07/02/2024
🔴 চুল পড়া / Hair fall
🔰চুল ত্বকেরই একটি বিশেষ অংশ। মাথার চুল ঝরে দিন দিন টাক পড়ে যাচ্ছে বা চুল পাতলা হয়ে যাচ্ছে, এমন লোকের সংখ্যা অনেক। আজকাল কিশোর-কিশোরীদের একটি অতি সাধারণ সমস্যা হচ্ছে অতিরিক্ত চুল পড়া। এটা কিশোরদের কাছে তো বটেই, কিশোরীদের কাছে বেশ উদ্বেগের কারণ হতে পারে। এখন বয়স ৩০ বছর পেরোনোর আগেই চুল পড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অন্তত ৩০ শতাংশ মানুষ এই সমস্যায় ভোগেন। ৩০ বছর বয়সের পর এই হার দাঁড়ায় ৫০ শতাংশে। প্রতিদিন ১০০টির বেশি চুল পড়লে মাথা ফাঁকা হতে শুরু করে। বিশেষজ্ঞরা এর বিভিন্ন কারণের কথা বলে থাকেন।
🔷কীভাবে বুঝবেন চুল পড়ায় অস্বাভাবিকতা আছে?
চুল পড়ায় কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কি না, তা কীভাবে বুঝবেন, সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ড. সুসান ম্যাসিক বলেন, ‘মাথায় হাত দিলে যদি অস্বাভাবিক পরিমাণ চুল উঠে আসে এবং মাথার ত্বক যদি বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগে, তাহলে বুঝবেন, আপনার চুল পড়ার হার স্বাভাবিক নয়।’
🔷দৈনিক কী পরিমাণ চুল পড়া স্বাভাবিক?
চুল পড়া বেশির ভাগ মানুষের জন্যই স্বাভাবিক। এতে চিন্তিত হওয়ার তেমন কিছু নেই। মার্কিন বিশেষজ্ঞ গ্রেচেন ফ্রিজ বলেন, ‘প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৫০টি চুল পড়ে। কারও কারও বেলায় এই সংখ্যা একটু কমবেশিও হয়। প্রতিদিন চুল কী পরিমাণ পড়বে, তা নির্ভর করে আপনি চুলের বিকাশের কোন পর্যায়ে আছেন, তার ওপর।’
প্রতিদিন ৬০ থেকে ১০০টি চুল পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু এর বেশি পড়তে শুরু করলেই শুরু হয় টেনশন। চুল পড়ার সমস্যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। বংশগত , শারীরিক সমস্যা কিংবা আমাদের কিছু ভুলের কারণে পড়তে পারে চুল।
🔻কারণ
🔹চুল পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে মানসিক অশান্তি, দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা, অপুষ্টি, অবৈজ্ঞানিক উপায়ে ডায়েট ইত্যাদি।
🔹জ্বর, লিভার ও কিডনির অসুখ, কেমোথেরাপি নেওয়ার পরের রক্তস্বল্পতা, কিছু ওষুধ (যেমন ইনডোমেথাসিন, জেন্টামাইসিন ইত্যাদি) এর কারণে চুল অতিমাত্রায় পড়ে যেতে পারে।
🔹খুশকি, উকুন, শুষ্কতা ও চটচটে মাথার ত্বকও চুলের শত্রু।
🔹তরুণ প্রজন্মের খাদ্যাভ্যাস ও ঘুমের অনিয়ম চুল পড়ার কারণ হিসেবে গণ্য হয়।
🔹পড়াশোনা, অতিরিক্ত কাজের চাপ সহ বিভিন্ন কারণে অনেকে মানসিক চাপে ও অশান্তিতে থাকে। মানসিক চাপ বেশি থাকলে চুল পড়ার সমস্যা বেড়ে যেতে পারে।
🔹সকালে নাশতা না করা, অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড খাওয়ার অভ্যাস, সবজি ও ফলমূল এড়িয়ে চলা ইত্যাদি কারণে অপুষ্টি তৈরি হয় শরীরে। রক্তশূন্যতা, পুষ্টিহীনতার কারণেও চুল পড়ে।
🔹থাইরয়েডের সমস্যা বা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়ও চুল পড়ে। শরীরে হরমোনের পরিমাণ কমবেশি হলে চুল পড়বে।
🔹যাদের চুল লম্বা তারা ঘুমানোর আগে চুল বেঁধে না ঘুমালে আগা ফেটে ভাঙতে শুরু করে।
🔹আমারা অনেকেই ভেজা চুল আঁচড়াই। চুল যখন ভেজা থাকে তখন চুলের গোড়া নরম থাকে। ওই অবস্থায় আঁচড়ালেও চুল পড়বে।
🔹অতিরিক্ত ভিটামিন 'A' গ্রহণও এর জন্য দায়ী।
🔹নারীদের ক্ষেত্রে মেনোপজের পর অ্যান্ড্রোজেনিক হরমোন বেড়ে গিয়েও চুল পড়া শুরু হয়। পুরুষদের মাথায় টাক পড়ার কারণও হরমোনের আধিক্য।
🔹স্কাল্পে ছত্রাকের সংক্রমণে চুল পড়ে। দীর্ঘ সময় স্যাঁতসেঁতে চুল ঢেকে রাখার ফলে এই ছত্রাকের সংক্রমণ হতে পারে। মাথায় চুলকানো বা মাথার ত্বক লাল হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখলে বুঝতে হবে ছত্রাকের সংক্রমণ হয়েছে।
🔹বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, প্রোটিন, আয়রনের অভাবে চুল পড়তে পারে।
🔹জন্ডিস, টাইফয়েড, জ্বর বা অন্যান্য তীব্র জ্বরের পরও অনেকের চুল পড়ে। করোনা থেকে সেরে ওঠার পরও দেখা গেছে অনেকের চুল পড়ে যাচ্ছে।
🔹চুলের সৌন্দর্য বাড়াতে গিয়ে অতিরিক্ত ব্লিচিং ও ডাই চুলের ক্ষতি করে।
🔹চুল স্ট্রেট করার কারণে চুলের ক্ষতি হতে পারে। এর ফলে চুল ভেঙে যায় বা পড়ে যায়। আয়রন বা গরম ব্লো-ড্রাইং থেকে অতিরিক্ত তাপ দেওয়ার ফলেও চুলের ক্ষতি হয়।
🔹অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, ধূমপান ও ওজন কমানোর জন্য অতিরিক্ত ডায়েটও চুল পড়ার বড় কারণ।
এ ছাড়া জিনগত কারণে চুল পড়তে পারে। বংশের কারও চুল পড়ে যাওয়ার সমস্যা থাকলে উত্তরাধিকার সূত্রে টাক মাথা পেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে মাথার পাশের চুলগুলো না পড়লেও মাঝের চুল পড়ে যেতে থাকে। আবার অনেক সময় এই বংশপরম্পরা আপনাকে দিয়েই শুরু হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ওষুধের মাধ্যমে চুল ধরে রাখা যায়।
চুল পড়ার আরেকটি ধরন হলো ‘অ্যালোপেশিয়া এরিয়েটা’। এ ক্ষেত্রে মাথার এক বা একাধিক জায়গায় ১ থেকে ৫ সেন্টিমিটার এলাকার চুল একসঙ্গে খালি হয়ে যেতে থাকে। যেকোনো বয়সের নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাই এই রোগের শিকার হতে পারেন। এমনকি এটি শিশুদেরও হতে পারে। প্রতি পাঁচজন অ্যালোপেশিয়া রোগীর মধ্যে একজনের পরিবারের অন্য সদস্যের এই সমস্যা আছে। বিভিন্ন কারণে এই রোগ হতে পারে।
🔷প্রতিকার
চুল পড়া বা টাক হয়ে যাওয়াটা বংশগত হয়ে থাকলে কিছু করার থাকে না। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে হয়ত রক্ত পরীক্ষা করতে হতে পারে। আবার ভিটামিন এ-এর পরিমাণ, আয়রন, থাইরয়েড এসব পরীক্ষাও করা হয়। এর বাইরে যেসব করতে হবে-
🔹চিন্তামুক্ত থাকা।
🔹নিয়মিত সময় নিয়ে চুল আঁচড়ানো। প্রতিদিন অন্তত পাঁচ-দশ মিনিট চুল ভালোভাবে আঁচড়ানো দরকার। এতে চুলের গোড়ায় রক্ত চলাচল বাড়ে। চুলের স্বাস্থ্যও ঠিক থাকে।
🔹সপ্তাহে দুই-তিনবার শ্যাম্পু করা। শ্যাম্পু ব্যবহারের আগে চুলে তেল মেখে রাখা ভালো।
🔹ভেজা চুল না আঁচড়ানো।
🔹ব্লিচিং বা ডাই বেশি না করা।
🔹চুলের আগা ফেটে গেলে ছেঁটে ফেলা।
🔹স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, ডায়েট করার আগে একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া।
🔹চুলে যেকোনো ধরনের রাসায়নিক ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। শ্যাম্পু ও হেয়ার জেল ব্যবহার করলে তা সঠিকভাবে ধুয়ে ফেলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো দীর্ঘ সময় মাথায় থাকলে তা ত্বকের ছিদ্রগুলো আটকে দিতে পারে, যা মাথার ত্বকে অক্সিজেন সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।
🔹চুলের জন্য পর্যাপ্ত প্রোটিন, ভিটামিন (এ, বি, বিশেষ করে বায়োটিন, সি, ডি ও ই) এবং বেশকিছু খনিজ (আয়রন, জিঙ্ক) নিয়মিত গ্রহণ করা অপরিহার্য। এসব উপাদান সমৃদ্ধ খাবার হচ্ছে ডিমের কুসুম, কলিজা, বাদাম, বীজ, কলা, মিষ্টি আলু, মাশরুম, ব্রকলি ইত্যাদি।
🔹পেঁয়াজের রস মেখে ৩০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলতে পারি। এতে মাথার ত্বকে ছত্রাক সংক্রমণ কমবে।
🔹মেহেদি পাতা বেটে মাথায় লাগানো যেতে পারে। এতেও চুলের গোড়া মজবুত হয়।
🔹অ্যালোভেরাও চুলের জন্য বেশ কার্যকর। অ্যালোভেরার জেল মেখে ১৫-২০ মিনিট পরে ধুয়ে ফেলতে হবে।
🔹মসুর ডাল বেটে মাথায় লাগালেও মাথার ত্বক ভালো থাকে।
🔹মেহেদি বাটা, পেঁয়াজের রস, নিমপাতা বাটা, লেবুর রস, টকদই একসঙ্গে মিশিয়ে ৩০-৪০ মিনিট পর ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এতে খুশকি দূর হয়।
🩺চিকিৎসা
চুল পড়া রোধে এর পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। আর চুলের পুষ্টি আসে হেয়ার বালবের শিরা-উপশিরা থেকে। তাই চুলের পুষ্টি সঞ্চালন করতে হলে হেয়ার ফলিকলের নিচে, ত্বকের গভীরে হেয়ার বালবে রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে হবে।
💠 চুলপড়া সমস্যা সমাধানের জন্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা এক নির্ভরযোগ্য সমাধান।এ চিকিৎসা করতে বেশ কয়েকটি সেশন ও সময় লাগে।অ্যান্ড্রোজেনিক অ্যালোপেশিয়া বা বংশগত টাকের জন্য এটি একটি কার্যকরী চিকিৎসা। চুলের চিকিৎসা দীর্ঘ মেয়াদে নিতে হয়। তাই ধৈর্য প্রয়োজন এবং লাইফস্টাইল ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন কাম্য।