26/10/2025
দু‘আর সাতটি গোপন উপাদান
আমাদেরকে ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয়েছে —"প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর দু‘আ করো। হাত তোলো, ঠিকভাবে বলো, বিনীতভাবে চাও।
আমরা তা বহু বছর ধরে নিষ্ঠার সাথে করছি, হয়তো কয়েক দশক ধরে করছি।
অধিকাংশ মানুষ ভাবে দু’আ করার পদ্ধতি হল-
“আরবিতে বলো”,
“ফজরের পর বলো”,
“কান্না করে বলো”,
“একশবার বলো” —
ইত্যাদি, ইত্যাদি
কিন্তু কেউ কি কখনও আমাদেরকে বলেছে, দু‘আ কবুল হওয়ার জন্য তাতে সাতটি উপাদান থাকতে হয়? যা ছাড়া দু‘আ শুধু শব্দেই সীমাবদ্ধ থাকে?
কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই লোকটার অবস্থা বদলে গেল।
ইবনুল আরাবী (র.) ছিলেন আট শতাব্দী আগের মানুষ। আন্দালুসিয়ার মুরসিয়ায় জন্ম নিয়ে তিনি মক্কা, দামেস্ক, কায়রো থেকে কোনিয়ায় ঘুরেছেন — শুধু বই পড়ে নয়, হৃদয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক পেতেছিলেন। তাঁকে বলা হতো আশ-শাইখুল আকবর — অর্থাৎ “মহানতম শিক্ষক”।
তিনি বলেছিলেন:
“সমস্যা তোমার চাওয়ায় নয়; সমস্যা হচ্ছে, আসলে চাওয়া বলতে কী বোঝায় তা তুমি এখনো জানো না ।”
এক রাতে এক মানুষ এলেন তাঁর কাছে — ভগ্ন, ক্লান্ত, নিরাশ। বিশ বছর ধরে তিনি একটাই দু‘আ করছিলেন- মেয়ের আরোগ্য, ঋণমুক্তি, সংসারের শান্তি।
সবই করেছেন — নামাজ, রোজা, দান, কান্না, অনুনয় — কিন্তু কিছুই বদলায়নি।
তিনি প্রশ্ন করলেন, “আল্লাহ কি আমার কথা শুনছেন না? আমি কি অযোগ্য?”
ইবনুল আরাবী কিছুক্ষণ নীরব থেকে যা বললেন তা তাঁর জীবন চিরতরে বদলে দিল:
তিনি বললেন,“তুমি বলছো, কিন্তু শুনছো না। দু‘আ একপাক্ষিক কথা নয়, বরং দু‘আ একটি সংলাপ, মানেই বলাও আছে, শুনাও আছে।
ইবনুল আরাবী বলেছিলেন, আল্লাহর সাথে আলাপে আছে সাতটি উপাদান। এই উপাদানগুলো ঠিকভাবে না থাকলে, দু‘আ কেবল আকাশে মিলিয়ে যায়।
অধিকাংশ মানুষ ব্যবহার করে শুধু দুইটি — আল্লাহর প্রশংসা করা আর চাওয়া। তারপর ভাবে, কেন আমাড় দু’আ কবুল হয় না!
ইবনুল আরাবী সেই মানুষকে নতুন কোনো বাক্য শেখালেন না — বরং তাঁকে নিয়ে গেলেন রাতের আকাশের নিচে। তারার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি যখন তারার দিকে তাকাও, তখন কি তাদের বলো — আমার জন্য আলো দাও?”
লোকটি বলল, “না।”
“তাহলে দেখো,” ইবনুল আরাবী বললেন, “তুমি শুধু তাদের দেখো। তারা তো আগেই জ্বলছে — তুমি চাও বা না চাও।”
এটাই প্রথম উপাদান: আল্লাহর রহমত তোমার চাওয়ার আগেই বিদ্যমান।
দু‘আ আল্লাহর মন পরিবর্তন করে না — বরং এটি তোমার হৃদয় খুলে দেয়, যাতে তুমি সেই রহমত অনুভব করতে পারো যা সবসময়ই তোমার দিকে প্রবাহিত।
কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“আমার বান্দারা যদি আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে, আমি তো কাছেই আছি। সে যখন আমাকে ডাকে, আমি তার আহ্বানে সাড়া দিই।”
(সূরা আল-বাকারা ২:১৮৬)
সত্যিকারের দু‘আর সাতটি উপাদান
ইবনুল আরাবী বলেছিলেন, দু‘আ হলো এক আধ্যাত্মিক স্থাপনা — যার সাতটি উপাদান একে পূর্ণতা দেয়।
অধিকাংশ মানুষ শুধু প্রথম ধাপে দাঁড়িয়ে থাকে, আর ভাবে কেন উত্তর আসে না।
১️ দু‘আ মানে চাওয়া নয়, দু‘আ মানে স্মরণ করা।
আরোগ্য চাইলে আগে স্মরণ করো “আশ-শাফি” — যিনি আরোগ্য দেন।
রিজিক চাইলে আগে স্মরণ করো “আর-রাযযাক” — যিনি রিজিক দান করেন।
ইমাম গাজ্জালী বলেছেন:
“দু‘আর উদ্দেশ্য আল্লাহকে তোমার প্রয়োজন জানানো নয় — বরং তোমার ভেতর জাগিয়ে তোলা, তিনি কতটা দয়ালু।”
যখন স্মরণ দিয়ে শুরু করো, তখন তোমার চাওয়া আল্লাহর ইচ্ছার সাথে মিশে যায়।
২️⃣ দু‘আ মানে চাওয়া নয়, আত্মসমর্পণ।
আমরা ভাবি আমরা জানি কী ভালো, কিন্তু আল্লাহ জানেন আরও গভীরভাবে।
সত্যিকারের দু‘আ হলো —
“হে আল্লাহ, তুমি যা জানো আমার জন্য ভালো, তাই দাও — যদিও আমার মন তা চায় না।”
রুমি সুন্দরভাবে বলেছিলেন:
“নিজের ইচ্ছা পূরণের প্রার্থনা কোরো না, বরং প্রার্থনা করো যেন তোমার ইচ্ছা তাঁর ইচ্ছার সাথে মিলে যায়।”
৩️⃣ দু‘আ মানে বলা নয়, শোনা।
স্মরণ করার পর একটু নীরব হও, মনোযোগ দিয়ে অপেক্ষা করো, অনুভব করো। কারণ নবী ﷺ বলেছেন:
“মনোযোগহীন হৃদয়ের দু‘আ আল্লাহ কবুল করেন না।” (তিরমিযি)
অনেক সময় উত্তর আসে কথায় নয়, শান্ত অনুভূতিতে — বুকের ভেতর এক প্রশান্তি হিসেবে।
৪️⃣ দু‘আয় দরকার উপস্থিতি।
হৃদয় যদি অন্য জায়গায় থাকে, মুখের শব্দ কিছুই করে না।
দু‘আর আগে কয়েকবার গভীরভাবে শ্বাস নাও, অনুভব করো — তুমি এখন আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে আছ।
ইবনুল আরাবী বলেছিলেন:
“নিজেকে গুছিয়ে নাও, তারপর নিজেকে উপহার দাও।”
৫️⃣ দু‘আ শুরু হোক কৃতজ্ঞতা দিয়ে।
আরও কিছু চাওয়ার আগে ভাবো — ইতিমধ্যেই কত কিছু পেয়েছ।
কৃতজ্ঞতা হৃদয় খুলে দেয়, যেমন সূর্যের আলোয় ফুল ফোটে।
আল্লাহ বলেন:
“তোমরা কৃতজ্ঞ হলে আমি অবশ্যই তোমাদের আরও দান করব।” (সূরা ইবরাহীম ১৪:৭)
৬️⃣ দু‘আর সাথে কাজও থাকতে হবে।
তুমি সুস্থতার জন্য দু‘আ করে ক্ষতিকর অভ্যাস চালিয়ে যেতে পারো না। রিজিকের জন্য দু‘আ করে অলস বসে থাকাও যায় না। ভালোবাসা চাইলে আগে ভালোবাসা দিতে হবে।
নবী ﷺ বলেছেন:
“প্রথমে তোমার উট বেঁধে রাখো, তারপর আল্লাহর ওপর ভরসা করো।” (তিরমিযি)
দু‘আ হলো বীজ, আর কাজ হলো পানি — দুটোই প্রয়োজন।
৭️⃣ দু‘আ চায় তোমার পরিবর্তন।
আল্লাহ উত্তর দিতে দেরি করেন না — কখনও কখনও তিনি আমাদেরকে প্রস্তুত করেন সেই উত্তর গ্রহণের জন্য।
আল্লাহ বলেন:
“আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের ভেতর পরিবর্তন আনে।” (সূরা আর-রাআদ ১৩:১১)
ধৈর্য মানে অপেক্ষা নয় — বরং সেই সময়ে নিজেকে বদলে ফেলা।
সত্যিকারের উত্তর কীভাবে আসে
যখন এই সাতটি উপাদান একসাথে কাজ করে, তখন দু‘আ কেবল মুখের কথা থাকে না — এটি তোমার অস্তিত্বের অংশ হয়ে যায়। তোমার নিঃশ্বাস, তোমার হৃদস্পন্দন, তোমার প্রতিটি মুহূর্তই তখন এক প্রার্থনা।
তখন প্রশ্নটা বদলে যায় —
“আমার দু‘আ কবুল হলো না কেন?” থেকে “আমি আগে কেন বুঝিনি, প্রতিটি মুহূর্তই তো একেকটা উত্তর ছিল!”
একসময় তোমার মনে হবে, তোমার ভেতরে এক প্রশান্ত সাড়া বাজছে — অনেক পুরোনো দু‘আ, যা তুমি ভুলে গিয়েছিলে, ধীরে ধীরে পূর্ণ হতে শুরু করেছে। তুমি বুঝবে — আল্লাহ কখনও দূরে ছিলেন না। তাঁর নীরবতা কখনও প্রত্যাখ্যান ছিল না, ছিল আমাদেরকে প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া।
যে মানুষটি ইবনুল আরাবীর কাছে গিয়েছিল, পরে দেখল — তার মেয়ে সুস্থ হয়েছে, ঋণ মিটেছে, সংসারে শান্তি এসেছে।
কিন্তু সে বুঝল — সবচেয়ে বড় উত্তর আসলে এই পরিবর্তনগুলো নয়, বরং সে নিজে যে মানুষে পরিণত হয়েছে তার মধ্যেই ছিল।
সে শিখেছিল দু‘আ ভয়ে নয়, বিশ্বাসের সাথে করতে হয়। শূন্যতা থেকে নয়, প্রাচুর্য থেকে। আল্লাহর ইচ্ছা বদলানোর জন্য নয়, বরং সেই ইচ্ছার সাথে মিশে যাওয়ার জন্য দু’আ করতে হয়।
যদি মনে হয় তোমার দু‘আ এখনো উত্তরহীন।
আল্লাহ আমাদেরকে এমন এক দু‘আ শেখাচ্ছেন, যা কিছু চায় না, বরং চাওয়াকেই বদলে দেয়।
আজ রাতে যখন তুমি হাত তুলবে, মনে রেখো —"তুমি অন্ধকারে কথা বলছ না, তুমি তাঁর সাথে কথা বলছ, যিনি সবসময় শুনছেন, সাড়া দিচ্ছেন, আর তোমার কাছেই আছেন।
“নিশ্চয়ই আমার রহমত সব কিছুকে আচ্ছাদিত করেছে।” (সূরা আল-আ‘রাফ ৭:১৫৬)
🌿 তোমার দু‘আ হোক গভীর,
💖 তোমার হৃদয় হোক উন্মুক্ত,
✨ আর কখনও ভুলে যেও না — আল্লাহ সম্ভবত ইতিমধ্যেই উত্তর দিয়ে দিয়েছেন।
#দুয়া