট নেবো না, প্রকল্পের অর্থ অনর্থক ব্যয় করবো না, ট্যাক্সবিহীন গাড়ি নেবো না, দুর্নীতি করবো না, চাঁদাবাজি করবো না… করতেও দেবো না। সরাসরি না বললেও এই বক্তব্যের মাধ্যমে আগামীর বাংলাদেশে আপনিও বগুড়ার দুর্ভাগা খোকার মতোই, রাজনীতিবিদদের জন্য অনেকটাই কঠিন করে তুললেন আগামীর রাজনীতিকে। তবে যাদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তুললেন, দেশপ্রেমের আফিম খাইয়ে যুগের পর যুগ গণমানুষের অধিকার হরণের মহোৎসব করতে থাকা সেইসব অসুররা বলবে, এইটা কেবলই “শো অফ” !
আবার সাধারণ কারো কারো কাছেও এই বক্তব্য হয়তো নিছকই রাজনৈতিক চাপাবাজি। কারণ, বুঝতে শেখার পর থেকেই দেখছি ওদেশে রাজনীতির ১০ শতাংশ সত্যি, ৯০ শতাংশই চাপাবাজি আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। আচ্ছা ডাক্তার সাহেব বলেন তো, চুন খেয়ে মুখ পুঁড়লে দই দেখলে ভয় লাগাটা কি স্বাভাবিক না? কিন্তু মহান আল্লাহর কি ইশারা দেখেন, আপনাকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না। আপনার সামনে সুযোগ এলো, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অঙ্গীকার যে শুধুমাত্র কথার কথা ছিলো না সেইটা প্রমাণের। আপনি মারাত্মক এক অসুখে আক্রান্ত, আপনার হৃদযন্ত্রে পাঁচটি ব্লক। আপনাকে ইমিডিয়েটলি যেতে হবে ডাক্তারদের ছুরি কাঁচির নীচে। আপনার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, রাজনৈতিক সহকর্মীদের সবাই আপনাকে অনুরোধ করলো সার্জারিটা দেশের বাইরের কোন হাসপাতালে করাতে। আপনি দাঁড়িয়ে গেলেন, স্রোতের বিপরীতে ! যেন হঠাৎ করেই হয়ে উঠলেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের “আঠারো বছর বয়স” কবিতার সেই ডানপিঠে তরুণ। দেশপ্রেম যার সাড়ে তিন হাত দেহের পুরোটাজুড়েই। আচ্ছা বলেন তো ডাক্তার সাহেব, জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এমন জুয়া ক’জন খেলতে জানে? আমরা তো দেখি একটু হাঁচি কাশি হলেও রাজনৈতিক নেতাদের ব্যাংকক সিঙ্গাপুর ছুটতে। সুতরাং এইটা হজম করতে আমাদের তো একটু সময় লাগবেই !
আরবীতে “হুব্বুল ওয়াতান” বাংলায় দেশপ্রেমের নিক্তিতে আপনার এই সিদ্ধান্তের ওজন আসলেই কতোটা সেইটা বোঝার মতো জ্ঞান হয়তো আমাদের নেই। কিন্তু এইটা আমরা বুঝতে পারছি, ওদেশের পলিটিক্যাল স্ট্রাকচারে অন্ততঃ কেউ একজন আছেন, যিনি আমাদেরই লোক। ইত্যকার রাজনৈতিক হম্বিতম্বি আর হুমকি ধামকি ছাড়াই যিনি বছরের পর বছর আমাদেরই অন্তরে পুষে রাখা না বলা কথাগুলোই বলে যান কোন ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলেই।
সংখ্যাটা একেবারে কাটায় কাটায় বলা সম্ভব না, তবে আমার অনুমান, প্রায় ১ কোটি মানুষের নেতা আপনি। জুলাই পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে এই বিশাল সংখ্যক ডেডিকেটেড কর্মীবাহিনীর নেতা হিসেবে আপনি গত দু সপ্তাহে রাজনৈতিক নৈতিকতার যে মানদণ্ড সেট করে দিয়েছেন, সেইটা নজীরবিহীন। আপনার দল কখনো ক্ষমতায় যাবে কি না, কিংবা ক্ষমতার কাছাকাছিও যেতে পারবে না কি না সেইটা বলা কঠিন, কিন্তু আপনার এই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চিত্ত, বুকভরা সাহস, মানুষের কল্যাণের প্রতিশ্রুতি আর নিখাদ দেশপ্রেম আমাদের আগামীর পথচলাকে অবশ্যই সহজ করবে, এইটুকু ধারণা করতেই পারি।
কিন্তু কি জানেন, আপনার এই ডেডিকেশন, ডিভোশন আর ডিটারমিনেশনও দিনশেষে আমাদেরকে নতুন চিন্তায় ফেলে দেয়। কারণ, আপনি যতো ভালো কাজই করেন, যতো ভালো কথা-ই বলেন, যতোই বাম রাজনীতি করে আসেন, যতোই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হন… শেষমেশ আপনি তো জামায়াতের আমীর। কেয়ামত পর্যন্ত আপনাকে দমন করা হবে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে। যুগে যুগে আপনাকে নির্মূলের বৈধতা উৎপাদন করবে গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, আমলাতন্ত্র, প্রশাসনিক কাঠামো… সব স্টেকহোল্ডার-ই। কারণ আপনার পলিটিক্যাল আইডিওলজির বিপরীতে দাঁড় করানোর মতো ন্যারেটিভ তৈরির চেয়ে প্রচলিত কাঠামোর “ধরো মারো কাটো খাও” রাজনীতিই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
আমি ঠিক জানি না, এই চ্যালেঞ্জ আপনি ফিল করেন কি না। আবার দোদুল্যমান আমি ভাবি, নাহ আপনি তো মোটামুটি একজন সফল রাজনৈতিক নেতা। দলের শীর্ষ ১০জন নেতাকে জুডিশিয়াল কিলিংয়ের পরও আপনি এক
সুতোয় গেঁথে রেখেছেন বিশাল কর্মীবাহিনী। একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ডেডলি গণঅভ্যুত্থানে প্রত্যক্ষ ভুমিকা রেখেছেন, নিজের ছাত্রসংগঠনকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া শিখিয়েছেন, স্বৈরাচার তাড়ানোয় শক্তিশালী ভুমিকা রেখেছেন। তাই মাঝে মাঝে ভাবি হয়তো আপনিই পারবেন গোলকধাধার জট খুলতে। বার্লিন দেয়াল ভেঙে যেমন দুই জার্মানী জুঁড়েছিলো ভালোবাসার বন্ধনে, হয়তো আপনিও পারবেন বিভেদের সেই দেয়াল ভেঙে এক ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ তৈরি করতে।
এই চিঠি যখন লিখছি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মারফত জানতে পেরেছি, বাংলাদেশে আপনার হৃদযন্ত্রে সফল অস্ত্রোপচার করতে পেরেছেন চিকিৎসকরা। মহান আল্লাহর দরবারে আপনার সম্পুর্ণ সুস্থতার জন্য দু হাত তুলে দোয়া করছি। নষ্টতন্ত্রের প্রতিটি অর্গানে ক্ষমতাবান হয়ে কিংবা না হয়েও যেন আপনার তারুণ্যের প্রেশারটা আপনি বহাল রাখতে পারেন সেজন্য আপনার ফিরে আসাটা খুব জরুরী।
আমরা একটা সুন্দর বাংলাদেশ চাই, যেখানে কথায় কথায় মানুষ খু*ন, অন্যের সম্পদে হিংস্র ছোবল, গণমানুষের অধিকারের পটে অনধিকার চর্চাসহ সব রাজনৈতিক অনাচার বন্ধ হয়ে যাবে। হয়তো আপনি পারবেন না, আমরাও দেখে যেতে পারবো না। কিন্তু এতো রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের পর, গণমানুষের মুক্তির ন্যুনতম আকাঙ্খাটুকু প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জিইয়ে রাখার জন্য হলেও একটা “শুভস্য শীঘ্রম” তো চাইতেই পারি, কি বলেন স্যার?
জুবায়ের ফয়সাল
সাবেক গণমাধ্যমকর্মী