05/12/2023
শীতকালে শিশুদের রোগ ও করণীয়
অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন, সভাপতি, বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতি, সাবেক অধ্যাপক ও পরিচালক, ঢাকা শিশু হাসপাতাল
শীতকালে শিশুদের রোগ ও করণীয়
শীতকালে সবারই কমবেশি ঠাণ্ডা, সর্দি, কাশি, জ্বর হয়। তবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে বলে শিশু ও বয়স্কদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছাড়াও এই সময়ে যে কারোর সাধারণ ঠাণ্ডা, ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা ও ঠাণ্ডাজনিত অ্যালার্জিতে শ্বাসযন্ত্র আক্রান্ত হতে পারে। শীতকালীন শিশুদের এমন কিছু সাধারণ রোগবালাই ও করণীয় হলো :
সাধারণ ঠাণ্ডা
শীতকালে ঠাণ্ডা লাগা বা সর্দি-কাশিতে সবাই আক্রান্ত হতে পারে।
এ অবস্থায় আক্রান্ত শিশুর নাক দিয়ে অনর্গল পানি পড়া, শরীরের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পাওয়া বা হালকা জ্বরজ্বর ভাব, অরুচি বা খেতে অনিচ্ছা এবং সামান্য গলা ব্যথা থাকতে পারে।
ঠাণ্ডার কারণে শিশুর নাক বন্ধ থাকলে নাকে ড্রপ ব্যবহার করতে হবে। ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে সাধারণত লবণ পানির ড্রপ (নরসল ড্রপ) ব্যবহার নিরাপদ। বাল্ব সাকার বা পাম্প দিয়ে নাক পরিষ্কার রাখতে হবে।
জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে। মধু মিশ্রিত কুসুম গরম পানি ও স্যুপ খাওয়ালে কিছুটা উপকার মেলে। অ্যান্টিহিস্টামিন সিরাপও ব্যবহার করা যেতে পারে।
ঠাণ্ডার অ্যালার্জি
বেশি সংবেদনশীল শিশুদের সাধারণত শীত এলেই বারবার ঠাণ্ডার উপসর্গ দেখা দেয় অথবা শীতকালজুড়েই ঠাণ্ডা লেগে থাকে, যাকে কোল্ড অ্যালার্জি বা শীতকালীন সংবেদনশীলতা বলা যেতে পারে।
অনেক বয়স্ক ব্যক্তিও হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন বা শীতজুড়ে অসুস্থ থাকেন। এর বেশির ভাগ হয়ে থাকে কোল্ড অ্যালার্জির কারণে। শীতকালে আর্দ্রতা কম থাকে, আবহাওয়া শুষ্ক ও বাতাস ঠাণ্ডা থাকে। এ সবই সংবেদনশীলতার উদ্রেক করে বলে ঠাণ্ডা লেগে যায়। এ কারণে হাঁচি, কাশি, সর্দি ইত্যাদি দেখা দেয়।
প্রচণ্ড শীতে ঠাণ্ডা বাতাস অনেকের জন্য অ্যালার্জেন হিসেবে কাজ করে এবং এ কারণে সৃষ্ট উপসর্গকে কোল্ড অ্যালার্জি বলা হয়।
তাই ঠাণ্ডা বাতাস থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মাস্ক বা মুখবন্ধনী ব্যবহার করা যেতে পারে, যেটা বর্তমানে করোনার জন্য সবাই ব্যবহার করছি। সালবিউটামল ইনহেলার নেওয়া যেতে পারে, কারণ এই ওষুধ শ্বাসকষ্টের উপসর্গ নিরসনে কার্যকর। দীর্ঘমেয়াদি ভালো থাকার জন্য মনটিলুকাস ট্যাবলেট খেতে হয়।
অ্যালার্জিক রাইনাটিস
শিশু বয়সে তো বটেই, বড়দের মধ্যেও এই সমস্যা বেশ প্রকট। অ্যালার্জিক রাইনাটিসে আক্রান্ত শিশুর প্রায় ৩০ শতাংশ পরবর্তীকালে অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়। এটা মৌসুমি একটা রোগ। অ্যালার্জিক রাইনাটিসে আক্রান্তদের সঙ্গে কোল্ড অ্যালার্জি বা শীতকালীন সংবেদনশীলতার খুব বড় পার্থক্য করা সম্ভব হয় না। তবে অ্যালার্জিক রাইনাটিসের লক্ষণ শীতকাল ছাড়াও বসন্ত, গ্রীষ্ম ও শরতের প্রথম দিকে হতে পারে। যদি হঠাৎ এই সমস্যা ঘটে বা প্রতিবছর একই সময়ে এমন সর্দি হয়, তাহলে মৌসুমি অ্যালার্জি থাকতে পারে। সর্দি ও মৌসুমি অ্যালার্জির লক্ষণ একই হলেও এগুলো আলাদা রোগ।
এ রোগে সাধারণত নাক চুলকানো ও সর্দি, চোখ, মুখ বা ত্বকের চুলকানি, হাঁচি, নাক বন্ধ (ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে) ও ক্লান্তি বা অবসাদ বোধ হয়। অ্যালার্জির কারণে কনজানটিভাইটিস, গলা ব্যথা, সাইনোসাইটিস, অ্যাজমা, অ্যাকজিমা, কান পাকা অসুখ ও গ্রন্থি ফুলে যেতে পারে। এসব রোগীর দুই নাসারন্ধ্রের মধ্যবর্তী প্রাচীর অনেক ক্ষেত্রেই বাঁকা থাকে, নাকে পলিপ বা নাকের সম্মুখভাগের ওপর সমান্তরাল খাঁজ থাকে। শিশুরা অনবরত হাতের তালু দিয়ে নাক ঘষতে থাকে এবং সারাক্ষণ নাক-মুখ কুঁচকায়, চোখের পাতার নিচে নীলচে কালো রঙের ছোপ দাগ দেখা দেয়।
এই রোগ প্রতিরোধে ধুলাবালি, পশু-পাখি, তেলাপোকা, ঠাণ্ডা বাতাস, সিগারেটের ধোঁয়া ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে হবে। কারো সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিহিস্টামিন (সিট্রিজিন, ফেক্সোফিনাডিন), ইন্ট্রা-ন্যাজেল স্টেরয়েডস (বাডিসোনাইডস, ফ্লুকর্টিসোন প্রোপাইয়োনেটস), অ্যান্টি-লিউকেট্রিনস (মনিটিলুকাস) ইত্যাদি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
ব্রংকিওলাইটিস
ব্রংকিওলাইটিস শীতকালে বেশি হয়। এই রোগে শিশুরা শ্বাসকষ্ট ও সর্দি-কাশির মতো সমস্যায় বেশি ভোগে। সাধারণত দুই মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত শিশুদের ক্ষেত্রে এ রোগ হয়। তবে তিন থেকে ৯ মাসের শিশুদের বেশি হয়। ‘রেসপিরেটরি সিনথেটিয়াল’ নামের একটি ভাইরাস ছাড়াও রাইনো ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণে এই রোগ হতে পারে।
এই রোগ হলে প্রথমে আক্রান্ত শিশুর নাক দিয়ে পানি পড়ে। এরপর আস্তে আস্তে কাশি শুরু হয় এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। তখন শ্বাস নেওয়ার সময় বুকের খাঁচা বা পাঁজর দেবে যায় এবং শিশু ঘন ঘন বা দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে। শ্বাস নেওয়ার সময় বুকে সাঁই সাঁই শব্দ বা বাঁশির আওয়াজের মতো শোনা যায়। দুধ টানতে বা খেতে শিশুর কষ্ট হয়। তবে শিশুটি ঠাণ্ডা-কাশি আর অল্প শ্বাসকষ্টে ভুগলেও সেই অর্থে অসুস্থ মনে হয় না। এতে আক্রান্ত শিশুর সাধারণত তেমন জ্বর থাকে না, হলেও তাপমাত্রা কম থাকে।
সাধারণ চিকিৎসা
- নাক-গলা পরিষ্কার রাখুন (বাল্ব সাকার বাল্ব সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে পারেন)।
- জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল ওষুধ খাওয়ান।
- পর্যাপ্ত পানি ও খাদ্য খাওয়ান।
- শ্বাসকষ্টের জন্য নেবুলাইজার (ইপ্রাটোপিয়াম, সালবিউটালিন) অথবা ব্রংকোডাইলেটর সিরাপ (ব্রডিল বা সালমলিন সিরাপ) দেওয়া যেতে পারে।
তবে মনে রাখতে হবে ব্রংকিওলাইটিস রোগে অ্যন্টিবায়োটিকের কোনো প্রয়োজন নেই। এই রোগ প্রতিরোধে শিশুকে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে রাখা যাবে না। উষ্ণ আবহাওয়ায় স্বাভাবিক আলো-বাতাস চলাচল করে এমন ঘরে রাখতে হবে। শীতের তীব্রতা অনুযায়ী হালকা ও নরম কাপড় পরিধান করাতে হবে। ধুলাবালি, ধোঁয়া থেকে শিশুকে দূরে রাখতে হবে, বড়দের শিশুর ঘরে বা সামনে ধূমপান করা যাবে না।
মৌসুমি ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা
মৌসুমি ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা হলো ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের একপ্রকার তীব্র শ্বাস-প্রশ্বাসের সংক্রমণ। সাধারণত এ, বি, সি এবং ডি চার ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস রয়েছে। এর মধ্যে এ এবং বি ভাইরাস দুটিই মৌসুমি মহামারি রোগের কারণ।
এই রোগ হলে হঠাৎ জ্বর, কাশি (সাধারণত শুকনো), মাথা ব্যথা, পেশি ী অস্থিগ্রন্থিতে ব্যথা, অসুস্থতা বোধ, গলা ব্যথা এবং নাক দিয়ে সর্দি ঝড়া, গুরুতর কাশি হতে পারে এবং তা দুই বা আরো অধিক সপ্তাহ ধরে চলতে পারে। এ ছাড়া থাকতে পারে মাথা ব্যথা, শরীর ম্যাজম্যাজ ও ব্যথা, দুর্বলতা বা ক্লান্তি, কাশি, বুকে অস্বস্তি বোধ ইত্যাদি।
উচ্চমাত্রার জ্বর
এই সময় শিশুদের উচ্চমাত্রার (১০০-১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা এরও বেশি) জ্বর হতে পারে। লক্ষণগুলো সাধারণত ১০ দিন থেকে দুই সপ্তাহ স্থায়ী হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসার কোনো প্রয়োজন হয় না এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই সবাই সুস্থ হয়ে যায়। তবে কখনো কখনো বিশেষত উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা মানুষের মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা গুরুতর অসুস্থতা বা মৃৃত্যুর কারণ হতে পারে। গুরুতর রোগ বা জটিলতার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিরা হলেন : গর্ভবতী নারী, পাঁচ বছর বা ৫৯ মাসের কম বয়সী শিশু, বয়স্ক, দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা ব্যক্তিরা (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের রোগ, কিডনি, লিভার রোগ বা ইমিউনোসপ্রেসিভ অর্থাৎ তরঙ্গ প্রতিরোধ অবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত (যেমন—এইচআইভি/এইডস, কেমোথেরাপি বা স্টেরয়েড গ্রহণ বা ক্যান্সার)।
প্রতিরোধ
ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো টিকা। নিরাপদ ও কার্যকর ভ্যাকসিনগুলো এখন পাওয়া যাচ্ছে। ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে রক্ষার জন্য বার্ষিক টিকা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ইনজেক্টেড অ্যাক্টিভেটেড ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিনগুলো সারা বিশ্বে সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে ইনফ্লুয়েঞ্জা জটিলতার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা লোকদের সংস্পর্শে যাঁরা থাকেন তাঁদের জন্য টিকা দেওয়া বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ।
যাঁরা টিকা নিতে পারেন তাঁরা হলেন : গর্ভাবস্থার যেকোনো পর্যায়ের গর্ভবতী নারী। ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশু। বয়স্ক ব্যক্তিরা (৬৫ বছরের বেশি বয়সী)। দীর্ঘস্থায়ী রোগাক্রান্ত ব্যক্তি ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।
নয় অ্যান্টিবায়োটিক
ওপরের সব কটি রোগই ভাইরাস সংক্রমণে ঘটে বিধায় এসবে কখনোই অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয় না। বরং অহেতুক অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে উপকারের চেয়ে অপকারসহ বিভিন্ন জটিলতার আশঙ্কা বেশি থাকে।
তবে শিশুর যদি হাসি-খুশি না থাকে, দেখেই কিছুটা অসুস্থ মনে হয়, তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা যায়, তবে ধরে নেওয়া যেতে পারে সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। যেকোনো বয়সের শিশুরই নিউমোনিয়া হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, শিশুর বয়স যদি তিন মাসের কম হয়, অনেক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে কিংবা তাকে খুব অসুস্থ দেখালে কিংবা বুকের এক্স-রেতে নিউমোনিয়া দেখা দিলে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে। শিশু যদি একেবারে খাওয়া ছেড়ে দেয় কিংবা শ্বাস নেওয়ার গতি দুই মাসের কম বয়সী শিশুর মিনিটে ৬০ বার, দুই মাস থেকে এক বছরের পর্যন্ত প্রতি মিনিটে ৫০ বারের বেশি এবং এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুর মিনিটে ৪০ বারের বেশি হলে কিংবা শিশুর ঠোঁট, জিব নীল হয়ে গেলে তাকে অবশ্যই জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। কারণ এসবই নিউমোনিয়া বা মারাত্মক রোগের লক্ষণ।