20/10/2025
মাদক সম্পর্কে ও মাদকাসক্তি চিকিৎসা পুনর্বাসন
দুইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ৩৬ বছর এর বেশী।
দীর্ঘ এই সময়টার অভিজ্ঞতায় কাউন্সিলিং ও চিকিৎসাসেবায় জরিত ২০ বছরের অধিক সময়ে।
বিভিন্ন কেস স্টাডি দেখেছি অধিকাংশ ঘটনায় আমি দেখেছি যেসব বাচ্চারা, টিনএজরা ড্রাগ নিতে শুরু করেছে তারা এই প্রক্রিয়ার ভেতর ঢুকেছে তার বহু আগে।
একটা বিষয় অত্যন্ত পরিস্কার বিভিন্ন মাদকাসক্তি চিকিৎসার উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধ
মাদক গ্রহণের বহু আগে থেকেই একজন বাচ্চার মাঝে আসক্তিমূলক আচরণ তা থেকে আসক্তিমূলক ব্যাক্তিত্ব গড়ে ওঠে।
পরিবারে কোন সন্তান অতিগুরুত্ব পাওয়া এবং একদম গুরুত্বহীন হয়ে পড়া - দুই ক্ষেত্রেই এসব ঘটনা ঘটেছে। নিজেদের অজান্তে বা জানাশোনার মধ্যে একজন মা কেন সন্তানকে অতি গুরুত্ব দেন বা তার ইতরামি-বদমায়েশিকে নিরব এপ্রুভাল দেন তা কেস বাই কেস এনালাইসিস করে, ডাটা সংগ্রহ করার মাধ্যমে আলাদা সাইকোলজিক্যাল গবেষণা হলে হয়তো কোন কমন পয়েন্ট বের হবে। তবে আমি ৬/৭ টা ঘটনা জানি - আহ্লাদপূর্ন প্রশ্রয়, লোকজনের সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ন আচরন, বেয়াদবি এবং বাঁদরামির সামাজিক এপ্রুভাল মা'ই দেন এবং দিয়ে যাচ্ছেন।
এটাও সত্য মায়েরা সন্তানদের বহু কিছু লুকায়, তারা এগুলা নিয়ে অস্বস্তিতে থাকেন, কি করবেন বুঝে উঠতে না পেরে অসহায় সময় পার করেন। যা হোক আমি সংক্ষেপে ইয়াবা আর আইস নিয়ে কয়েকটা কথা বলি -
---------------------------------
ইয়াবা: সাধারণত ছোট লাল/গোলাপি ট্যাবলেট। এর রাসায়নিক উপাদান হলো মেথামফেটামিন (methamphetamine) হাইড্রোক্লোরাইড+ক্যাফেইন। এটা শুরুতে শক্তি বাড়ায়, ঘুম কমিয়ে দেয়, ও মস্তিষ্ককে বিভিন্ন কাজের ঝুঁকি সম্পর্কে ডার্ক রাখে, বুঝতে দেয়না।
আইস / ক্রিস্টাল মেথ: এটা মেথামফেটামাইনই। তবে ক্রিস্টাল ফর্মে থাকে। স্ফটিক বা কাঁচের মত দেখতে। নরমাল ইয়াবার মেথামফেটামাইন এর পিউরিটি ৩০/৩৫%। কিন্তু আইসের ক্ষেত্রে ৮০–৯৫%+। প্রভাব খুব দ্রুত ও ভয়ংকর।
দুইটার মূল কেমিকেল একই। মেথঅ্যামফেটামিন। এটা আমাদের শরীর-মনকে খুব দ্রুত ‘হাইজ্যাক’ করে ফেলে।
এই ড্রাগের কারনে আমাদের মস্তিষ্কের ‘হরমোন সার্কিট’ (নিউরোট্রান্সমিটার)-এ কী হয়
---------------------------------
মেথ বা ইয়াবা বা আইস তিনটি বড় হরমোন সিস্টেমকে আঘাত করে -
(১) ডোপামিন (Dopamine)। ডোপামিনের কাজ হলো আমাদের শরীরে মনে আনন্দের অনুভূতি তৈরি করা, রেওয়ার্ড সিস্টেম চালানো অর্থাৎ কোন কাজ করলে তার বিনিময়ে আমরা ভাল কিছু পাই, অর্জন করি বা করলে এই হরমোন আনন্দের অনুভূতি তৈরি করে। মোটকথা পুরস্কার ব্যবস্থা। আমাদের মোটিভেশন ধরে রাখা, নতুন বিষয় শিখতে সাহায্য করা।
মেথের প্রভাব: একবারেই অস্বাভাবিক মাত্রায় মস্তিষ্কে “ডোপামিন সুনামি” ঘটায়। মস্তিষ্ক তখন ভাবে এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার। ফলে স্বাভাবিক আনন্দ (পরিবার, পড়াশোনা, কাজ) বেহাল/নিষ্প্রভ লাগে। পর্দা–গেম–ড্রাগ ছাড়া কিছুতেই আর মজা লাগে না। লালসা বাড়ে→টলারেন্স কমে→ডিপ্রেশন বাড়ে। একটা আরেকটার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
(২) সেরোটোনিন (Serotonin)। এর কাজ হলো মুড ঠিক রাখা, শান্তি-শান্তি কুল-কুল একটা ফিলিংএ থাকা, ঘুম, উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ করা।
মেথ বা ইয়াবা বা আইসের প্রভাবে এই সেরোটোনিন সার্কিট খুব দ্রুত ক্ষয় হয়, ডিসরেগুলেশন হয়। উদ্বেগ বাড়ে, খিটখিটে মেজাজ হয়, প্যানিক এটাক আসে, ঘুম ভেঙ্গে যায়, সন্দেহবাতিক হয়, আত্মহত্যাচিন্তা বাড়ে; দীর্ঘমেয়াদে ইমোশনালি ফাঁপা হয়ে যায়।
(৩) অক্সিটোসিন (Oxytocin)। এর কাজ হলো সহমর্মিতা, সম্পর্কের উষ্ণতা, ‘বন্ডিং’ তৈরি করা। অনেকে একে লাভ (Love) হরমোন বলেন।
মেথের প্রভাব: সম্পর্কের আনন্দ-আস্থার অনুভূতিগুলো খুব বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমপ্যাথি/সিমপ্যাথি সহানুভূতি, ভালবাসা, সহমর্মিতা নিভে গিয়ে মানুষটা হৃদয়হীন ঠান্ডা, স্বার্থপর, রূক্ষ ও বদমেজাজী হয়ে ওঠে।
এর সঙ্গে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে (prefrontal cortex) কিছু পরিবর্তনের কারনে বিবেক, বিচার, বিবেচনাহীন হয়ে উঠে। এই ড্রাগ আসক্তদের নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হয়ে যায়, যত্রতত্র ক্ষমতা প্রদর্শন করা একটা সাধারন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা (amygdala) ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আমাদের ভয় পাওয়া, রাগ উঠার সিস্টেমগুলো অতিসক্রিয় হয়ে যায়। প্যারানয়েড হয়ে থাকে সবসময়। এখান থেকেই এই ড্রাগ গ্রহীতারা হয় প্রচন্ড আক্রমণাত্মক, হিংস্র। এবং কাউকে বা কিছুকেই কেয়ার করেনা।
স্বল্পমেয়াদি–দীর্ঘমেয়াদি শারিরীক ও মানসিক লক্ষণ যা দেখে বুঝবেন আপনার সন্তান ড্রাগে আছে কিনা -
------------------------------------------------------------------
তৎক্ষণাৎ বা স্বল্পমেয়াদি লক্ষনগুলো - ঘুম না আসা, ক্ষুধা ভীষন কমে যাওয়া, দ্রুত কথা বলা, চোখ বড় বড় করে তাকানো, বুক ধড়ফড় করা, সবকিছুতে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, কোন কিছুর ঝুঁকি না বোঝা। পরে প্রায় সব কাজে আক্ষরিক অর্থেই “ক্র্যাশ” খাওয়া, তীব্র ক্লান্তি আসা, দুঃখ পাওয়া, খালি-খালি লাগা, প্রচন্ড উত্তেজনা ও সন্দেহবাতিক হয়ে উঠা।
দীর্ঘমেয়াদি লক্ষন: এমপ্যাথি, ভালবাসা-সহানুভূতি-সহমর্মিতা চলে যাওয়া, পরিবার থেকে দূরত্ব তৈরি হওয়া, হিংস্রতা, আইনি ঝামেলা তৈরি করা। সাইকোসিস (শব্দ/দৃশ্য ভ্রম) হয়, স্মৃতি কমে যায়, কাজে মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। ফোকাস করতে পারেনা আর, রেজাল্ট ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে থাকে। হার্টে ইস্যু তৈরি হয়, রক্তচাপ বাড়ে, দাঁত–ত্বক নষ্ট হয়, সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হয়। সর্বপরি কাজ,পড়া, সম্পর্ক ধ্বংস হয়ে পুরা ব্যক্তিত্বই বদলে যায়।
কেন তরুণরা সবচেয়ে বিপদে
---------------------------------
১৫–২৫ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষের মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা (প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স) নির্মান হতেই থাকে।
এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। মেথ নির্মানের এই প্রক্রিয়া ও ‘ওয়্যারিংকে (wiring) ভুলপথে পরিচালনা করে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করে দেয়। অনেকে ভাবেন সামান্য একটু ট্রাই দেই। এই “একটু ট্রাই”ও বড় ধরনের ট্রিগার হতে পারে।
কি করলে বাঁচানো যাবে তার একটা ব্যবহারিক রূপরেখা -
------------------------------------------------------------------
(১) পরিবারে আগেভাগে কথাবার্তা, ও আলোচনা করা। কোন ভয় দেখানো নয়, বরং তথ্যভিত্তিক গল্প, মস্তিষ্কের ছবি/চিত্রকল্পে বোঝানো যে ড্রাগের কারনে মস্তিস্কে ‘ডোপামিন সুনামি’ হলে স্বাভাবিক আনন্দ মরে যায়।
ইয়াবা বা আইসে আসক্তদের কমন কিছু আচরন - ঘুম উধাও, হঠাৎ রেগে যাওয়া, প্রায়সই টাকা হারানো, আননেসেসারি গোপনীয়তা, নিত্য নতুন গ্রুপ বানানো, পরীক্ষায় খারাপ করা।
(২) স্কুল/কলেজে স্কিল-ট্রেনিং দিতে হবে। কথায় কথায় "না" বলা যাবেনা। ড্রাগ-রিফিউজাল স্ক্রিপ্ট অনুশীলন করানো, মেডিটেশান, স্ট্রেস-ম্যানেজমেন্ট, পরীক্ষার চাপ সামলানো কৌশল শিখিয়ে দেয়া, ঘুম-পুষ্টি সম্পর্কে ব্যবহারিক কাজ শিক্ষাতে জড়িত করা। অনেক জায়গায় পিয়ার-লিড ক্লাব থাকে। এসব জায়গায় “ব্রেইন-হেলথ অ্যান্ড পারপাস” সেশনে অংশ নেয়া, খেলাধুলা, মেকার-ল্যাব, মিউজিক, আর্ট ওয়ার্কে যুক্ত থাকা
(৩) অনলাইন–অফলাইন নজরদারি ও বিকল্প আনন্দের ব্যবস্থা করা। একটা ডোপামিন-স্মার্ট রুটিন করে দেয়া। এমনভাবে টাইম প্ল্যান বানাতে হবে যেন: ঘুম ৭–৯ ঘন্টা, নিয়মিত খাবার, ব্যায়াম, পরিবেশ-প্রকৃতি, মেন্টাল এক্সারসাইজ, স্ক্রিন-ডিটক্স এ বিষয়গুলো থাকে। এছাড়া মিশন বা পারপাস-বেইজড কাজে যুক্ত করে দিতে হবে। যেমন - ভলান্টিয়ারিং, উদ্যোক্তা-প্রজেক্ট। এগুলাতে আগের স্বাভাবিক ডোপামিন রিওয়ার্ড সিস্টেম ফিরে আসে।
(৪) সন্দেহ হলে দ্রুত এক্সপার্ট ডাক্তার বা সাইকোলজিস্ট দেখাতে হবে। নন-শেমিং কথোপকথন চালাতে হবে যেমন - “তোমার সাথে খারাপ কিছু ঘটছে, আমরা তোমার সাথে আছি সবসময়।" অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধে যাবেন না।
এক্ষেত্রে রিহ্যাবিলিটেশন সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা আমাদের দেশে বহু রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার রয়েছে
দেখে শুনে ভালো একটা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা চিকিৎসা পরবর্তীতে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারের কাউন্সিলর এর পরামর্শ অনুযায়ী বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়া।
(৫) কমিউনিটি-অ্যাকশন - মসজিদ–মন্দির–স্কুল–ক্লাব, বিভিন্ন গ্রুপে মাসিক সচেতনতামূলক টক দেওয়ান সন্তানকে। তাকে কথা বলান। রোল-মডেলদের গল্প জানুক ও বলুক। স্পোর্টস/কালচারাল লীগে যুক্ত থাকুক, নাইট-টাইমে নিরাপদ আড্ডা-স্পেস তৈরি করুক। আপনারাও হেল্প করবেন। এই সময়গুলোতে ড্রাগের সরবরাহ কমাতে আইন প্রয়োগ + পুনর্বাসন দুইটাই ব্যবহার করতে হবে।
(৬) রিকভারি-পথ অনেক লম্বা, কিন্তু সম্ভব। সম্পূর্ণ বিরতি + ঘুম, পুষ্টি + থেরাপি লাগাতার চলবে। প্রথম ৩–৬ মাসে মুড ওঠানামা করবে হাই ফ্রিকোয়েন্সীতে। ৬–১২ মাসে ধীরে ধীরে তার মধ্যে সহানুভূতি, আনন্দের অনুভূতি গুলো ফিরে আসবে। তাকে সুনির্দিষ্ট একজন বিশ্বস্ত লিডার বা গুরুজন দিতে হবে। যাকে সে মানবে, বিশ্বাস করবে। পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ একজন হতে পারেন।
শুধু পরিবারের নির্দিষ্ট সন্তানটি নয়। সবার জন্য আজই ঠিক করি যে - ঘুম, ব্যায়াম, প্রকৃতি-পরিবেশ, ভালো সঙ্গ, ভাল কাজ এগুলা ম্যান্ডেটরি। আর সমস্যায় পড়লে সাহায্য চাই, সাহায্য চাইতে যেন কেউ দেরী না করে, সংকোচ না আসে। আমরা একা নয়, সবাই একসাথে জিতব।
ড্রাগ নয়, জীবন জিতুক।
একটা কথা কিন্ত মাথায় রাখা হবে মাদকাসক্তি একটি পুনপতনমূখী রোগ।
একবার আসক্ত হয়ে পড়লে চিকিৎসা পরবর্তীতে মাদক ছাড়া জীবন পরিচালনা অত্যন্ত ধৈর্যপূর্ণ কাজ।
মাদকাসক্তি চিকিৎসায় অত্যন্ত ধৈর্যের
পরিচয় দিতে হয়
৩/৬/৯ মাস এরকম চিকিৎসা পদ্ধতি আমাদের দেশে চালু থাকলেও
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে মাদকের ক্ষতি সামলে উঠে ব্রেনের কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে ৩ বছর সময় লাগে।
ততদিন পর্যন্ত চিকিৎসক কাউন্সিলর অধিনে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ।
সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার মনে রাখা দরকার
একজন মাদকাসক্ত ব্যাক্তি চিকিৎসার পরে ২০ বছর সুস্থ থাকার পড়েও যদি একবার মাদক গ্রহন করে তার
মস্তিষ্কের কন্ডিশন আবার ২০ বছর আগের মাদকাসক্ত পর্যায়ে ফিরে যায়।
সুতরাং চিকিৎসা পরবর্তীতে মৃত্যু পর্যন্ত যেকোন মাদক থেকে দূরে থাকতে হবে।