
11/01/2023
গতকাল ছিল ১০ই জানুয়ারী।কেউ কী জানেন আজ থেকে ঠিক ১৯৫ বছর আগে ১৮৩৬ সালের এই দিনেই হয়েছিল আধুনিক ভারত উপমহাদেশের প্রথম Dissection?
আজকে বলছি সেই ঘটনা।
শেকল ভাঙার আওয়াজ....... 💥
সালটা তখন ১৮৩৬।ভারতবর্ষে তখন চলছে ইংরেজ রাজত্ব।প্রবল প্রতাপে ভারতবর্ষ শাসন করছেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক।তাঁর আমলেই ১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতবর্ষ তথা এশিয়ার সর্বপ্রথম মেডিকেল কলেজ "কলকাতা মেডিকেল কলেজ"।
সেদিন ছিল ানুয়ারি, ১৮৩৬ সাল। সেদিন মেডিকেল কলেজের সব দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে হামলার আশঙ্কায়।বাইরে সশস্ত্র পুলিশ প্রহরা।কারণ গেটের বাইরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে রক্ষণশীল সমাজ। আবার মধুসূদনের সমর্থনে রাস্তায় বেরিয়েছেন নব্যবঙ্গের সমর্থকরা। কলকাতা জুড়ে চাঞ্চল্য। আর ভেতরে ডক্টর গুডিভের সঙ্গে অ্যানাটমি রুমে ঢুকলেন মধুসূদন। তাঁর ছুরির টানে তৈরি হল ইতিহাস। ভেঙে গেলো রক্ষণশীলতার দরজা। নব চেতনায় উদ্বুদ্ধ হল ভারতের চিকিৎসাবিদ্যা। শুধু ভারত কেন, ইতিহাস বলছে তিনি হলেন প্রথম এশীয় ছাত্র যিনি বিজ্ঞানসম্মত ভাবে শব ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন।এই কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খবর পৌঁছে গেল ইংরেজ সরকারের উপরমহলে।এই অর্জনকে উদযাপনের জন্যে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে গর্জে উঠল ইংরেজ সেনার কামান।একটানা ৫০ বার তোপধ্বনি করল ইংরেজ সেনা।শুধুমাত্র তাঁর কৃতিত্বকে সম্মান জানিয়েই ৫০ বার তোপধ্বনি করেছিলো কলকাতার ইংরেজ সরকার। তাঁর দেখানো পথে পরের বছরই ৬০ টি শব ব্যবচ্ছেদ করেছিলো ভারতীয় ছাত্ররা। রক্ষণশীল সমাজ ভেসে গিয়েছিলো সেই আধুনিকতার স্রোতে। আর সেই ধারার ভগীরথ ছিলেন মধুসূদন গুপ্ত। 🥀🥀
কিন্তু কীভাবে সম্ভব হয়েছিল এত কিছু? উত্তরটা পেতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে আরও বেশ কিছুটা।
তখন সময়টা ১৮৩৬ সাল। গভীর আলোচনায় মগ্ন ডেভিড হেয়ার, কলকাতা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মিস্টার ব্রামলি এবং অ্যানাটমি বিভাগের প্রধান মিস্টার গুডিভ। অনেকক্ষন পর হেয়ার সাহেব বললেন, মধুসূদনকে ডাকো। আমি বলবো তাকে। আবার ডাক পড়লো মধুর। এর আগেও একবার মধুসূদনের শরণাপন্ন হয়েছিলেন তাঁরা। ভারতবন্ধু গভর্নর লর্ড উইলিয়াম বেণ্টিঙ্ককে তাঁরা বুঝিয়েছিলেন এতো বড় ভারতবর্ষে চিকিৎসা হয় আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি পদ্ধতিতে। আধুনিক এলোপ্যাথি চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা নেই এখানে। তাই এখানে একটি এলোপ্যাথি মেডিক্যাল কলেজ গড়ে তোলা দরকার। বড়োলাট জিজ্ঞাসা করলেন, প্রতিষ্ঠান গড়লেই তো হবেনা। পড়ানোর মতো অধ্যাপক কোথায় পাবেন। বিশেষ করে ভারতীয় ভাষায় পড়ানোর তো কেউ নেই। সেদিন প্রথম ডাক পরেছিল মধুসূদন গুপ্তর।
কে এই মধুসূদন......?
বারবার তাঁর ডাক পড়ে কেন? হুগলীর বৈদ্যবাটির গুপ্ত পরিবারের সন্তান তিনি। জন্ম আনুমানিক ১৮০০ সালে। তাঁরা বংশপরম্পরায় বৈদ্য পরিবার। তাঁর পিতামহ ছিলেন ব্রিটিশপূর্ব আমলে তৎকালীন বাংলার নবাব পরিবারের চিকিৎসক। সেই পরিবারের সন্তান চিকিৎসাবিদ্যায় আগ্রহী হবে এতে আর আশ্চর্য কি? ১৮২৬ সালে সংস্কৃত কলেজের আয়ুর্বেদ বিভাগে তিনি ভর্তি হন। প্রথম থেকেই আধুনিক চিকিৎসা ও শারীরবিদ্যায় ছিল তাঁর অসীম আগ্রহ। এইসময় তিনি কাঠ ও মোম দিয়ে বানানো মানুষের হাড়ের মডেল নিয়ে আগ্রহভরে দেখতেন তা। ইংরাজিতে লেখা আধুনিক চিকিৎসাগ্রন্থ শুধু পড়তেন না, সেগুলিকে আরবি ও সংস্কৃতে অনুবাদও করেছিলেন তিনি। পণ্ডিতেরা তাঁর মেধা ও অধ্যবসায় দেখে বিস্মিত হতেন।
এইসময়ে আয়ুর্বেদ অধ্যাপক ক্ষুদিরাম বিশারদ অসুস্থ হয়ে পড়লে অধ্যক্ষ মধুসূদনকে সহ-অধ্যাপক হিসাবে ৩০টাকা বেতনে নিযুক্ত করেন। একজন ছাত্র কীভাবে অধ্যাপনা করবে তা নিয়ে অন্য ছাত্ররা সন্দিহান ও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। কিন্তু নিজ পাণ্ডিত্যে মধুসূদন সবার আস্থা অর্জন করলেন শুধু না, প্রিয় অধ্যাপক হয়ে উঠলেন। আর এরপর ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে গড়ে উঠলো কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ। তার তখনই ভারতীয় অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেবার জন্য হেয়ার সাহেব, ব্রামলি সাহেব তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন। আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও দায়িত্ব নিতে পিছিয়ে যাননি তিনি।১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে একই সঙ্গে ছাত্র ও সহকারি অধ্যাপক হিসাবে মেডিকেল কলেজে যোগ দিলেন তিনি।
একবছরের মধ্যে আবার তাঁর ডাক পড়লো কেন? এবার সমস্যা গুরুতর। ডাক্তারি শিখতে গেলে অ্যানাটমি বা শব ব্যবচ্ছেদ জরুরী। কিন্তু ভারতীয় ছাত্রগন সংস্কারের কারনে এই কাজে রাজি নয়। তার সঙ্গে আছে কুসংস্কারাচ্ছন্ন রক্ষণশীল গোঁড়া সমাজের হুমকি ও রক্তচক্ষু। কিছুতেই কলকাতার বুকে এই অনাচার(!!!) তাঁরা হতে দেবেন না। এদিকে শব ব্যবচ্ছেদ ছাড়া তো মেডিকেল শিক্ষাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই সঙ্কট থেকে উদ্ধার পেতে আবার ডাক পড়লো মধুসূদনের।
সব শুনলেন তিনি। তারপর বললেন আমি করবো শব ব্যবচ্ছেদ। অধ্যক্ষ বললেন রক্ষনশীল সমাজ যদি বাধা দেয়। মধু বললেন বুঝিয়ে দেবো তাদের যুক্তি দিয়ে। প্রত্যয়ী তিনি। নতুন কাজের দায়িত্ব পেয়ে উদ্দীপ্ত। মুখে মুখে ছড়িয়ে গেলো সেই খবর। কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে গেলো রক্ষণশীল সমাজের কানে। বিক্ষোভে উত্তাল হল অন্ধবিশ্বাসী সমাজ।
পরদিন তাঁর বাড়িতে দলবেঁধে এলো গোঁড়া পণ্ডিতদল। শব ব্যবচ্ছেদ না বন্ধ করলে সমাজচ্যুত করা হবে তাঁকে। তাঁর পিতা ডেকে পাঠালেন তাঁকে। তিনি ধীর অথচ আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গীতে বোঝাতে শুরু করলেন অ্যানাটমির প্রয়োজনীয়তা। সবের পরেও গোঁড়া পণ্ডিতেরা আবার ধর্মীয় যুক্তি দিলো। তিনি তখন তুলে ধরলেন ভারতবর্ষের চিকিৎসাবিজ্ঞানের গর্ব, প্রাচীন ভারতের প্রবাদপ্রতিম,কিংবদন্তীতুল্য ও চিরস্মরণীয় চিকিৎসক সুশ্রুতের শব ব্যবচ্ছেদের উদাহরন। আর যুক্তি খুঁজে পেল না রক্ষণশীলরা। পিতা তাঁকে আশীর্বাদ করে বললেন, আমরা জাতে বৈদ্য। চিকিৎসা আমাদের ধর্ম। আশীর্বাদ করি চিকিৎসার নব দিগন্ত খুলে যাক তোমার হাতে। ইতিহাস তৈরী করলেন আজকের দিনে এক বঙ্গসন্তান ! 🏵️
চিকিৎসাবিদ্যা অন্তপ্রাণ এই মানুষটি ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন। মেডিকেল কলেজের দেশীয় বিভাগের পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁর হাতে। তাঁর পরামর্শে ম্যালেরিয়া, কলেরা থেকে বাঁচার জন্য ইংরেজ সরকার বিশুদ্ধ পানীয় জল, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ রাখার বিশেষ উদ্যোগ নেন। হিন্দু ধাত্রী সমিতি গঠন করে তিনি কলকাতার প্রসূতিদের মৃত্যু রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নেন। সেই যুগে দাঁড়িয়ে তাঁর অবদান ভোলার নয়।যেই শব ব্যবচ্ছেদ করার জন্য তিনি চিরস্মরণীয়,সেই শব ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়েই জীবানু সংক্রমনে সেপ্টিসিমিয়াতে আক্রান্ত হয়ে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই নভেম্বর মৃত্যু হয় এই মহাপ্রাণের। সারা জীবন চিকিৎসা বিদ্যা চর্চা করার পর এই বিদ্যা চর্চাই প্রাণ নিলো তাঁর। 🛑
আমরা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মনে রাখি,স্মরণ করি, কিন্তু মনে রাখিনা এইরকম দেশসেবকদের। যারা সমৃদ্ধ করেছেন দেশকে। এনেছেন আধুনিকতার আলো, কিন্তু নিজেরা চলে গেছেন বিস্মৃতির অন্ধকারে। প্রণাম জানাই আজ ভারতীয় উপমহাদেশের চিকিৎসাবিদ্যার কাণ্ডারি মধুসূদন গুপ্তকে।🌹
CMOSHMC
2017-18