28/06/2025
টেক্সট নেক কী?
বর্তমান ডিজিটাল যুগে স্মার্টফোন, ট্যাবলেট এবং ল্যাপটপের মতো ডিভাইসগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাড় নিচু করে এসব ডিভাইস ব্যবহার করার ফলে আমাদের ঘাড় ও মেরুদণ্ডে এক ধরনের অস্বস্তিকর ব্যথা ও চাপ সৃষ্টি হয়, যা 'টেক্সট নেক' নামে পরিচিত। এটি মূলত একটি "পুনরাবৃত্তিমূলক চাপজনিত আঘাত" (repetitive stress injury) যা ঘাড়ের স্বাভাবিক অবস্থান পরিবর্তন করে দেয় এবং এর ফলে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।
যখন আমরা ঘাড় নিচু করে ফোন দেখি বা টাইপ করি, তখন ঘাড়ের উপর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি চাপ পড়ে। সাধারণত, আমাদের ঘাড় কিছুটা সামনের দিকে বাঁকানো (সার্ভাইকাল লরডোসিস) থাকে, যা ঘাড়ের নড়াচড়ায় সাহায্য করে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ ঘাড় নিচু করে রাখলে এই বাঁকানো অবস্থা অতিরিক্ত বেড়ে যায়, যা ঘাড়ের পেশী, লিগামেন্ট এবং ডিস্কের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলে ঘাড়ের পেশী শক্ত হয়ে যায়, ব্যথা হয় এবং নড়াচড়া কঠিন হয়ে পড়ে।
টেক্সট নেকের সাধারণ লক্ষণ:
* ঘাড়ে ব্যথা: ঘাড়ের নিচের অংশে বা কাঁধের চারপাশে হালকা থেকে তীব্র ব্যথা।
* পেশী শক্ত হয়ে যাওয়া: ঘাড়ের পেশীগুলি শক্ত এবং টানটান হয়ে যাওয়া, যার ফলে ঘাড় ঘোরাতে অসুবিধা হয়।
* মাথাব্যথা: ঘাড়ের পেছন থেকে শুরু হয়ে মাথার সামনের দিকে ছড়িয়ে পড়া মাথাব্যথা (টেনশন টাইপ বা সার্ভিকোজেনিক হেডেক)।
* কাঁধ ও বাহুতে ব্যথা/ঝিনঝিন: ঘাড় থেকে ব্যথা কাঁধ বা বাহুতে ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমনকি অসাড়তা বা ঝিনঝিন অনুভূতিও হতে পারে।
* মেরুদণ্ডের সমস্যা: দীর্ঘমেয়াদী টেক্সট নেকের ফলে মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক বক্রতা (thoracic kyphosis) পরিবর্তিত হতে পারে, যা ডিস্কের সমস্যা (যেমন হার্নিয়েটেড ডিস্ক) এবং অকালে আর্থ্রাইটিসের কারণ হতে পারে।
টেক্সট নেকের ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা
টেক্সট নেকের চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি একটি অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি। ফিজিওথেরাপি ব্যথা কমানো, ঘাড়ের নড়াচড়া স্বাভাবিক করা, পেশী শক্তিশালী করা এবং সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখতে সাহায্য করে। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীর অবস্থা মূল্যায়ন করে একটি নির্দিষ্ট চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করেন।
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মূল দিকগুলো:
১. ব্যথা কমানো (Pain Management):
* ঠান্ডা বা গরম সেঁক: ব্যথা এবং ফোলা কমাতে ঠান্ডা সেঁক এবং পেশী শিথিল করতে গরম সেঁক ব্যবহার করা যেতে পারে।
* ম্যানুয়াল থেরাপি: ফিজিওথেরাপিস্ট হালকা ম্যাসাজ, জয়েন্ট মোবিলাইজেশন এবং সফট টিস্যু রিলিজ কৌশল ব্যবহার করে পেশী টান এবং জয়েন্টের শক্তভাব কমাতে পারেন।
* আল্ট্রাসাউন্ড বা টেনস (TENS): কিছু ক্ষেত্রে, ব্যথা কমাতে আল্ট্রাসাউন্ড বা ট্রান্সকিউটেনিয়াস ইলেকট্রিক্যাল নার্ভ স্টিমুলেশন (TENS) এর মতো ইলেক্ট্রোথেরাপি ব্যবহার করা হয়।
২. ব্যায়াম থেরাপি (Exercise Therapy):
* স্ট্রেচিং ব্যায়াম: ঘাড় ও কাঁধের টাইট পেশীগুলো শিথিল করার জন্য নির্দিষ্ট স্ট্রেচিং ব্যায়াম শেখানো হয়। যেমন:
* চিন টাক (Chin Tuck): ঘাড় সোজা রেখে চিবুক বুকের দিকে টেনে ধরা। এটি ঘাড়ের পেছনের পেশীগুলোকে লম্বা করে এবং সামনের পেশীগুলোকে শক্তিশালী করে।
* নেক এক্সটেনশন (Neck Extension): ঘাড়ের পেশীগুলোকে আলতো করে পেছনের দিকে টেনে ধরা।
* শোল্ডার শ্রাগস (Shoulder Shrugs): কাঁধ উপরে উঠিয়ে নিচে নামানো, যা ঘাড় এবং কাঁধের পেশীগুলোকে শিথিল করতে সাহায্য করে।
* শক্তিশালীকরণের ব্যায়াম (Strengthening Exercises): ঘাড়, কাঁধ এবং উপরের পিঠের দুর্বল পেশীগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য ব্যায়াম দেওয়া হয়। যেমন:
* নেক আইসোমেট্রিকস (Neck Isometrics): হাতের সাহায্যে ঘাড়ের বিভিন্ন দিকে চাপ সৃষ্টি করে পেশী শক্তিশালী করা।
* রোটেটর কাফ শক্তিশালীকরণ: কাঁধের পেশী শক্তিশালী করার ব্যায়াম।
* লোয়ার ট্র্যাপিজিয়াস শক্তিশালীকরণ: উপরের পিঠের পেশী শক্তিশালী করার ব্যায়াম, যা সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
* পোশ্চারাল কারেকশন ব্যায়াম: সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখার জন্য বিশেষ ব্যায়াম শেখানো হয়।
৩. সঠিক ভঙ্গি প্রশিক্ষণ (Postural Education):
* ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীকে বসা, দাঁড়ানো এবং ডিভাইস ব্যবহারের সময় সঠিক ভঙ্গি সম্পর্কে নির্দেশনা দেন।
* ডিভাইস ব্যবহারের নিয়ম:
* মোবাইল ফোন বা ট্যাবলেট চোখের স্তরে ধরে রাখা। প্রয়োজনে টেবিল বা স্ট্যান্ড ব্যবহার করা।
* ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের স্ক্রিন চোখের স্তরে রাখা এবং কিবোর্ড ও মাউস হাতের নাগালের মধ্যে রাখা।
* প্রতি ২০-৩০ মিনিট পর পর ছোট বিরতি নেওয়া এবং কিছু স্ট্রেচিং ব্যায়াম করা।
* দীর্ঘক্ষণ এক ভঙ্গিতে বসে থাকা এড়িয়ে চলা।
* ঘুমানোর সময় সঠিক বালিশ ব্যবহার করা, যা ঘাড়ের স্বাভাবিক বক্রতাকে সমর্থন করে।
৪. জীবনযাত্রার পরিবর্তন (Lifestyle Modification):
* নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ এবং ব্যায়ামের গুরুত্ব বোঝানো।
* পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুম নিশ্চিত করা।
* চাপ কমানোর কৌশল (যেমন মেডিটেশন) শেখানো, কারণ মানসিক চাপ পেশী টান বাড়াতে পারে।
কখন ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে যাবেন?
যদি আপনার ঘাড়ে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা থাকে, ঘাড় ঘোরাতে কষ্ট হয়, মাথাব্যথা হয় বা কাঁধ/বাহুতে অসাড়তা অনুভব করেন, তবে একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্টের সাথে পরামর্শ করা জরুরি। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে টেক্সট নেকের জটিলতা এড়ানো সম্ভব এবং সুস্থ জীবনযাপন করা যায়।
মনে রাখবেন, ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তিত হয়। তাই, একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে আপনার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত চিকিৎসা পরিকল্পনা গ্রহণ করুন।
© ইন্দিরা ভট্টাচার্য্য
☎️ 017455-60150
#সিটিফিজিওকেয়ার