12/07/2025
ক্লোনিং আসলে কী? নকল মানুষ?
ক্লোনিং শব্দটা শুনলেই আমাদের মাথায় যেন সিনেমার মতো কিছু দৃশ্য ভেসে ওঠে—একজন মানুষের হুবহু কপি বানিয়ে ফেলা, একটা ‘নকল মানুষ’ তৈরি করে ফেলা। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা মোটেই এতটা সহজ বা অলৌকিক কিছু না। এটা আসলে বিজ্ঞানের একটা জটিল আর গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যেখানে প্রাণী বা কোষের জেনেটিক কপি তৈরি করা হয়।
সবচেয়ে সহজভাবে বললে, ক্লোনিং মানে হচ্ছে কোনো প্রাণীর জেনেটিক তথ্য অবিকল রেখে আরেকটা নতুন কপি তৈরি করা। এই ‘নকল’ বললে আসলে ভুল হবে, কারণ ক্লোন জীবটা পুরোপুরি জীবন্ত, আর তারও নিজস্ব অস্তিত্ব থাকে।
ক্লোনিং কত রকম?
বিজ্ঞানীরা ক্লোনিংকে সাধারণভাবে তিন ভাগে ভাগ করে থাকেন:
১. জিন ক্লোনিং (Gene cloning) – এখানে শুধু কোনো নির্দিষ্ট জিন বা DNA অংশ কপি করা হয়। যেমন কোনো একটা ওষুধ তৈরি করতে হলে কোনো জীবাণুর জিন কপি করে কাজটা করা হয়।
২. প্রজনন ক্লোনিং (Reproductive cloning) – এতে গোটা একটা জীব তৈরি হয়। এটার সবচেয়ে আলোচিত উদাহরণ হচ্ছে ভেড়া ‘ডলি’।
৩. থেরাপিউটিক ক্লোনিং (Therapeutic cloning) – এটা মূলত চিকিৎসার জন্য করা হয়। যেমন, স্টেম সেল বানিয়ে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের চেষ্টা।
ডলি: ইতিহাসের প্রথম ক্লোনড স্তন্যপায়ী
১৯৯৬ সালে স্কটল্যান্ডে জন্ম নেয় ডলি নামে একটা ভেড়া। এটা ছিল বিজ্ঞানের এক বড় সাফল্য। ডলিকে বানাতে বিজ্ঞানীরা একটা প্রাপ্তবয়স্ক ভেড়ার শরীরের কোষ থেকে নিউক্লিয়াস বের করে নিয়ে সেটা আরেকটা ডিম্বাণুতে ঢুকিয়ে দেন, যার নিজের নিউক্লিয়াস আগে থেকেই ফেলে দেওয়া হয়েছিল। তারপর সেটা মায়ের গর্ভে প্রতিস্থাপন করে জন্ম দেওয়া হয় ডলির।
তবে এটা করতে গিয়ে প্রায় ২৭৭ বার ব্যর্থতা আসে! এটা থেকেই বোঝা যায়, ক্লোনিং শুধু থিওরিতে নয়, বাস্তবেও অনেক কঠিন আর ঝুঁকিপূর্ণ।
মানুষ ক্লোন করা যাবে?
এই প্রশ্নটাই সবচেয়ে বেশি আলোচিত। টেকনিক্যালি, অর্থাৎ বিজ্ঞানগতভাবে এটা একেবারে অসম্ভব না। কিন্তু আসল সমস্যাটা হচ্ছে নৈতিকতা আর ঝুঁকি। এখন পর্যন্ত যেসব প্রাণী ক্লোন করা হয়েছে, তাদের অনেকেই অল্প বয়সেই মারা গেছে, কারও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সমস্যা ছিল, কারও আবার বার্ধক্যজনিত লক্ষণ দেখা দিয়েছে খুব অল্প বয়সেই।
ধরা যাক কোনোদিন মানুষ ক্লোন করা সম্ভব হলোও—তবুও কি সেই মানুষটা হুবহু মূল মানুষের মতো হবে? আসলে না। কারণ মানুষ গড়ে ওঠে তার স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, পরিবেশ আর বেড়ে ওঠার মাধ্যমে। জিন এক হলেও মনটা, চিন্তাভাবনা বা আচরণ কখনোই হুবহু কপি হয় না। ঠিক যেমন যমজ ভাইয়েরা দেখতে এক হলেও তারা আলাদা মানুষ।
ক্লোনিংয়ের ভালো দিকগুলো
সব দিকেই শুধু সমস্যা আছে, এমন না। ক্লোনিং প্রযুক্তি অনেক ভালো কাজেও ব্যবহার হতে পারে। যেমন—
কোনো দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির নিজের কোষ থেকে যদি অঙ্গ তৈরি করা যায়, তাহলে প্রতিস্থাপনে ঝুঁকি কমে যাবে।
বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীগুলো আবার ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। যেমন, ডাইনোসর নয়, কিন্তু ‘উলি ম্যামথ’ নিয়ে গবেষণা চলছে।
স্টেম সেল ক্লোন করে হয়তো ভবিষ্যতে ক্যানসার, পারকিনসনসের মতো রোগের চিকিৎসা আরও উন্নত করা যাবে।
তাহলে নকল মানুষ?
না, ক্লোনিং মানেই নকল মানুষ নয়। মানুষ এমন একটা জটিল প্রাণী যার মধ্যে শুধু DNA না, মন-মানসিকতা, মূল্যবোধ, অনুভূতি—সবকিছু থাকে। এগুলো কোনো ল্যাবে বানানো যায় না। কেউ যদি কোনোদিন ক্লোনড হয়েও যায়, সে তার নিজের মতোই ভাববে, হাসবে-কাঁদবে।
অতএব, ক্লোনিং মানে রোবট বানানো না। এটা জীববিজ্ঞানের একটা চমৎকার অংশ, যেটা নিয়ে এখনো অনেক গবেষণা চলছে। ভবিষ্যতে হয়তো চিকিৎসা ক্ষেত্রে এর প্রভাব আরও বড় হবে, কিন্তু "নকল মানুষ" তৈরি করে দুনিয়া বদলে যাবে—এই চিন্তাটা এখনো কল্পবিজ্ঞানেই ভালো মানায়।
ক্লোনিং একটা মজার কিন্তু গভীর বিজ্ঞানচর্চার বিষয়। এটা যেমন আশার আলো হতে পারে, তেমনি ভুলভাবে ব্যবহার হলে হতে পারে ভয়ংকরও। আমরা যদি এটাকে শুধু “নকল মানুষ বানানো” বলে ফেলি, তাহলে আসল বিজ্ঞানটাই আমরা মিস করবো। বরং, বোঝা দরকার—এই প্রযুক্তি মানুষ বা জীবনের প্রতি দায়িত্ববোধের সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত, যাতে ভবিষ্যত পৃথিবী হয় আরও ভালো, আরও মানবিক।