06/07/2022
পেন্সিল হতে নেয়া এই গল্পটা বেশিরভাগ মেনোপোস এর দিকে যাওয়া নারীর মানসিক ও শারীরিক দ্বন্ধের এক সুন্দর দৃষ্টান্ত, সেই সাথে কিভাবে পরিবার পাশে থাকবে তাঁর এক শিক্ষা।
#সেদিন_সন্ধ্যায়
#তাসনিয়া_আহমেদ_মেঘ
বাবা তুমি কি বুঝতে পারছো মা কি পরিমাণ বিরক্তিকর চরিত্র হয়ে উঠছে দিন দিন?
আমি আমার একমাত্র শিক্ষিতা আদরের মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছি।আমার মেয়ে শ্রেয়া খুবই সত্যি কথা বলছে আমি জানি।কিন্তু তাই বলে আমি আর আমি স্ত্রী নীনা সন্তানের সামনে নিজেরদের দুর্বলতা প্রকাশ বা অভিযোগ করিনি কখনো, করবোওনা এই সিদ্ধান্ত শ্রেয়া জন্মবার আগেই নিয়েছিলাম।কাজেই আমি শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,আমাদের অনেক দিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়না,একটা ফ্যামিলি ট্রিপ হলে কেমন হয়?শ্রেয়া কপালের সামনের চুল কানের পেছনে গুজে নিয়ে বললো,,বাবা আমি কমপ্লেইন করছি না,আমি কনসার্ন্ড।তুমি বুঝতে পারছো না!আজ সে কি করেছে জানো?মা সরাসরি আকাশকে বলেছে,এতো গেস্ট এর অ্যারেঞ্জমেন্ট আমাদের পক্ষে করা পসিবল না!তোমরা তোমাদের এক ঝাক আত্মীয়-স্বজনকে যদি খাওয়াতেই চাও তবে রিসিপশনে তাদের ইনভাইট কর।বাবা আকাশ আমার ফিয়ান্সে।তাকে এভাবে মুখের উপর অপমান করাটা কি ঠিক হয়েছে?আমি হেসে আমার স্কলার মেয়েকে উত্তর দিলাম তোমার মা মন্দ কিছু বলেনি।তবে ওয়ার্ডিং টা পিক করার ব্যাপারে আরেকটু সচেতন হতে পারতো। আমি এবার হুইস্কির গ্লাসে কয়েক টুকরো বরফ ছেড়ে দিলাম।তারপর শ্রেয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,খুব লাইট,তোর এখন দরকার হবে।শ্রেয়া আমার দিকে কঠিন চোখে তাকালো।গম্ভীর মুখে বললো,আমার না তোমার দরকার এটা! মায়েরও।আর শোনো আকাশকে যখন মা দেখে এক দেখাতেই তাকে খুব পছন্দ করেছিলো। আমার চেয়ে আমার বিয়ের ব্যাপারে মা বেশি আপ্লুত ছিলো কিন্তু এখন তার কর্মকাণ্ড বলছে তার আকাশকে পছন্দ না।বড়জোড় দশ মিনিট আমাদের সাথে সে বসেছে,আর কি অদ্ভুতুরে কাণ্ডকীর্তি করছিলো সেই দশ মিনিটেই!বার বার কেবল একি কথা এত্ত গরম লাগছে কেনো?গা টা জ্বলে যাচ্ছে? এই তোদের গরম লাগছে না? বাবা এসি ১৬ তে দেয়া ছিলো।এই ব্যাবহারের কারণ কি?অথচ আজ আকাশ কিছু জরুরি কথাই বলতে এসেছিলো আমাদের বিয়ের ব্যাপারে! বাবা আমি খুব বিরক্ত হচ্ছি।আমি জরুরি কথা বলছি তার তুমি মদের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে গুনগুন করছো!সিরিয়াসলি বাবা!আমাকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়েই শ্রেয়া উঠে গেলো।আমি আমার মেয়ের গমন পথের দিকে চেয়ে রইলাম।
শ্রেয়ার ধারণা ভূল,আমি ওর কথা মন দিয়ে শুনছিলাম।আমি অতিরিক্ত ধরনের চিন্তিত থাকলে গুনগুন করে গান গাইতে থাকি।আমার সাবকনশাস মাইন্ড আমাকে রিল্যাক্স করার জন্য এই উপায় বের করেছে।আমার চরিত্রের এই ধরনটা আমার মেয়ে শ্রেয়ার জানা।কারণ তার সাথে আমার সম্পর্ক আট দশটা বাবা মেয়ের সম্পর্কের মত না,সম্পর্ক টা এমন যেখানে কথা বলার জন্য বিন্দু মাত্র ভাবনার প্রয়োজন হবেনা,তবে কখনোই তা আদবের মাত্রা ছাড়িয়ে যাবেনা।আমি চিন্তিত নীনাকে নিয়ে নীনার পরিবর্তন আমার চোখে পড়েছে।নীনা ইদানীং রাতে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে বহুক্ষণ ধরে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে,দেখে মনে হবে ধ্যান করছে!আমি রাতে ঘুম ভেঙে অনেক বার এই দৃশ্য দেখেছি।আগের মত সে আমার কাছে আসেনা,বরং আমি কাছে টানলে বিরক্ত হয়ে বলে,আজ মদ বেশি খেয়েছো!সরে যাও গা থেকে গন্ধ বেরোচ্ছে!অথচ নীনা জানে আমি কখনোই মদ্যপ হইনা,এমনকি এ জীবনে হইনি!খুব ক্লান্তিকর দিন থাকলে আমাদের দক্ষিণমুখো বিরাট খোলা ব্যালকনিতে বসে হালকা ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক শুনতে শুনতে একটা দুটো পেগ খাই।সাথে নীনাও বসে,ওর হাতে থাকে রোজ ওয়াইন।এটা ওর পছন্দের পানীয়।খেতে খেতে আমরা জীবন সমাজ কর্ম এবং পৃথিবীর হেন বিষয় নেই যা নিয়ে আলাপ পাড়িনা!নীনার শিক্ষাগত যোগ্যতা ইন্টারমিডিয়েট।কিন্তু ওর কথা শুনে বুঝার উপায় নেই।মনে হবে প্রচন্ড উচ্চশিক্ষিতা এক মহিলা বসে আছে আপনার সামনে।
নীনার সাথে যখন আমার বিয়ে হয় ওর বয়েস ছিলো ষোলো।কাটাকাটা চোখ মুখের প্রচন্ড সুন্দরী এক কিশোরীর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেলো মায়ের ইচ্ছায়।রাগে দুঃখে মায়ের সাথে আমি কথা বলা বন্ধ করে দিলাম।আমি চেয়েছিলাম শিক্ষিত ধারালো বুদ্ধির এক মেয়ে।কিন্তু বিয়ে যেহেতু হয়েছে কিছু করার তো আর নেই।আমি দূরত্ব বজায় রেখে নীনার সাথে বাস করতে লাগলাম।ভেবেছিলাম নীনা কেদে কেটে অস্থির হয়ে আমার মাকে তার মাকে বিচার দিয়ে বসবে।কিন্তু সে রকম কিছুই ঘটলো না।আমি ঘুমোতে যাওয়ার সময় ঘরে ঢুকে দেখি নীনা গল্পের বই পড়ে,আমাকে দেখলে বাতি নিভিয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।প্রথমে ভেবেছিলাম কিশোরী মেয়ের অভিমান বুঝি এটা,কিন্তু তা নয়।বরং এমন একটা সময় আসলো যখন আমি নীনাকে আড় চোখে দেখে কথা বলার আগ্রহ দেখাতাম, নীনা বিকারহীন থাকতো।একদিন সকালে বাবার উচ্চ কন্ঠস্বর শুনে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম,শুনলাম বাবা রুক্ষ গলায় বলছে,কিছুদিন পর সন্তান নিবে এখন কলেজে ভর্তি হলে কিভাবে সন্তান সামলাবে!আমি শুনলাম নীনা শান্ত গলায় বলছে,সন্তান সামলানো শুধু আমার একার দায়িত্ব না।আপনার ছেলে যেমন অফিস সামলে সন্তান দেখবে আমিও পড়াশোনা আর সন্তান দুটো এক সাথেই দেখবো।বাবা রাগে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।আর আমি হলাম অভিভূত।আশির দশকে কোনো মেয়ের মুখে এমন কথা অহরহ ছিলোনা,এমনকি এমন ভাব্বার ক্ষমতা বা ইচ্ছে কোনোটাই ছিলোনা।সেই নীনাকে আমি ভালোবেসেছি।কিন্তু আজকের নীনার সাথে তার তেমন কোনো মিল।আজকের নীনা বড্ড বেশি আটপৌরে।আমাদের একমাত্র মেয়ে শ্রেয়া দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গোল্ডমেডেল প্রাপ্ত,এখন একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট লেকচারার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত, এর পুরোটাই ক্রেডিট যায় মা আর মেয়ে দুজনের।মা হিসেবে নীনা প্রায় অসাধারণ পর্যায়ের মহিলা।শ্রেয়ার যখন প্রথম হৃদয় ভঙ্গ হয় শ্রেয়ার সাথে সাথে নীনাও ভেউ ভেউ করে কেঁদেছিল।সেই দৃশ্য আমি অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে মেয়ের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছি,এরপর ঘরে ফিরে এসেছি।শ্রেয়া আমার চাইতেও মায়ের সাথে বেশি এটাচড।সেই কারণেই হোক বা ওর দৃঢ় সংকল্প শ্রেয়া তার প্রথম হৃদয় ভঙ্গের কষ্ট থেকে খুব তাড়াতাড়ি উতড়ে উঠেছিল।
যেই নীনা আমার বাবাকে কঠিন গলায় বলেছিলো,সন্তান হলে দুজন সামলাবো,সেই নীনাই শ্রেয়া জন্মাবার পর আমাকে বলেছিলো,শোনো আমি আর পড়বো না।আমি অত্যন্ত অবাক গলায় বলেছিলাম,তা কেনো তুমি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছো।তোমার পড়া চালিয়ে যাওয়া উচিৎ।নীনা এক মূহুর্ত কি যেনো ভেবে নিয়ে বলেছিলো,তা উচিৎ।কিন্তু আমি এই ছোট ছোট হাত পা গুলোর বেড়ে ওঠার প্রতিটা মুহূর্ত দেখতে চাই।আমি প্রচন্ড বিরক্ত হলাম,নীনার মত মেয়ের মুখে এমন আটপৌরে কথা মানায় না।নীনা আমার মন বুঝতে পেরেছিলো কিনা জানিনা।ও হেসে বললো, এটা আমার কম্প্রোমাইজ না চয়েস।আমি অতি আনন্দের সাথে তা গ্রহণ করেছি।তুমিও করো।আমি করলাম।নীনা কিন্তু থেমে থাকেনি।গর্ভ ধারণের পর বাড়তি মেদ ঝরাতে সে ক্যারাটে শেখা আরাম্ভ করলো, ব্ল্যাকবেল্ট চ্যাম্পিয়ন হলো।শ্রেয়াকে নাচের ক্লাসে দিয়ে সে পাশে গানের ক্লাসে ভর্তি হলো।রাতারাতি হারমনিয়াম বাজিয়ে গান শিখে ফেললো,প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এক কমন দৃশ্য ছিলো, নীনা হারমনিয়াম বাজিয়ে গান গাইছে,সেই গানের তালে তালে ছোট্ট শ্রেয়া নাচছে।শ্রেয়া স্কুলে যেতো, নীনা রান্নার ক্লাসে।এরপর থেকে আমাদের প্রতি আথিতেয়তায় নীনা নিজের হাতে সব ডিশ বানাতো!ওর রান্নার হৈহৈ পড়ে গেলো আমার বন্ধু, আআত্মীয় আর কলিগ মহলে।
শ্রেয়া বড় হলো কলেজে যাওয়া শুরু করলো ,নীনা ইয়োগা ক্লাস শুরু করলো।পরে ওখান থেকে আর্ট ক্লাস শেষে মা মেয়ে বাড়ি ফিরতো।সে নিজেই ইয়োগা ট্রেইনার হয়ে জয়েন করলো একটা একাডেমিতে।আমাদের সাড়ে বত্রিশ'শ স্কয়ার ফিটের অ্যাপার্টমেন্টটা মা মেয়ের বিভিন্ন আর্টে ভর্তি।
নীনা আমার স্ত্রী,উনিশে মা হওয়া সদ্য তরুণী মেয়েটা আজ পরিপূর্ণ নারী।ওর কোনো কাজে আমি তাকে বাধা দেইনি।বাধা দেবার কিছু নেইও, নীনা আলাদা স্বত্তা।সেই স্বত্তাকে কব্জা করার কোনো প্রয়াস আমার কোন কালেও হয়নি।হবেই বা কেন আমি টাকা রোজকার করেছি,কিন্তু আমার ঘরটাকে সংসার বানিয়েছে নীনা।আমাদের যত্ন নিয়েছে।আমি কাজে আরো মনোযোগী হতে পেরেছি,আর শ্রেয়া তার পড়াশুনায়।আমার ব্যাড ওয়ার্ক ডেতে বাড়ি ফিরে নীনার সাথে বিভিন্ন অফিস খুটিনাটি নিয়ে আলোচনা করেছি,নীনা গভীর মনোযোগের সাথে তা শুনেছে,টুকটাক পরামর্শ দিয়েছে।কখনোই মনে হয়নি এই মেয়ে কেবল কলেজ পেরুনো।আজকাল নীনা আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চায়না।তাই বলে অন্য বন্ধুদের মত আমি অবশ্যই নতুন যুবতী শরীরের সন্ধানে যাবোনা।বিষয়টি গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করবো কোথায় সমস্যা হচ্ছে।শ্রেয়া তার মায়ের কিশোরী থেকে নারী হয়ে ওঠার মুহূর্তগুলো দেখেনি,তার রাগ হতেই পারে,কিন্তু আমার রাগ হওয়া মানায়না।
আমি বাড়ি ঢুকতেই শ্রেয়া দৌড়ে এসে বললো, বাবা তুমি কি দেখেছো মা তার সব চুল কেটে ফেলেছে?আমি বিস্মিত হয়ে মেয়ের দিকে তাকালাম।চুল কেটে ফেলাটা কি কোনো অপরাধ।যার চুল সে ইচ্ছে হলে রাখবে ইচ্ছে হলে কাটবে।আমি হালকা হেসে বললাম,তোমার মাকে নিশ্চয়ই সুন্দর দেখাচ্ছে নতুন হেয়ার কাটে।শ্রেয়া কপাল কুচকে আমাকে দেখলো তারপর বললো,এরজন্য চুল সব চেছে ফেলার মানে হয়না।বাবা তুমি কি দয়া করে আকাশের ফ্যামিলির সাথে একটু বসবে? আমাদের ফ্লাই করার দিন ঘনিয়ে আসছে।ডেট ফিক্স হওয়াটা জরুরি।আমি এই মুহুর্তে ঠিক মায়ের উপর ভরসা করতে পারছি না।আমি ক্ষানিক বিরক্ত হলাম।আমার নেয়ে ইদানীং তার বিয়ে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছেনা।এটাও হয়তো স্বাভাবিক।কিন্তু আমি আগ বাড়িয়ে এমন কিছুই করতে চাচ্ছিনা যাতে নীনা কষ্ট পায়।আমাকে নিশ্চুপ দেখেই হয়তো শ্রেয়া আমার কাধে মমতায় হাত রাখলো, বললো,বাবা আজকে সত্যিই আমার এক পেগ হুইস্কি লাগবে।উড ইউ মাইন্ড? আমি হাসলাম,বুঝলাম বুদ্ধিমতী মেয়ে আমার মন হাল্কা করতে চাচ্ছে।ওকে হ্যা সূচক সম্মতি দিয়ে আমি শোবার ঘরে ঢুকে পেলাম।নীনা ইজি চেয়ারে চোখ বুঝে হেলান দিয়ে আছে,ঘর ফ্রিজের মত ঠান্ডা।নীনার চুল ঘাড় অব্দি কাটা,তাকে ভালো দেখাচ্ছে নিসন্দেহে।আমাকে ঢুকতে দেখে বললো, আজ বাসায় খাবার নেই।তোমরা নিজেরা কিছু করে খাও।এবার আমি একটু বিষম খেলাম।একত্রিশ বছরের সংসার জীবনে এমন কখনো হয়নি আমি বাড়ি ফিরে খাবার পাইনি।এমনকি শত ব্যস্ততা অসুস্থতায় নীনা নিজের হাতে খাবার প্রস্তুত করে।এই দায়িত্ব সে কাওকেই দেয়না।আমি হাসি মুখে বললাম,কি খাবে বলো,অনলাইন অর্ডার করি।বাই দ্য ওয়ে তোমাকে বেশ লাগছে চুলের স্টাইলে। নীনা ম্লান হাসলো।আমি খাবার অর্ডার করে শ্রেয়াকে নিয়ে বসলাম,শ্রেয়া প্রথম কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললো, বাবা মা আমাকে ভূল বুঝছে আমি জানি।কিন্তু তুমিও আমাকে ভূল বুঝছো সেটা মানতে আমার কষ্ট হচ্ছে।আমি তোমার হেল্প চাইছি জাস্ট মায়ের জন্য।আজ আকাশের মা ফোন করেছিলো মাকে।মা বলেছে,বিয়ের ব্যাপারে সব ভাবনা শেষ হয়নি,শেষ হলে নিজেই ফোন করে জানাবে।বাবা সিদ্ধান্ত তো দুই পরিবারকে মিলে নিতে হবে তাইনা?মা একা নিতে পারেনা।বাবা, মায়ের এই পরিবর্তনগুলো আমাকে ভীত করছে।মনে হচ্ছে মা বিরাট কোনো ঝামেলার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে।আমি অনেক কষ্টে গুনগুনানো বন্ধ করে মেয়ের কথা শুনলাম,তারপর কালকের মত আজও একি কথা বলে বসলাম,আমাদের পুরো পরিবার একটা ট্রিপে যাওয়া উচিৎ।বলেই মনে হলো,সর্বনাশ আমার অন্য কিছু বলা উচিৎ ছিলো, এমন কিছু যাতে শ্রেয়া কিছুটা মানসিক শান্তি পাবে।আমি ভয়ার্ত চোখে মেয়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম,মেয়ে হাসছে,হাসতে হাসতেই বললো, বাবা তোমারা কি আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে আপসেট? বাবা আমরা একসাথে পিএইচডি করতে যাচ্ছি এবং অবশ্যই বিদেশে সেটেল হবোনা।এই সিদ্ধান্ত তোমাদের জানা।তোমরা ভেবোনা আমি কম্প্রোমাইজ করছি দেশে ফিরে আসাটা আমার চয়েস।একটা পুরো জীবন তোমাদের ছেড়ে বিদেশ বিভুইয়ে পড়ে থেকে আমি অপচয় করবোনা।আমার বাচ্চা দাদি নানির মাঝে থেকে বড় হবে।বাংলাদেশের গ্রান্ড প্যারেন্টসরা কি অসাধারণ এটা না না জানিয়ে আমি তাকে বড় করবো না।
এই প্রথম আমি ভারমুক্ত হলাম,মনে হলো শ্রেয়া না নীনা কথা বলছে।নীনা কি অসাধারণ ভাবে আমাদের মেয়েকে বড় করেছে!আমি শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম,আমার চোখে জল এসে ভরে গেলো, দ্রুত আমি চোখ সরিয়ে ফেলে লুকোনোর চেষ্টা করলাম।শ্রেয়া আমার হাতে একটা হাত রাখলো,নরম গলায় বললো, বাবা চোখের পানি লুকিয়ে ফেলতে হয়না।দেখাতে হয়,আপন মানুষের কাছে চোখের পানি লুকোনো কোনো দুর্বলতা না,প্রচন্ড সবলতা,ভালোবাসার সবলতা।আমরা ট্রিপে যাচ্ছি।তারপর আমার বিয়ের ডেট নিয়ে কথা হবে।তবে মাকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব তোমার,আমি কিন্তু এই ট্যানট্রামস নিচ্ছিনা।বলেই শ্রেয়া হাসলো।আমার মনটা খুব ভালো হয়ে গেলো।মেয়েকে কাছে টেনে কপালে একটা চুমো খেলাম।
প্রতি রাতের মত আজও নীনা এসির টেম্পারেচার বারবার কমাচ্ছে বাড়াচ্ছে।আমি কম্ফর্টার গায়ে টেনে শুয়ে আছি।নীনাকে ঘাটাচ্ছি না।কিন্তু হঠাৎ দেখলাম নীনা বিরাট আইস ব্যাগ নিয়ে এসে পায়ের পাতায় চেপে ধরলো।এবার কথা না বলে থাকাটা শোভন নয়।আমি বিছানায় উঠে বসে নীনাকে বললাম,তোমার এই সমস্যা গুলো নিয়ে একটা ডাক্তার দেখালে হয়না।নীনা বিরস গলায় বললো, দেখিয়েছি,কোনো সমস্যা নেই।ফুল বডি চেক আপ করিয়েছি।তারপর আমার দিকে ফিরে বললো, এবার গরম কি পড়েছে দেখেছো?এই গরমে বেচে থাকা যায় নাকি!আমি আর কথা বাড়ালাম না।গরম এবার পড়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রতি বছরই এ গরম পড়ে।আমি খেয়াল করে নীনার দিকে তাকালাম এই প্রথম বার মনে হলো,নীনা বুড়িয়ে যাচ্ছে।ওর চোখের পাশের বলিরেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।আর চোখের নীচে গাঢ় কালির পরত।কেনো যেনো সেই রাতটা আমি জেগে কাটালাম,নীনাও জেগে রইলো।পুরো রাত এপাশ ওপাশ করলো।জেগে জেগে তা আমি দেখলাম।কিন্তু কথা হলোনা আমাদের দুজনের।কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে নীনা জানাতে চাইছে না ওর ডিসকমফোর্ট,ওকে আমি ঘাটাতে চাইনা।
অনেকদিন পর আড্ডা দিতে এলাম,সব বন্ধুরা এক হয়েছি।আড্ডা দিচ্ছি।ভালো কাটছে সময়,কিন্তু সমস্যা হয়ে গেলো অন্য জায়গায়।রফিকের পাশে সদ্যযৌবনা তরুণী এসে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে রইলো।কারো ব্যক্তিগত পছন্দে অপছন্দে আমি নাক গলাই না।কিন্তু আজ প্রচন্ড বিরক্ত হলাম।কারণ আমি বুঝতে পারলাম এই তরুণী শুধুমাত্র তার মনোরঞ্জন শয্যাসঙ্গী নয়,এর অনেক বেশি।আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম,একটা সিগারেট ধরিয়ে খুকখুক কাশতে লাগলাম,আমি ধুমপান সাধারণত করিনা।আজ কি মনে করে দুটো সিগারেট কিনেছি।পাশে তাকিয়ে দেখি রফিক এসে দাঁড়িয়েছে।ও আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললো, বন্ধু রাহেলাকে আমি ভালোবাসি ঠিকই, কিন্তু আজকাল আমাদের মনের যোগাযোগটা একেবারে হচ্ছেনা।বিরক্ত লাগে বন্ধু খাটাখাটুনির পর ঘরে ফিরে একঘেয়ে প্যানপানানি ভালো লাগেনা।ওর কথা আমি নীরবে শুনলাম কিছুই বললাম না।রফিক যোগ করলো,আমার বউ তো আর তোর বউয়ের মত এক্সিলেন্ট রাঁধুনি বডিফিট মহিলা না,তুই বুঝবি না।এবার আমি রফিকের দিকে তাকালাম।আগেই বলেছি আমার বন্ধুমহলে নীনার বেশ সুনাম রয়েছে বরাবর।নীনা সুন্দরী এবং গুনবতী।নীনার এই জনপ্রিয়তা আমি এনজয় করি।কিন্তু আজ করলাম না।আমার বন্ধুদের বউরা অজানা কারণেই নীনাকে বিশেষ পছন্দ করেনা,তাদের কিটি পার্টিতে নীনা বেশির ভাগ সময়েই আমন্ত্রিত হয়না।এ নিয়ে নীনার মাথা ব্যথা নেই।তবে রফিকের স্ত্রীর সাথে নীনার বেশ সুসম্পর্ক আছে।রফিক হয়তো ভাবছে আমি নীনাকে আজকের ব্যাপার শেয়ার করবো।আমি রফিকের দিকে তাকিয়ে বললাম,ভাবীকে এক্সসিলেন্ট বানাবার জন্য কোনো অবদান কি তোর আছে?রফির উচ্চস্বরে হেসে বললো, আরে ধুর ধুর রাহেলার কি ওসবে কোনো আকর্ষন আছে নাকি,হাড়ি ঠেলতে ঠেলতেই জীবন পার করেছে।আমি স্মিত হেসে বললাম,হাড়ি ঠেলার পেছনের গল্পটা কখনো জিজ্ঞেস করলে হয়তো জানতে পারতি আর কোনো এক্সিলেন্সি আছে কিনা।আমি সিগারেট ফেলে জুতোয় পিশে রফিকের দিকে তাকিয়ে বললাম,তোর এ বিষয়ে নীনার সাথে আলাপ করবোনা,চিন্তা করিস না।দেখলাম রফিকের মুখটা হা হয়ে আছে।রফিকের গায়ের শার্টটা সুন্দর আয়রন করা,জুতো চকচক করছে।রফিকের প্যানপ্যানানি বউটা আজও সব একই নিয়মে করে আসছে দেখে অবাক লাগলো। মেয়েরা ক্লান্ত হয়ে যায়না কেনো সংসার করতে করতে।বাড়ি ফিরতে ফিরতে শ্রেয়াকে ফোন করে বললাম,শোন তোর মাকে বল রাতের রান্না না করতে,আমি থাই ফুড নিয়ে আসছি।শ্রেয়া অনেকক্ষণ হেসে বললো, বাব্বা কি প্রেম তোমাদের বাবা!থাই আনতে হবেনা।মা আজ থাই রান্না করেছে।তাড়াতাড়ি এসো।
আমি ফোন রাখলাম শ্রেয়ার আকিকার দিনের কথা মনে পড়লো, শ্রেয়া নাম শুনে হুজুর বলেছিল, অন্য নাম দিন।শ্রেয়া নামটা হিন্দুয়ানা।উনিশ বছরের তরুণী পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকে বলেছিলো,নাম আবার হিন্দু মুসলিম কি!আমি এই নামই রাখবো।আপনি এই নামে আকিকা দিন।সেদিন আমার বাবা আর উচ্চবাচ্য করেননি,ততদিনে তিনি এই সুন্দর চেহারার মেয়েটির জিদ বুঝে গেছিলেন!
যেদিন জানতে পারলাম আমাদের মেয়ে হবে নীনা সারাদিন মুখ ভার করে রইলো। তারপর বললো,শোনো আমরা আর সন্তান নিবোনা।আমদের একটি সন্তানই থাকবে।আমি হাসিমুখে বলেছিলাম,ভালো কথা।কিন্তু মেয়ে হবে শুনে তোমার মন কি কিঞ্চিৎ খারাপ?নীনা বললো, আমার মন ভীষণ ভালো,তবে আমি কিঞ্চিৎ চিন্তিত, কন্যা সন্তান মানে অনেক দায়িত্ব,সুরক্ষা নিশ্চিত করা।আমরা পারবো তো।আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,we are going to be great Parents!নীনা আমার বুকে মুখ গুজে খুব হাসলো।বাড়ি ফিরে আমার মন দ্বিতীয় দফায় ভালো হয়ে গেলো,শ্রেয়া তার মাকে ট্রিপের জন্য রাজি করিয়ে ফেলেছে।আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম,আমরা পাহাড়ের আশেপাশে কোথাও যাবো।নীনা কয়েকবার শুধু বললো, এই গরমে পাহাড়! আমি আর শ্রেয়া আনমোনা নীনাকে দেখলাম।শ্রেয়া নীনাকে জড়িয়ে ধরে বললো,মা এখন নভেম্বর শুরু হয়েছে।কয়েকদিনের মধ্যেই টুপ করে শীত নেমে যাবে।সেদিন খেতে বসে দেখলাম নীনা তার প্রিয় থাই খাবারও খেতে পারছে।হঠাৎ তাকিয়ে দেখলো আমি ওকে দেখছি।ও নার্ভাস হেসে বললো, গরমে কিছুই ঠিক করে হজম হতে চায়না।আমি আর শ্রেয়া মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।গরম তেমন নেই এই তথ্য টেবিলে বসা আমরা তিনজনই জানি!
শোবার ঘরে গিয়ে আমি চমকে গেলাম।হরেক রং আর ডিজাইনের স্কার্ফ কিনে নীনা ঘর ভরিয়ে ফেলেছে।আমি বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলাম,তুমি স্কার্ফ পড়বে? নীনা হেসে বললো,ফ্যাশন বদলাচ্ছি! আমি আবার স্পষ্ট গলায় বললাম,কারণটা তোমার ছোট চুল ঢাকা নয়তো।নীনা তাকালো।শান্ত গলায় বললো, কদিন পর মেয়ের বিয়ে,লোকে খারাপ বলবে।কিন্তু এতো চুল পড়ছিল।আমি নীনাকে বললাম,লোকে কি বলবে এটা ভাবা শুরু করেছো বলেই আজকাল নিদ্রাহীনতায় ভুগছো।নীনা চমকে তাকালো আমার দিকে।ধীরে ধীরে বললো, বুড়ো হয়ে গেছি শ্রেয়ার বাবা।সেদিন কি দেখলাম জানো? রফিক ভাই একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে।কিছু মনে করোনা,ব্যাপারটা দৃষ্টি কটু ছিল।এ ব্যাপারে কিছু জানো তুমি!আমি এড়িয়ে গেলাম।সত্যিটা নীনা পছন্দ করবে না।আজকের রাতটা আমি আর নষ্ট করতে চাইলাম না।নীনাকে গভীর ভালোবাসায় কাছে টেনে নিলাম।আজ নীনা বাধা দিলোনা।কিন্তু পুরোটা সময় উশখুশ করতে লাগলো।বুঝতে পারলাম নীনা ইচ্ছের বিরুদ্ধে মিলিত হচ্ছে আমার সাথে।অপরাধবোধ জেকে বসলো।
সত্যিই টুপ করে শীত পড়েছে।শ্রেয়া গায়ে জ্যাকেট চড়িয়েছে আর আমি শাল।কেকটার লিখাটা পড়ে শ্রেয়া আমার দিকে বহুক্ষণ তাকিয়ে রইলো,বললো, বাবা আজ বরং তুমি আর মা ক্যান্ডেললাইট ডিনার করো।আমি খুব হেসে বললাম,সে তুই থাকলেও হবে।শ্রেয়া আমি চাই আজকের প্রিপারেশনে তুই থাক।তোর মা ভীষণ খুশি হবে।শ্রেয়া ভেজা গলায় বললো, কিন্তু আমারও উচিৎ ছিলো মাকে কোনো প্রেজেন্ট করা।আমি হেসে বললাম,তুই নিজেই আস্ত একটা প্রেজেন্ট।শ্রেয়া প্রায় দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে বললো, বাবা আমি তোমার মত অসাধারণ পুরুষ আর একটিও দেখিনি।আমি আকাশের প্রেমে পড়েছিলাম কেনো জানো,ও তোমার মত শুদ্ধ চিন্তা করতে পারে।আমি বললাম,শ্রেয়া যেটাকে তুই শুদ্ধ অসাধারণ ভাবছিস তাই আসলে সাধারণ।আমরা তার বিপরীতটা করি বলে তোর কাছে আশ্চর্য লাগছে।যা এবার তোর মাকে ডাক।
আমি বুঝতে পারছি নীনা প্রানপনে কান্না আটকাবার চেষ্টা করছে।কেকটির দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থেকে বললো, im blessed to have you both.অথচ কেকের উপরের লিখাটা সাধারণ।ওতে লিখা,Happy menopause.You are aging gracefully ❤️.
শ্রেয়া ছোট্ট একটি প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো, তোমার পছন্দের ব্র্যান্ডের লাল টুকটুকে লিপস্টিক আছে।অনেক দিন ধরে দেখছি তুমি লাল লিপস্টিক দিচ্ছোনা।নীনা বললো,আমাকে বুড়ো হতে দিবিনা তোরা?নীনার চোখে আবারও জল এসেছে।নীনা তা লুকানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করলো।আমি শ্রেয়ার লাইনটা বললাম,চোখের জল আপন মানুষের কাছে লুকোতে নেই,এটা তোমার দুর্বলতা না, সবলতা!নীনা কাঁদতে কাঁদতে হাসলো।আমি আমার অসম্ভব সুন্দরী স্ত্রীর প্রেমে পড়ে গেলাম আরো একবার!
মেনোপজ নিয়ে আমাদের ধারণা খুব কম।এ নিয়ে আমরা ভাবিনা,বলিনা,লিখিনা,খুব একটা মনোযোগও দেইনা।অথচ এ সময়ে নারীরা ভীষণ রকমের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যায়।সারাক্ষণ নিজেকে বোঝাতে থাকে আমি infirtile হতে পারি কিন্তু আজও আমি নারী।কমে যায় ফিমেল হরমোন তাই ভয়াবহ মুড চেইঞ্জিং হয়।চুল পড়ে যায়,ভ্যাজানাল পাথ ড্রাইনেসের কারণে সেক্সুয়ালি ইনাক্টিভ হয়ে যায়,হীনমন্যতায় ভোগে পার্টনার নিয়ে।vasomotor syndrome এর কারণে অদ্ভুত সব শারিরীক ডিজকম্ফোর্ট হয়।প্রচুর ঘামা,শরীর জ্বালা করা ইত্যাদি।চলুন আমরা মেনোপজকে হ্যাপি বানাই।তাদের বোঝাই You are really aging gracefully.