
03/08/2025
আঘাত বা ইনজুরি ও অভ্যন্তরীণ রোগের মধ্যে পার্থক্য কী? এটা বোঝা কেন জরুরি?
বেনজির আহমেদ (বিকাশ)
৫ম ব্যাচ, হোমওডাইজেস্ট
গাইডেন্স প্রোগ্রাম
রোগ আমাদের Organism এ লক্ষণসমষ্টির মাধ্যমে (signs and symptoms) প্রকাশিত হয়, তবে সকল লক্ষণের দ্বারাই রোগের বর্হিঃপ্রকাশ ঘটে না। যেহেতু, জীবনীশক্তির বিচ্যুতিই রোগ সুতরাং একটি লক্ষণ যদি জীবনীশক্তির বিচ্যুতির সাথে সম্পর্কিত না হয় তাহলে সেটিকে রোগের লক্ষণ বলা যাবে না (প্রকৃত রোগ বা অভ্যন্তরীণ রোগ)।
সকল আঘাতই আমাদের মধ্যে লক্ষণ তৈরি করে এবং সেই লক্ষণগুলো হলো সত্যিকারের local malady (স্থানীয় রোগ), যা সাধারণত আক্রান্ত অংশের মধ্যে সীমিত থাকে (রোগ বা জীবনীশক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে না)। এবং সেই অবস্থাটি জটিলতা প্রাপ্ত না হলে (চির রোগে রূপান্তরিত না হলে) বেশিরভাগ লক্ষণগুলো সময় এমনিতেই দূর হয়, আবার অনেক সময় তীব্র আঘাতজনিত অবস্থায় ইমারজেন্সি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, যেমন, হাঁড় ভেঙে যাওয়া, জয়েন্ট এর স্থানচ্যুতি, আঘাতজনিত অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বা রক্ত বন্ধ না হওয়া, ইত্যাদি। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ রোগ হলো, একজন ব্যক্তির সম্পূর্ণ অস্তিত্বের রূপান্তর বা তার জীবনীশক্তির রূপান্তর, যেটিকে আমরা সাধারণভাবে চির রোগ বলে উল্লেখ করে থাকি, যার মূলে থাকে মায়াজম বা প্রাপ্ত ও অর্জিত প্রিডিসপোজিশন। একটি রোগে রোগীর তিনটি স্তরের যেকোনো একটি, দুইটি বা তিনটিতেই লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। এর মধ্যে স্থানীয় লক্ষণও অর্ন্তভুক্ত, তবে সেগুলো জীবীশক্তির দ্বারা সৃষ্ট। সুতরাং, আঘাত বা ইনজুরি ও অভ্যন্তরীণ রোগের মধ্যে পার্থক্য হলো, ইনজুরি কোনো রোগ নয় বা এটি রোগাগ্রস্ত জীবনীশক্তির থেকে সৃষ্ট নয় এবং অভ্যন্তরীণ রোগ জীবনীশক্তির রোগসূচক পরিবর্তন থেকে সৃষ্ট (মায়াজমের কারণে)। তবে উপযুক্ত পরিবেশে বা রোগীর মধ্যে উপযুক্ত প্রিডিস্পোজিশন থাকলে ইনজুরি চিররোগে রূপান্তরিত হয়।
আবার, একটি কেইসে রোগীর লক্ষণসমষ্টি সংগ্রহ করার পর ঔষধ প্রয়োগের জন্য একটি নির্দিষ্ট এপ্র্যোচ বাছাই করতে হয়, তা হতে পারে Recent Injury, Layer or Remote injury, Constitutional, ইত্যাদি। রোগীর বর্তমান অবস্থাটি আঘাতের তরুণ প্রকাশ, আঘাত জনিত সৃষ্ট লেয়ার না আঘাতের ফলে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ধাতুগত অবস্থা, ইত্যাদি বিষয়গুলো নির্ধারণ করার জন্য ইনজুরি ও অভ্যন্তরীণ রোগের মধ্যে পার্থক্য বোঝা বা নিরুপণ করা অপরিহার্য। অন্যথায় চিকিৎসক ভুল লক্ষণের উপর নির্ভর করে ভুল ঔষধ প্রয়োগ করে বসবেন, যা একই সাথে রোগী, চিকিৎসক এবং হোমিওপ্যাথির জন্য অকল্যাণকর।
একটা ইনজুরি একজন ব্যক্তির স্বাস্থ্যের অবস্থাতে কী কী দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন সাধন করতে পারে? কখন ও কীভাবে এই পরিবর্তন ঘটে?
একটি ইনজুরি একজন ব্যক্তির স্বাস্থ্যের অবস্থাতে কিধরনের পরিবর্তন ঘটাবে, তার স্থয়িত্ব কেমন হবে তা নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের উপর, ১) ইনজুরি ধরন, তীব্রতা, ইত্যাদি, ২) আঘাপ্রাপ্ত ব্যক্তির জীবনীশক্তির অবস্থা বা প্রিডিসপোজিশন, ৩) ইনজুরির ফলে সৃষ্ট অবস্থাটিকে কিভাবে চিকিৎসা করা হবে তার উপর।
ইনজুরি একজন ব্যক্তির স্বাস্থ্যের অবস্থাতে যেসকল দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন সাধন করতে পারে, যথা,
1. রোগীর মধ্যে নতুন একটি লেয়ার তৈরি — এক্ষেত্রে রোগীর জীবীনশক্তিতে ফ্রিকোয়েন্সির কিছু অংশের পরিবর্তন ঘটে যা নির্দিষ্ট কিছু লক্ষণের দ্বারা প্রকাশ পায়।
2. রোগীর বর্তমান রোগাবস্থার বৃদ্ধি — কিছুক্ষেত্রে রোগীর মধ্যে কোনো লেয়ার তৈরি না হয়ে রোগীর সার্বিক রোগাবস্থা বা জীবনীশক্তির ফ্রিকোয়েন্সিকে সার্বিকভাবে দুর্বল করে ফেলে। ফলে, রোগীর চিররোগের বর্তমান অবস্থাটি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত। এখনে সাধারনত সুপ্ত প্রিডিসপোজিশন সচল হয় না, বরং এক্যটিভ প্রিডিসপোজিশনগুলো আরো শক্তিশালী হয়।
3. রোগীর বর্তমান রোগাবস্থা বা constittution এর রূপান্তর ঘটিে একটি নতুন অবস্থা সৃষ্টি — এটি অনেকটা নতুন লেয়ার তৈরি হওয়ার মতোই তবে এখনে রোগীর সার্বিক অবস্থার রূপান্তর ঘটে বা জীবনীশক্তির ফ্রিকোয়েন্সির রেঞ্জ রোগীর সর্বশেষ বিরাজিত রেঞ্জ থেকে অনেক বেশি পরিমাণে বিচ্যুত হয়। রোগীর কিছু প্রিডিসপোজিশন সচল হয় এবং কিছু দুর্বল হয়। সাধারণত, খুব বেশি মাত্রার ইনজুরি কারণে এমনটি ঘটে।
একিউট রোগাবস্থাকে কেন অভ্যন্তরীণ মায়াজমের সাময়িক স্ফূরণ (Flare-up) বলা হয়- ব্যাখ্যা করুন।
আমাদের Organism এর কেন্দ্রবিন্দু হলো জীবনীশক্তি। এটি Organism এর সকল কার্যকলাপ পরিচালনা করে এবং একই সাথে আমাদের Organism -কে বাহ্যিক পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়। মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন তখনই হয়, যখন একটি Organism বাহ্যিক কোনো কিছু দ্বারা প্রভাবিত হয়, এই প্রভাবের প্রভাবক হলো Initial action। এবং জীবনীশক্তি এই Initial action কে অনুধাবন করে তার মাত্রা অনুযায়ী একটি বিপরীত ক্রিয়া ঘটায় যাকে Counter action বলা হয়। সুস্থ এবং অসুস্থ উভয় অবস্থাতে জীবনীশক্তি অবিরত Initial action এর বিপরীতে Counter action ঘটানোর মধ্যে Homeostatis বজায় রাখে। জীবনীশক্তি যখন রোগশক্তির প্রভাবে পরিবর্তিত হয় তখন জীবনীশক্তি দুর্বল হয়, এটির Counter action সৃষ্টি করার প্রবণতার মধ্যে কিছু পরিবর্তন ঘটে। যার ফলে জীবনীশক্তির সুস্থ অবস্থার মতো Initial action বা উত্তেজক কারণ গুলোকে মোকাবেলা করতে পারে না।
জীবনীশক্তি উত্তেজক কারণগুলোকে যথাযথ ভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হলে জীবনীশক্তির অবস্থা অনুসারে দুইটি ঘটনা ঘটতে পারে, ১) তরুণ রোগ দেখা দেওয়া, ২) রোগীর চির রোগের বৃদ্ধি ঘটা বা জীবনীশক্তির অবনতি — জীবনীশক্তি খুব বেশি পরিমাণে দুর্বল হলে তা উত্তেজক কারণের প্রভাব গুলো দূর করতে পারে না ফলে Homeostasis রক্ষার্থে rebalance ঘটায়। যখন, অসুস্থ জীবনীশক্তি উত্তেজক করণের প্রভাব গুলো দূর করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী থাকে তখন উপযুক্ত উত্তেজক কারণের উপস্থিতিতে তার প্রভাব দূর করার জন্য Organism এ একটি সাময়িক, তীব্র rebalance ঘটায়, এটিকে আমরা তরুণ রোগ বলে জানি। যেহেতু, মায়াজম না থাকলে জীবনীশক্তি দুর্বল হতো না এবং তখন উত্তেজক কারণের প্রভাবগুলো স্বাভাবিকভাবে দূর করার মতো শক্তি তার থাকতে, কিন্তু মায়াজম থাকার দরুন তাকে ঐ একই কাজটি তরুণ রোগ সৃষ্টি করার মধ্যমে করতে হচ্ছে, এজন্য তরুণ রোগাবস্থাকে অভ্যন্তরীণ মায়াজমের সাময়িক স্ফূরণ বলা হয়।
কেন অনেক একিউট রোগাবস্থার পরে এন্টিমায়াজমেটিক ঔষধ দেয়া প্রয়োজনীয় কিংবা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে?
ডাঃ হ্যানিম্যনের মতে তরুণ রোগ হলো মায়াজমের সাময়িক উচ্ছাস। কোনো রোগীরতে তরুণ রোগ দেখা দেওয়ার অর্থ হলো তার জীবনীশক্তি একটি নির্দিষ্ট রেঞ্জের মধ্য দুর্বল বা সাসেটিবল। এবং রোগীর সেই দুর্বলতা, উত্তেজক কারণের ধরন ও তীব্রতা, ইত্যাদি অনুসারে তরুণ রোগটি একটি নির্দিষ্ট ভোগকাল, তীব্রতা ও লক্ষণসমষ্টি নিয়ে প্রকাশ পায়। একটি তরুণ রোগে ভোগার পরে একটি রোগীর জীবনীশক্তিতে তিন ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে, ১) জীবনীশক্তির উন্নতি, ২) বোধগম্য কোনো উন্নতি বা অবনতি ঘটে না, ৩) জীবনীশক্তির অবনতি।
জীবনীশক্তি যদি তরুণ রোগের সাপেক্ষে পর্যাপ্ত দুর্বল থাকে বা অন্য কোনো উপযুক্ত কারন থাকলে অনেক রোগীরা তরুণ রোগে ভোগার পরে তারদের জীবনীশক্তির দুর্বলতার কারণে তাদের মধ্যে থাকা সুপ্ত সসেপ্টিবিলিটি বা প্রিডিস্পোজিশন সচল হয়ে ওঠ। প্রিডিস্পোজিশন সচল হওয়ার দরুন রোগীর ক্রনিক রোগের বৃদ্ধি ঘটে। এজন্যই অনেক একিউট রোগাবস্থার পরে এন্টিমায়াজমেটিক ঔষধ দেয়া বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে, তবে অবশ্যই এক্ষেত্রে রোগীকে পুনঃমূল্যায়ন করার পরেই তাকে ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে।
“Removal of local symptoms results in a heightening of the whole disease.”– ডা. হ্যানিমানের এই কথাটির যৌক্তিকতা ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করুন।
প্রত্যেক লক্ষণ তা যদি indisposition, false chronic disease, uncomplicated injury এর কারণে প্রকাশ না পায়, তখন সেগুলো রোগীর সার্বি রোগের (আভ্যন্তরিন) একেকটি চিহ্ন বহ করে। চির রোগাবস্থায় জীবনীশক্তি তার সার্বিক অবস্থা কিছু অংশে পরিবর্তন ঘটিয়ে রোগশক্তিকে সীমাবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করে, যার শরীরিক স্তরের ফল হলো এই local symptom গুলো এবং এগুলো আভ্যন্তরীণ রোগের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে।
আমরা জানি, আরোগ্য ঘটে জীবনশক্তির উপর থেকে রোগশক্তি প্রভাব দূর হওয়ার মধ্যমে, যা জীবনীশক্তির নিজেই ঘটিয়ে থাকে (ঔষধ শক্তির সাহায্যে)। এই আরোগ্যের প্রবাহ কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে, বা জীবনীশক্তি থেকে পর্যায়ক্রমে শরীরের বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দিকে। এখনে যদি আরোগ্যে ধারাটি এই সঠিক প্রবাহ অনুসরান না করে তখন জীবনীশক্তি পুনরায় একটি rebalance তৈরি করতে হয়, যার ফলে জীবনীশক্তি আরো খারাপ অবস্থা ধারণ করে বা রোগ বৃদ্ধি পায়।
কোনো local symptom যদি সঠিক উপায়ে বা ঔষধ শক্তির সাহায্যে জীবনীশক্তির দ্বারা না দূর করে অন্য উপায় অবলম্বন করা হয়, তখন প্রকৃত রোগটি বা জীবনীশক্তি rebalanced অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে কিন্তু জীবনীশক্তি যে উপায়ে নিজেকে একটি অপেক্ষাকৃত সুস্থ ভারসাম্যের মধ্যে ধরে রেখেছিলো local symptom তৈরি করার মধ্যে তার আর সম্ভব হয় না, ফলে জীবনীশক্তিকে পুনরায় অন্য একটি ভারসাম্যযুক্ত অবস্থা তৈরি করতে হয় (homeostatis, alive, অস্তিত্ব), ফলে রোগের লক্ষণ Organism আরোগ গভীরে প্রকাশ পায়, রোগীর জটিলতা বৃদ্ধি পায়। এজন্য ডাঃ হ্যানিম্যান বলেছেন, “Removal of local symptoms results in a heightening of the whole disease.”।
©️ Homeo Digest