21/11/2024
তেল খাওয়া কি স্বাস্থ্যকর? কোন তেল বেশি খারাপ? সরিষার তেল ভালো নাকি সয়াবিন তেল নাকি এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ ওয়েল? মাছের তেল ভালো নাকি মাংসের তেল? ইত্যাদি প্রশ্ন প্রায় সবার মনেই কমবেশি ঘুরপাক খায়। সোশাল মিডিয়া সহ নানা গণমাধ্যমে এগুলো নিয়ে আলোচনা চলে। অনেকে নিজের ইচ্ছামত অবৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়ে নিজের বিশ্বাসকে প্রচার করে, কেউ কেউ ব্যবসায়িক স্বার্থেও কাজটি করে থাকেন। চলুন জেনে নেই প্রমাণনির্ভর বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা থেকে আমরা খবার তেল সম্পর্কে আমরা কি কি জানি।
প্রথমত, তেল একটি পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান যা মানুষের তিনটি প্রধান ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট অর্থাৎ শক্তি প্রদানকারী খাদ্য উপাদানের একটি। এছাড়া তেল শরীরের কিছু হরমোন তৈরি, অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিড ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ যোগান দেয়া এবং ফ্যাট সলিউবল ভিটামিন এ, ডি এবং কে শরীরে শোষিত হতে সাহায্য করে। কিন্তু কি তেল কিভাবে বানানো হচ্ছে এবং কিভাবে খাওয়া হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে আদৌ তা স্বাস্থ্যকর কিনা।
রাসায়নিক গঠন অনুসারে ভোজ্য তেলে চার ধরনের ফ্যাট থাকতে পারে। মনো আনস্যাচুরেটেড ও পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট যা স্বাভাবিক রুম তাপমাত্রায় তরল থাকে এবং ভোজ্য তেল, মাছের তেল, বাদাম তেল ইত্যাদিতে পাওয়া যায়। স্যাচুরেটেড ফ্যাট যাতে হাইড্রোজেন বন্ড বেশি থাকে, স্বাভাবিক রুম তাপমাত্রায় জমে যায় এবং নারকেল তেল, পাম ওয়েল, ঘি, ক্রিম, বাটার, প্রানীজ চর্বি ইত্যাদিতে পাওয়া যায়। চতুর্থ ধরনটি হলো ট্রান্স ফ্যাট যা তৈরি হয় আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটে আংশিকভাবে হাইড্রোজেন বন্ড তৈরির মাধ্যমে (যেমন ডালডা) এবং তৈরি হয় উচ্চ চাপ তাপে ভোজ্য তেল প্রসেসিং এর সময়, প্রসেসড ফুডে এবং রান্নার সময়।
এইসকল তেল খাবারের মাধ্যমে আমাদের দেহে প্রবেশ করার পর মূলত দু ধরনের চর্বিকনায় পরিনত হ্য়, কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড। দুটোই শরীরের বিভিন্ন কাজে প্রয়োজনীয়। কিন্তু এরা একা একা রক্তের মাঝে ঘুরে বেড়াতে পারে না। রক্তে চলাচলের জন্য এরা অন্য প্রোটিনের উপরে ভর করে কিছু লাইপোপ্রোটিন তৈরি করে। এর মাঝে আছে এলডিএল বা লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন, এরা লিভার থেকে চর্বিকণা হার্ট সহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে নিয়ে যায়। আর আছে এইচডিএল বা হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন যা শরীরের অন্যান্য অঙ্গ থেকে অতিরিক্ত চর্বিকণা লিভারে নিয়ে আসে জমিয়ে রাখা বা ভেঙ্গে ফেলার জন্য। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, রক্তে এলডিএলএর মাত্রা বেড়ে গেলে এবং এইচডিএল এর মাত্রা কমে গেলে বেশি বেশি চর্বিকণা রক্তনালী, হৃদপিন্ড সহ অন্যান্য অঙ্গে জমা হয়ে হার্ট এট্যাক, স্ট্রোক সহ নানা রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যায় স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাট দুটোই মোট কোলেস্টেরল এর পরিমান বাড়ায় এবং ক্ষতিকর এলডিএল এর পরিমান বাড়ায়। যদিও স্যচুরেটেড ফ্যাট থেকে সরাসরি ক্ষতির বিষয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা কিছুটা দ্বিমত পোষন করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড এভিডেন্স হিসেবে প্রচলিত কক্রেন রিভিউ এর ২০২০ সালের এনালাইসিস এ বলা হয় , খাবারে স্যাচুরেটেড ফ্যাট অন্তত ২ বছর পর্যন্ত কমিয়ে দিলে হৃদরোগের ঝুকির পরিমান ১৭% কমে। অন্যদিকে ২০১৭ সালের একটি বড় গবেষণা থেকে জানা যায়, খাবারে মোট ফ্যাট ও স্যাচুরেটের ফ্যাটের সাথে হৃদরোগ ও মৃত্যুঝুকি বৃদ্ধির সম্পর্ক নেই বরং উচ্চমাত্রায় শর্করা গ্রহনের সাথে মৃত্যুঝুকির সম্পর্ক বেশি।
স্যাচুরেটেড ফ্যাট নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ট্রান্সফ্যাট নিয়ে বিতর্ক নেই। ট্রান্সফ্যাট ক্ষতিকর এলডিএল এর পরিমান বাড়ানো এবং উপকারী এইচডিএল এর পরিমান কমানো ছাড়াও শরীরে নানা ধরনের প্রদাহ বাড়ায় যা হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও স্ট্রোক এর ঝুকি বৃদ্ধি করতে পারে। গবেষণায় জানা যায় খাবারে ট্রান্স ফ্যাট এর পরিমান প্রতি ২% বৃদ্ধিতে মৃত্যুঝুকি বাড়ে ২৩%। এ কারনেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাবারে ট্রান্সফ্যাটের পরিমান ২% এর কম রাখার এবং দিনে মোট ক্যালোরির ১% এর কম ট্রান্স ফ্যাট রাখার (২০০০ ক্যালরি খাবার গ্রহন করলে দিনে সর্বোচ্চ ২.২গ্রাম পর্যন্ত) নির্দেশনা দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালে সব ধরনের ভোজ্য তেল, চর্বি ও খাবারে ২% এর বেশি ট্রান্সফ্যাট ব্যবহার না করার নির্দেশনা জারি করলেও সেটা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
সম্প্রতী বাংলাদেশের একদল গবেষক এদেশের বিভিন্ন ভোজ্য তেলে ট্রান্সফ্যাটের পরিমান সম্পর্কিত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক জার্নালে। গবেষকগন বাংলাদেশে প্রচলিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডেড ও নন ব্র্যান্ডেড সয়াবিন তেল ও পাম ওয়েল নমুনা সংগ্রহ করে ট্রান্সফ্যাট এর পরিমান নির্ণয় করে দেখেছেন প্রায় ৬৭% ব্রান্ডেড সয়াবিল তেলে এবং ২৫% নন ব্র্যান্ডেড সয়াবিল তেলে ২% এর বেশি ট্রান্সফ্যাট আছে। ব্র্যান্ডেড সয়াবিন তেলে গড়ে প্রায় ২.৮% ট্রান্স ফ্যাট পাওয়া গেছে। অন্যদিকে পাম ওয়েলের কোন নমুনায় ২% এর বেশি ট্রান্সফ্যাট পাওয়া যায় নি। স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমান সয়াবিন তেলে পাওয়া গেছে গড়ে ২১% এবং পাম ওয়েলে গড়ে ৪১%। ব্র্যান্ডেড তেল এর তুলনায় নন ব্র্যান্ডেড তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি ছিলো। পূর্ববর্তী গবেষণায় জানা যায় বাংলাদেশে মানুষ দিনে গড়ে ২৭ গ্রাম ভোজ্য তেল খান (প্রায় ৬ চামুচ)। খাবার তেলের মূল উৎস ব্র্যান্ডেড সয়াবিন তেল ধরা হলে ২৭ গ্রাম তেলে গড়ে ২.৮% ট্রান্সফ্যাট হিসেবে দৈনিক গ্রহনকৃত ট্রান্সফ্যাট এর পরিমান ০.৭৬ গ্রাম। উচ্চ তাপে রান্নার সময় (ফ্রাই) ভোজ্য তেলে ট্রান্সফ্যাট এর পরিমান বাড়ে প্রায় ৩.৬% সেটুকু হিসেবে নিলে মোট ট্রান্সফ্যাটের পরিমান দাড়ায় ১.৭৩ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট শুধুমাত্র ভোজ্য তেল থেকেই আসছে। এর বাইরে কেউ যদি বানিজ্যিকভাবে তৈরি প্রসেসড ফুড খায় যেমন কেক, বিস্কিট, চকলেট, চিপ্স, অন্যান্য বেকারি আইটেম, ফ্রাইড খাবার সেক্ষেত্রে ট্রান্সফ্যাট এর পরিমান আরও বেশি হবে কেননা এসব খাবার প্রস্তুতের সময় উচ্চ ট্রান্সফ্যাটযুক্ত হাইড্রোজেনেটেড ওয়েল ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। ১০০ গ্রামের একটি কেকে প্রায় ১.৩ গ্রাম, ১০০ গ্রাম বিস্কুটে ১-৫ গ্রাম, ১০০ গ্রাম চিজ কেকে ০.৫-২ গ্রাম পর্যন্ত ট্রানফ্যাট থাকতে পারে। এছাড়াও প্রতি ১০০ গ্রাম গরুর মাংসে প্রাকৃতিক ভাবেই ১-২গ্রাম ট্রান্সফ্যাট থাকতে পারে। সে হিসেবে একজন মানুষ যদি দিনে ২৭ গ্রাম ভোজ্য তেল খাবার পাশাপাশি একবেলা গরুর মাংশ খান, আর ডেজার্ট হিসেবে ১০০ গ্রাম কেক খান তাহলে তার দিনে মোট গ্রহনকৃত ট্রান্সফ্যাট এর পরিমান হবে প্রায় ৫ গ্রাম যা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সর্বোচ্চ মাত্রার দ্বিগুণেরও বেশি।
গবেষকগণ শুধুমাত্র সয়াবিন ও পাম ওয়েলের তুলনা করেছেন এই দুটো তেলের বাইরেও দেশে ভোজ্য তেল হিসেবে সূর্যমুখী, সরিষা, রাইস ব্র্যান ও অলিভ ওয়েলের প্রচলন আছে। বাণিজ্যিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে সাধারনত হট প্রেস পদ্ধতিতে তেল নিষ্কাশন করা হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় উচ্চচাপ উচ্চতাপের কারনে এবং অন্যান্য আনুসাঙ্গিক প্রসেসিং প্রক্রিয়ায় তেলে ট্রান্সফ্যাটের পরিমান বাড়ে। সেদিক থেকে কোল্ড প্রেস পদ্ধতি কিছুটা নিরাপদ। কোল্ড প্রেস এবং কম প্রসেসিং প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়া তেলগুলোকে সাধারন ভার্জিন/এক্সট্রাভার্জিন ইত্যাদি শিরোনামে বিক্রি করা হয়। বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে খাবারে সরিষার তেলের ব্যবহার প্রচলিত। সরিষার তেলে ট্রান্সফ্যাটের পরিমান নিয়ে তুলনামূলক গবেষণা পাওয়া যায়নি তবে ভারতীয় একটি গবেষণায় দেখা গেছে অপরিশোধিত প্রতি ১০০ গ্রাম সরিষা তেলে গড়ে ০.২-১ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট থাকতে পারে। প্রসেসড ওয়েল এর ক্ষেত্রে এই পরিমানটি আরও বেশি। যদিও সরিষার তেলে ট্রান্সফ্যাটের পরিমান তুলনামূলক ভাবে কম, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া সহ বহু অঞ্চলে সরিষার তেল ভোজ্য তেল হিসেবে নিষিদ্ধ। সরিষার তেলে উচ্চমাত্রায় ইরুসিক এসিড পাওয়া যায় যা হৃদপিন্ডের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ইদুরের উপরে গবেষণায় প্রমানিত হয়েছে ইরুসিক এসিড হার্টের ক্ষতি করে। সরাসরি মানবদেহে ইথিক্যাল কারনে এই গবেষণা হয়নি তবে ভারতীয় একটি গবেষণায় দেখা গেছে সরিষার তেল গ্রহনকারীদের মাঝে হৃদরোগের প্রকোপ অন্যদের তুলনায় প্রায় ৫০% বেশি। ভিন্ন একটি গবেষণায় আবার দেখা গেছে সূর্যমুখী তেল এর তুলনায় সরিষার তেল ব্যবহারকারিদের হৃদরোগের প্রকোপ ৭১% কম। বিভিন্ন ধরনের বিপরীতমুখী ফলাফল থাকায় সরিষার তেলের স্বাস্থ্যঝুকি সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না। তবে নিয়মিত সরিষার তেল খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য সম্ভাব্য ক্ষতিকর হতে পারে।
অন্যান্য দেশের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে সূর্যমুখী তেলে ১.২৫-৩.৬২% ট্রান্সফ্যাট, রাইস ব্র্যান ওয়েলে ০.২-০.৫% ট্রান্সফ্যাট রয়েছে। অলিভ ওয়েলে সাধানরত ট্রান্সফ্যাট থাকে না তবে উচ্চতাপমাত্রায় অলিভ ওয়েলে ০.৬% ট্রান্সফ্যাট তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশের কিছু কিছু অঞ্চলে আরেকটি প্রচলিত ভোজ্য তেল হলো নারকেল তেল। সম্প্রতী কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ভোজ্যতেল হিসেবে নারকেল তেল কে স্বাস্থ্যকর বলে প্রচার করছেন। নারকেল তেলের প্রায় ৮০-৯০% স্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড থাকে। এ কারনেই শীতকালে নারকেল তেল জমে যায়। বিভিন্ন গবেষণা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃত মেটা আনালাইসিসে দেখা গেছে নারকেল তেল রক্তে মোট কোলেস্টেরল, ক্ষতিকারক এলডিএল ও উপকারী এইচডিএল এর পরিমান বাড়ায় অন্যান্য ভোজ্য তেল এর তুলনায়। যদিও উপকারী এইচডিএল এর পরিমান বাড়ছে কিন্তু সেই সাথে এলডিএল ও মোট কোলেস্টেরল এর পরিমান বাড়ায় সার্বিক ক্ষতির পরিমান বেশি হতে পারে বিধায় নিয়মিত নারকেল তেল খাওয়া স্বাস্থ্যকর নয়।
তেলের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় গুরুতপূর্ণ বিষয় হচ্ছে স্মোক পয়েন্ট, অর্থাৎ কত তাপমাত্রায় তেল পুড়ে যেয়ে ধোয়া উঠতে শুরু করে। স্মোক পয়েন্টের কাছাকাছি বা আরও উচ্চ তাপমাত্রায় তেলের সাথে বাতাসের অক্সিজেনের বিক্রিয়া শুরু হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় ফ্রি র্যাডিকেল উৎপন্ন হয়। তেলে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটিএসিড এর পরিমান যত বেশি থাকে তত বেশি ফ্রি র্যাডিকেল তত কম তাপমাত্রায় তৈরি হয়। দীর্ঘসময় এবং বার বার তেল গরম করলে এই প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হয়। এ কারনে কম স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত তেলে অল্প তাপেই ধোয়া উঠতে শুরু করে। এই ধোয়ায় প্রচুর PHA (পলিসাইক্লিক এরোমেটিক হাইড্রোকার্বন) থাকে। এই PHA ও অন্যান্য ফ্রি র্যাডিকেল শ্বাস গ্রহন ও খাওয়ার মাধ্যমে শরীরে ঢুকে কোষের সেল মেমব্রেন ও ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএতে ক্ষতিকারক মিউটেশন এর মাধ্যমে সেখান থেকে ক্যান্সার, হৃদরোগ সহ নানা ধরনের দীর্ঘমেয়াদী রোগের ঝুকি বাড়াতে পারে। যারা এ ধরনের ধোয়ার মাঝে রান্না করেন তাদের ক্যান্সার হবার ঝুকি আরও বেশি। সয়াবিন তেলের স্মোক পয়েন্ট ২৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস, সূর্যমুখী তেলের ২৪৪ ডিগ্রী, পাম ওয়েল ২৩০ ডিগ্রী, রাইস ব্র্যান ওয়েল ২১৩, এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ ওয়েল ১৯০ ডিগ্রী, অপরিশোধিত নারকেল তেল ১৭৭ ডিগ্রী, এবং সরিষার তেলের স্মোক পয়েন্ট ২৫৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস। সুতরাং দেখা যাচ্ছে নারকেল তেল ও অলিভ ওয়েল উভয়েরই স্মোক পয়েন্ট কম এবং উচ্চতাপে রান্নার উপযোগী নয়। অন্যদিকে সরিষা, সয়াবিন ও সূর্যমুখী তেল উচ্চতাপে রান্নার উপযোগী। পাম ওয়েল মাঝারি তাপমাত্রায় রান্নার উপযোগী কিন্তু এটিই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যাবহৃত বাণিজ্যিক তেল যা ডিপ ফ্রাই করতে এবং বার বার গরম করে রান্না করতে ব্যবহার করা হয়।
সুতরাং সামগ্রিকভাবে রান্নার জন্য কোন একটি নির্দিষ্ট ভোজ্য তেল কে সবদিক থেকে স্বাস্থ্যকর বলা সম্ভব না। কম স্মোক পয়েন্টের, কম স্যচুরেটেড ফ্যাট যুক্ত তেল অল্প তাপে রান্না ও সালাদে ব্যবহার উপযোগী যেমন ভার্জিন অলিভ ওয়েল। উচ্চতাপে রান্নার জন্য উচ্চ স্মোকপয়েন্টযুক্ত এবং কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট সম্পম্ন ভোজ্যতেল কম ক্ষতিকর, সেদিক থেকে সয়াবিন, সূর্যমুখী ইত্যাদি দেল ব্যবহার করা যেতে। বাঙ্গালি রান্নার নিত্য সঙ্গী সরিষার তেল সম্পর্কে যথেস্ট পরিমান উচ্চ মান সম্পন্ন গবেষণা না থাকায় এর ইরুসিক এসিড জনিত ক্ষতির ব্যাপারে নিশ্চিত মন্তব্য করা যাচ্ছে না তাই পারতপক্ষে রান্নায় এড়িয়ে চলাই ভালো। গবেষকগণ বিভিন্ন তেলের মিশ্রন রান্নায় ব্যবহারের পক্ষেও মতামত দিয়েছেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ হলো ভোজ্যতেলে ১:১.৫:১ অনুপাতে স্যাচুরেটেড:মনোআস্যাচুরেটেড:পলিআনস্যাচুরেটেড (অর্থাৎ মোট তেলের ২৮.৫% এর কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট) ফ্যাটি এসিড থাকা এবং ১:৫-১০ অনুপারতে ওমেগা-৩:ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড থাকা স্বাস্থ্যকর। কোন একক তেলে এই গুনাবলী নেই। ২০১৬ সালের একটি গবেষণা পত্রে দেখা যায়, সয়াবিন তেলের সাথে ৫০-৭৫% রাইস ব্র্যান ওয়েল মেশানোর ফলে উচ্চতাপে পুড়ে যাবার ব্যাপারটি কমেছে। অলিভ ওয়েলের সাথে সয়াবিন তেল/সূর্যমুখী তেল মেশালে ওমেগা-৩:৬ এর অনুপাত বৃদ্ধি পায়, স্যাচুরেটেড ফ্যাট কমে, রক্তে কোলেস্টেরল কমে। ইদুরে পরিচালিত পরীক্ষায় দেখা গেছে পামওয়েল ও সূর্যমুখী তেল একসাথে খাওয়ালে রক্তে এলডিএল (৪মিগ্রা/ডেসিলিটার) এর পরিমান সবচেয়ে কম হয় অন্যদিকে এইচডিএলও (৩০মিগ্রা/ডেসিলিটার) বাড়ে। অলিভওয়েল ও সয়াবিন মিশ্রনে এইচডিএল সর্বোচ্চ বাড়ে (১৩৫.৭মিগ্রা/ডেসিলিটার) কিন্তু এলডিএল এর পরিমানও বেড়ে যায় (৩০.৮মিগ্রা/ডেসিলিটার)। সরিষার একটি ধরন ক্যানোলা থেকে প্রস্তুতকৃত ক্যানোলা ওয়েলে ইরুসিক এসিড কম থাকে। ক্যানোলা ওয়েলের সাথে পাম ওয়েল/অলিভ ওয়েল/রাইস ব্র্যান ওয়েল মেশালেও উচ্চতাপ স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যকর ফ্যটিএসিড অনুপাত ও উপকারী এন্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায়। কোল্ড প্রেস (ঘাণি ভাঙ্গা) তেল এর সাথে উচ্চতাপ সহনশীল তেল (সয়াবিন, সূর্যমুখী,পাম ওয়েল) ইত্যাদি ব্যবহার করলেও তাপসহনশীলতা, স্বাস্থ্যকর ফ্যাটিএসিড অনুপাত রক্ষা ও এন্টি অক্সিডেন্ট সহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর উপাদানের সুবিধা পাওয়া যায়। এই সকল তথ্য বিবেচনায় নিয়ে আমাদের দৈনন্দিক নানা খাবারে ব্যবহারের উপযোগী তেল এর ধরন ও পরিমান নির্ধারন করা উচিত যার যার স্বাদ, রন্ধনশৈলী ও স্বাস্থ্যগত ঝুকি বুঝে। তবে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রন এবং সরকারিভাবে এটি নিশ্চিত করা। অন্যথায় দেশের সকল শ্রেণীর মানুষ বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুকি তে থাকবেন।
ডা. মো: মারুফুর রহমান
চিকিৎসক ও গবেষক
দ্যা ইউনিভার্সিটি অফ শেফিল্ড, যুক্তরাজ্য
তথ্যসূত্র:
https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S2772753X24000078
https://www.who.int/southeastasia/activities/eliminating-industrially-produced-trans-fats-from-diets-in-who-south-east-asia-region
https://bdnews24.com/amp/story/health%2Fer6quimc4k
https://www.frontiersin.org/journals/plant-science/articles/10.3389/fpls.2020.01315/full
https://www.cochranelibrary.com/cdsr/doi/10.1002/14651858.CD011737.pub3/full
https://www.thelancet.com/journals/lancet/article/PIIS0140-6736(17)32252-3/abstract
https://www.cochrane.org/CD011737/VASC_effect-cutting-down-saturated-fat-we-eat-our-risk-heart-disease
https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/high-blood-cholesterol/in-depth/trans-fat/art-20046114 #:~:text=Unlike%20other%20dietary%20fats%2C%20trans,heart%20and%20blood%20vessel%20disease.
https://www.who.int/news-room/questions-and-answers/item/nutrition-trans-fat
https://www.who.int/news/item/09-09-2020-more-than-3-billion-people-protected-from-harmful-trans-fat-in-their-food #:~:text=WHO%20recommends%20that%20trans%20fat,with%20a%202%2C000%2Dcalorie%20diet.
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC5121705/
https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1933287421002609
https://www.ahajournals.org/doi/10.1161/CIRCULATIONAHA.119.043052
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Cooking_oil
https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/28925728/
https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0924224416302886