
20/07/2025
মেনোপজ (Menopause) বা রজঃনিবৃত্তি:
নারীদের যখন প্রথম মাসিক শুরু হয় তখন সেটাকে বলে মেনার্কি (Menarche) আর যখন শেষ হয়ে যায় তখন সেটাকে বলা হয় মেনোপজ।
বিস্তারিতভাবে বললে, নারীদের মধ্য বয়সের পর স্থায়ীভাবে মাসিক/ঋতুস্রাব/পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যাওয়াকে মেনোপজ বলে।
সাধারণত ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সের মধ্যে হয়ে থাকে মেনোপজ। তবে গড়ে ৫১ বছর বয়সে মেনোপজ হয়।
এ সময় একজন নারীর স্বাভাবিক সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং প্রচুর শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন আসে। বিশেষ করে হাড়ের উপর এর প্রভাব আছে। সঠিক যত্ন না নিলে অনেক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ভয় পাওয়ার কিছু নেই; মেনোপজ একজন নারীর জীবনের একটি স্বাভাবিক শারীরিক পরিবর্তন। এটি কোন রোগ নয়।
মেনোপজ কেন হয়?
নারীদের শরীরে এই পরিবর্তনের মূল কারণ ইস্ট্রোজেন (Estrogen) নামের একটি হরমোন।
একজন নারী সাধারণত একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ডিম্বাণু নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন, যেগুলো তার জরায়ুতে (ইউটেরাসে) সংরক্ষিত থাকে। জরায়ু নারীদের শরীরে ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন হরমোন তৈরি করে, যেটা প্রতিমাসের মাসিক এবং ওভালুশনকে নিয়ন্ত্রণ করে।
বয়স হতে থাকলে নারীদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের উৎপাদন কমে যেতে থাকে। নারীদের ডিম্বাশয়ে ডিম্বের পরিমাণও কমতে থাকে। পিরিয়ডের পরিমাণ কমতে থাকে। যখন জরায়ু থেকে ডিম্বাণু নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায় এবং মাসিক বন্ধ হয়ে যায়, তখনই মেনোপজ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় জন্ম দেওয়ার প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যায়।
অনেক সময় কোন অস্ত্রোপচারের কারণে যদি কোনও নারীর দুটো ওভারি অথবা জরায়ু ফেলে দিতে হয় তাহলেও হঠাৎ মেনোপজ হয়ে যায়।
মেনোপজের ধাপসমূহ
মেনোপজের রূপান্তরটি ধীরে ধীরে হয় এবং তিনটি ধাপে ঘটেঃ
১। পেরিমেনোপজঃ মেনোপজ শুরুর ২-৩ বছর আগের সময়কে বলা হয় পেরিমেনোপজ। এই সময়, মাসিক অনিয়মিত হয়ে যায় কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হয় না এবং আস্তে আস্তে মেনোপজ-এর লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে।
২। মেনোপজঃ মাসিক অনিয়মিত হতে হতে যখন টানা এক বছর বন্ধ থাকে তখন ধরে নিতে হবে মেনোপজ হয়ে গেছে।
৩। পোস্ট-মেনোপজঃ ডিম্বাশয় থেকে আসা হরমোন ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরোন মেনোপজে বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে পিটুইটারি হরমোন বেড়ে যায়। মেনোপজের পর ইস্ট্রোজেন হরমোন শরীরে আর পুনরুৎপাদন হয় না।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ টানা এক বছর বন্ধ থাকার পর যদি কোন নারীর আবার মাসিক হয় তবে সেটি অস্বাভাবিক। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে এরকম হতে পারে। মেনোপজের এক বছর পর আবার ব্লিডিং হওয়া পোস্ট মেনোপজাল ব্লিডিং। এটা এক ধরনের ডিজঅর্ডার। কোনো ক্যানসারের জন্য হতে পারে, রক্তের ব্যাধি কিংবা জরায়ুর কোনো সমস্যার কারণে ব্লিডিং হতে পারে।
মেনোপজের শারীরিক প্রভাবঃ
হট ফ্ল্যাশ (Hot Flash)ঃ
মেনোপজের কারণে ইস্ট্রোজেন হরমোন কমে গেলে সবচেয়ে প্রথমে যেটা ঘটে সেটা হল হট ফ্ল্যাশ (Hot Flash)। বাইরের কোন উৎস ছাড়াই দিনের মধ্যে কয়েকবার হঠাৎ করে খুব গরম লাগে। মুখ লাল হয়ে যায়, ঘেমে যায়। Hot Flash খুব ঠাণ্ডার দিনেও হতে পারে। Hot Flash এর সময়কাল কয়েক সেকেন্ড থেকে শুরু করে মিনিট দশেক পর্যন্ত হতে পারে।
চুল পড়াঃ
ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরোন হরমোন এর উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে চুল পাতলা হওয়া শুরু হয়।
যৌন মিলনে অনীহাঃ
ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরোন-এর উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে শারীরিকভাবে যৌন মিলনের আগ্রহ অনেকটা কমে যায়। কারো কারো ক্ষেত্রে ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস হয়, যে কারণে যে কারণে যৌন মিলন নারীদের জন্য কষ্টদায়ক হয়ে যায়।
অস্টিওপরোসিস (Osteoporosis)
পুরুষের চেয়ে নারীর হাড়ের পুরুত্ব কম। ইস্ট্রোজেন তাকে এ থেকে নিরাপত্তা দেয়। মেনোপজের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া এই হরমোনের অভাবে হাড়ক্ষয় রোগ অস্টিওপোরোসিস দেখা দেয়। এতে পিঠে, হাঁটুতে, অস্থিসন্ধিতে ব্যথাসহ বিভিন্ন জায়গায় হাড়ের ব্যথা হয়।
অস্টিওপরোসিসে ভুগলে হাড় ভঙ্গুর হয়ে ঝাঁঝরা হয়ে যায়, একদম ফাঁকা ফাঁকা হয়ে যায়। কোনোরকম আঘাত লাগলে হাড় গ্লাসের মত ভেঙে যেতে পারে। কোনোভাবে পড়ে গেলেও হাড় ভেঙে যেতে পারে। এ ছাড়া মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যায়, সামনের দিকে শরীর ঝুঁকে পড়ে। বাঁকা হয়ে হাঁটতে দেখা যায় অনেক নারীকে। হৃদপিণ্ডের ওপরও মারাত্মক প্রভাব পড়ে এতে।
ওজন বৃদ্ধিঃ
মেনোপজের সময়ে দ্রুত ওজন বৃদ্ধি একটা অন্যতম সমস্যা। এটার কারণে হাঁটু , কোমর এবং পিঠের ব্যথায় ভোগেন অনেকে। ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরোন হরমোন হ্রাসের কারণে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে আস্তে আস্তে। এই ওজন বৃদ্ধির ফলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
অনিদ্রাঃ
মেনোপজ এর সময়ে মহিলাদের আরেকটা সমস্যা হলো ঘুম না হওয়া বা ঘুম হলেও ঘুম থেকে ওঠার পরেও সারাদিন ঘুম ঘুম লাগা বা ক্লান্তি লাগা । অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায় রাতে ঘুম থেকে উঠে বসে আছেন। যার কারণ হট ফ্ল্যাশ বা প্রচণ্ড ঘেমে যাওয়া। আবার এই বয়সে অনেকে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্ত চাপ বা অন্য কোন অসুখের কারণে ওষুধ শুরু করেন। এসব ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবেও অনিদ্রা হতে পারে।
মেনোপজের মানসিক প্রভাবঃ
মাসিকের কারণে একজন নারী অনেক দিন ধরে একটি শারীরিক অভিজ্ঞতার সাথে বসবাস করেন। কিন্তু মেনোপজের মাধ্যমে তিনি নতুন একটা ধাপে প্রবেশ করেন। তার শরীরের অনেক বড় একটি পরিবর্তন ঘটে, সেই সাথে তার জীবনেও অনেক বড় একটি রূপান্তর ঘটে। অনেকের এসব আমূল পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়।
অনেক নারী মেনোপজ মেনে নিতে পারেন না, বিশেষ করে যাদের তাড়াতাড়ি মেনোপজ হয়। সাধারণত ৪৫ বছর বয়স থেকে মেনোপজ হলেও অনেকের ক্ষেত্রে ৪০ এর পরেই মেনোপজ হয়ে যায়। সে কারণে মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকেন অনেকে। যাদের সন্তান নেই, বিশেষ করে সেই নারীদের ওপর মারাত্মক মানসিক প্রভাব পড়তে দেখা যায়।
এসময় শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের ঘাটতি থাকে বলে সেরেটোনিন (Serotonin) এবং ডোপামিন (Dopamine) হরমোনের ইমব্যালান্স দেখা দেয় শরীরে। যে কারণে ঘন ঘন মুড বদলাতে থাকে। এই হরমোনের পরিমাণ কমে গেলে দুশ্চিন্তা বাড়তে পারে ও মনমরা ভাব হতে পারে। এর আরও একটি কারণ হলো এসময়ের অন্যান্য শারীরিক পরিবর্তন। যেমন- ওজন বেড়ে যাওয়া, চুল পড়া, হট ফ্ল্যাশ। এগুলোর কারণে অনেকেই সারাক্ষণ স্ট্রেস এ ভোগেন যেটা থেকে তুচ্ছ কারণে খিটখিটে মেজাজ দেখা দেয়।
এছাড়া ইস্ট্রোজেন হরমোনের অভাব ত্বকের উপরও প্রভাব ফেলে। ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় এবং মনে হয় যেন ত্বকের নিচে পোকা-মাকড় হাঁটাহাঁটি করছে।
নারীত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার হল সন্তান ধারণের ক্ষমতা। এর সাথেই মাসিকের সম্পর্ক। মাসিকের সাথে আর একটা যে ব্যাপার খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল যৌনতা। অনেক নারীর মনের মধ্যে একটা ভয় থাকে যে সে বোধহয় sexually আর আগের মতো পারফর্ম করতে পারবে না। অনেক নারী মনে করেন স্বামী হয়তো তাকে আর আগের মতো ভালবাসবেন না, তার নারীত্ব হারিয়ে যাবে, এসব চিন্তার কারণে মেনোপজ হওয়ার পর নারীরা অনেকেই আশা হারিয়ে ফেলেন, অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। দেখা যায় কোন সমস্যা না থাকলেও ইনসিকিউরিটি থেকে সমস্যাটা আসলেই দেখা দেয় এবং অনেক নারী যৌনতায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
মেনোপজে করণীয়ঃ
১. নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করতে হবে।
২. নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস করতে হবে।
৩. যোগব্যায়াম করতে হবে।
৪. বসে বসে না কাটিয়ে শারীরিক চলাফেরা সচল রাখতে হবে।
৫. ভারসাম্যপূর্ণ পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
৬. হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি* নিতে হবে।
৭. অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিলে প্রয়োজনে গাইনোকোলজিস্টের পরামর্শ নিতে হবে।
মেনোপজে খাদ্যাভাসঃ
মেনোপজে হাড় ও হৃদপিণ্ডের সুরক্ষায় ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার, শাকসবজি, ফল, মাছ, দুধ, বিশেষ করে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
আর যদি শরীরে লিপিড কনেন্ট বেশি থাকে, ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন বা অন্য জটিল কোনো রোগ থাকে তাহলে সেই অনুযায়ী খাবার খেতে হবে। চর্বিজাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। একইসঙ্গে মানসিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মেনোপজে।
হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি কি?
মেনোপজের কারণে দীর্ঘমেয়াদে নারীদের হাড়ক্ষয় ও হৃদপিণ্ডের ওপর প্রভাব পড়ে। হাড়ের সুরক্ষায় হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি দেওয়ার কথা বলেন চিকিৎসকেরা। যে হরমোন ডিম্বাশয় থেকে আসে যেমন- ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরোন, সেই হরমোন দিতে হবে। যদি কারো জরায়ু থাকে তাহলে তাদের ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরোন দুটোই দিতে হবে। কারো যদি কোনো কারণে জরায়ু না থাকে তাদের শুধু ইস্ট্রোজেন দিতে হবে। যতদিন তার দরকার হয় ততদিন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হরমোনাল থেরাপি দিতে হবে।
কিছু পরামর্শঃ
৩০ বছর বয়স থেকে কিছু বিষয় মেনে চললেই ইস্ট্রোজেন কমে গেলে যে সমস্যাগুলো হয় তার প্রভাব অতটা মারাত্মক হয় না।
এটা সুষম খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম, কায়িক পরিশ্রম ও জীবনে অ্যাক্টিভ থাকার উপর নির্ভর করে। একদম শুরু থেকে যদি লাইফস্টাইলটা এরকমভাবে তৈরি করা হয়, খাবার যদি সুষম হয়, সচেতনতা থাকে তখন অনেক ভালোভাবে অ্যাডাপ্ট করা যায়, জটিলতাগুলো কম হয়।