15/09/2024
বোন ম্যারো (Bone Marrow)
বোন ম্যারো হলো শরীরের রক্তকণিকা তৈরির প্রধান কারখানা। এখান থেকে লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা এবং অণুচক্রিকা উৎপাদিত হয়, যা আমাদের শরীরের অক্সিজেন সরবরাহ, রোগ প্রতিরোধ, এবং রক্ত জমাট বাঁধার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো পরিচালনা করে।
বোন ম্যারো (Bone Marrow) থেকে রক্তকণিকা তৈরির প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ। এটি শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কারণ রক্তকণিকা আমাদের শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সহায়ক হয়।
বোন ম্যারো হলো নরম, স্পঞ্জের মতো টিস্যু, যা বেশিরভাগ হাড়ের অভ্যন্তরে পাওয়া যায়, বিশেষ করে লম্বা হাড় এবং পাঁজরের মধ্যে। বোন ম্যারোতে হেমাটোপয়েটিক স্টেম সেলস (Hematopoietic Stem Cells) নামে বিশেষ কোষ থাকে, যা থেকে বিভিন্ন প্রকার রক্তকণিকা তৈরি হয়।
রক্তকণিকা তৈরির প্রক্রিয়া:
1. হেমাটোপয়েটিক স্টেম সেলস (Hematopoietic Stem Cells):
o বোন ম্যারোর এই স্টেম সেলগুলো রক্তকণিকা তৈরির মূল কোষ। এগুলো নিজে থেকেই নতুন কোষে বিভক্ত হতে পারে এবং একাধিক ধরণের রক্তকণিকা তৈরি করতে পারে। এই কোষগুলোকে "প্লুরিপোটেন্ট" বলা হয়, কারণ এরা বিভিন্ন ধরণের কোষ তৈরি করতে সক্ষম।
2. রক্তকণিকার তিনটি প্রধান ধরণ:
o লোহিত রক্তকণিকা (Red Blood Cells বা RBC):
স্টেম সেল থেকে ইরিথ্রয়েড লাইনেজে (Erythroid Lineage) পরিবর্তিত হয়ে লোহিত রক্তকণিকা তৈরি হয়। এই কণিকার মূল কাজ হলো শরীরের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া। এতে থাকে হিমোগ্লোবিন (Hemoglobin), যা অক্সিজেনের সাথে সংযুক্ত হয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যায়।
o শ্বেত রক্তকণিকা (White Blood Cells বা WBC):
স্টেম সেল থেকে মাইলয়েড ও লিম্ফয়েড লাইনেজে (Myeloid and Lymphoid Lineage) বিভক্ত হয়ে শ্বেত রক্তকণিকা তৈরি হয়। এগুলো আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। শ্বেত রক্তকণিকার বিভিন্ন প্রকার আছে, যেমন নিউট্রোফিল, লিম্ফোসাইট, মোনোসাইট ইত্যাদি। এরা শরীরে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, এবং অন্যান্য রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে।
o অণুচক্রিকা (Platelets):
বোন ম্যারোতে থাকা স্টেম সেলগুলো থেকে মেগাকারিওসাইট (Megakaryocyte) নামক বিশাল কোষ তৈরি হয়, যা পরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুচক্রিকায় ভেঙে যায়। অণুচক্রিকার কাজ হলো শরীরে রক্তপাত হলে রক্ত জমাট বাঁধাতে সাহায্য করা, যাতে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় এবং ক্ষত দ্রুত সারতে পারে।
রক্তকণিকার উৎপাদন এবং নিয়ন্ত্রণ:
বোন ম্যারোতে রক্তকণিকার উৎপাদন প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হয়। যখন শরীরের বেশি অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় বা শরীরে সংক্রমণ ঘটে, তখন মস্তিষ্কের কিছু অংশ, যেমন হাইপোথ্যালামাস এবং থাইমাস, বিভিন্ন হরমোনের নিঃসরণ করে যা বোন ম্যারোকে বেশি রক্তকণিকা উৎপাদন করতে উদ্দীপিত করে।
1. লোহিত রক্তকণিকার নিয়ন্ত্রণ:
যখন শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়, তখন কিডনি ইরিথ্রোপোইটিন (Erythropoietin) নামক একটি হরমোন নিঃসরণ করে, যা বোন ম্যারোতে লোহিত রক্তকণিকা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করে।
2. শ্বেত রক্তকণিকার নিয়ন্ত্রণ:
শ্বেত রক্তকণিকার উৎপাদন সংক্রমণ বা অন্য কোনো আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় বৃদ্ধি পায়। যখন শরীরে কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ ঘটে, তখন ইমিউন সিস্টেম বোন ম্যারোকে বেশি শ্বেত রক্তকণিকা তৈরি করতে নির্দেশ দেয়।
3. অণুচক্রিকার নিয়ন্ত্রণ:
শরীরে রক্তক্ষরণের সময়, বোন ম্যারো থেকে বেশি পরিমাণ অণুচক্রিকা তৈরি হয়, যাতে ক্ষতস্থানে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে।
বোন ম্যারো এবং রক্ত সম্পর্কিত রোগ:
• অ্যানিমিয়া (Anemia):
যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ লোহিত রক্তকণিকা তৈরি না হয়, তবে অ্যানিমিয়া দেখা দিতে পারে। এতে শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি হয় এবং দুর্বলতা, মাথা ঘোরা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।
• লিউকেমিয়া (Leukemia):
এটি এক ধরণের ব্লাড ক্যান্সার, যেখানে বোন ম্যারোতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে শ্বেত রক্তকণিকা তৈরি হতে থাকে, যা শরীরের স্বাভাবিক রক্তকণিকার উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করে।
• থ্রোম্বোসাইটোপেনিয়া (Thrombocytopenia):
এটি একটি অবস্থা যেখানে শরীরে পর্যাপ্ত অণুচক্রিকা তৈরি না হলে রক্তক্ষরণ বেশি হতে পারে এবং ক্ষতস্থানে রক্ত জমাট বাঁধতে দেরি হয়।