
26/04/2025
আমরা প্রতিদিনই অনুভূতি, আবেগ ও মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হই। এই অনুভূতিগুলোকে শনাক্ত করা, প্রকাশ করা এবং বুঝতে পারা আমাদের মানসিক সুস্থতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু কিছু মানুষ আছেন যারা নিজেদের আবেগ চেনেন না, প্রকাশ করতে পারেন না কিংবা সেগুলোর অর্থ বুঝতে অপারগ হন। এই অবস্থাকে বলা হয় অ্যালেক্সিথাইমিয়া (Alexithymia)।
# অ্যালেক্সিথাইমিয়া কী?
অ্যালেক্সিথাইমিয়া একটি সাইকোলজিকাল কন্ডিশন যেখানে একজন ব্যক্তি তার নিজের আবেগ চিহ্নিত করতে এবং তা অন্যদের কাছে প্রকাশ করতে সক্ষম নয়। এই শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ থেকে – 'a' অর্থ ‘অনুপস্থিত’, 'lexis' অর্থ ‘শব্দ’ এবং 'thymos' অর্থ ‘আবেগ’। অর্থাৎ, “অভিব্যক্তির জন্য শব্দের অভাব”।
# সাধারণ লক্ষণসমূহ:
১. নিজের আবেগ বোঝার অসুবিধা:
ব্যক্তি বুঝতেই পারেন না তিনি কেমন অনুভব করছেন। দুঃখ, রাগ, ভয় বা আনন্দ—এসব আবেগের পার্থক্য করা তাদের জন্য কষ্টকর।
২. আবেগ প্রকাশে সীমাবদ্ধতা:
তাদের মুখে, চোখে বা দেহভাষায় খুব কম আবেগ প্রকাশ পায়। অন্যরা তাদের 'ঠাণ্ডা' বা 'অবিবেচক' মনে করতে পারেন।
৩. আবেগভিত্তিক সম্পর্ক গড়তে অসুবিধা:
ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বা সংবেদনশীল যোগাযোগে তারা অস্বস্তি বোধ করেন। প্রেম, বন্ধুত্ব বা পরিবারে আন্তরিকতা গড়ে তোলাও কঠিন হয়।
৪. বডি-সিম্পটম বা শারীরিক উপসর্গে আবেগ প্রকাশ:
অনেক সময় আবেগ চেপে রাখার ফলে সেই আবেগ শরীরের মাধ্যমে প্রকাশ পায়—যেমন বুক ধড়ফড় করা, শ্বাসকষ্ট, পেটের সমস্যা ইত্যাদি।
# কারণসমূহ:
অ্যালেক্সিথাইমিয়ার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে:
১. জেনেটিক বা নিউরোলোজিক্যাল ফ্যাক্টর:
মস্তিষ্কের ইন্সুলা এবং অ্যামিগডালা অংশের কার্যকারিতায় সমস্যা থাকলে আবেগ চেনার ও প্রকাশের প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি হতে পারে।
২. শৈশবের ট্রমা বা অবহেলা:
যাদের শৈশবে মানসিক নির্যাতন, উপেক্ষা বা আবেগ ও অনুভূতির অব্যক্ততা ছিল, তারা বড় হয়ে আবেগ নিয়ে কাজ করতে অসুবিধা অনুভব করেন।
৩. মানসিক রোগের সহাবস্থান:
অ্যালেক্সিথাইমিয়া অনেক সময় ডিপ্রেশন, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD), অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার বা বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের সাথেও সহাবস্থান করে।
# প্রভাব:
অ্যালেক্সিথাইমিয়া থাকলে সম্পর্ক তৈরি ও বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যক্তি নিজের আবেগ না বোঝায় সিদ্ধান্তগ্রহণেও ভুল হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এটি হতাশা, একাকিত্ব এবং আত্মসম্মানহীনতা তৈরি করতে পারে।
# চিকিৎসা ও সমর্থন:
এই অবস্থার সরাসরি কোনো ওষুধ নেই, তবে নিচের থেরাপিগুলো কার্যকর হতে পারে:
১. সাইকোথেরাপি:
বিশেষ করে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (CBT), ডায়ালেক্টিক্যাল বিহেভিয়ার থেরাপি (DBT) এবং ইমোশন ফোকাসড থেরাপি (EFT) কার্যকর।
২. মাইন্ডফুলনেস ও আবেগ চর্চা:
দিনের শেষে নিজের আবেগ কী ছিল তা লিখে রাখা, শরীরের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা এবং ধীরে ধীরে ভাষায় প্রকাশ করার অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে।
৩. পারিবারিক ও সামাজিক সমর্থন:
পরিবার বা ঘনিষ্ঠজনদের বোঝাপড়া এবং সহানুভূতি একজন অ্যালেক্সিথাইমিক ব্যক্তিকে আবেগ চর্চায় সহায়তা করতে পারে।
অ্যালেক্সিথাইমিয়া একধরনের 'অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতা' যা বাহ্যিকভাবে খুব একটা চোখে পড়ে না; কিন্তু অন্তর্গতভাবে মানসিক শান্তি ও সম্পর্কের গভীরতাকে ব্যাহত করে। যত দ্রুত এটি চিহ্নিত ও গ্রহণ করা যাবে, ততই উন্নয়নের পথ খুলে যাবে। আমরা যদি সমাজ হিসেবে আবেগ প্রকাশকে দুর্বলতা না ভেবে মানসিক পরিপক্বতার অংশ হিসেবে বিবেচনা করি, তবে এমন অনেক মানুষের জন্য জীবন আরও অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে।