02/05/2024
সুরা: আত-তওবা
আয়াত নং :-111
টিকা নং:106, 107,
اِنَّ اللّٰهَ اشْتَرٰى مِنَ الْمُؤْمِنِیْنَ اَنْفُسَهُمْ وَ اَمْوَالَهُمْ بِاَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ١ؕ یُقَاتِلُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ فَیَقْتُلُوْنَ وَ یُقْتَلُوْنَ١۫ وَعْدًا عَلَیْهِ حَقًّا فِی التَّوْرٰىةِ وَ الْاِنْجِیْلِ وَ الْقُرْاٰنِ١ؕ وَ مَنْ اَوْفٰى بِعَهْدِهٖ مِنَ اللّٰهِ فَاسْتَبْشِرُوْا بِبَیْعِكُمُ الَّذِیْ بَایَعْتُمْ بِهٖ١ؕ وَ ذٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِیْمُ
Surely Allah has purchased of the believers their lives and their belongings and in return has promised that they shall have Paradise. They fight in the cause of Allah, and slay and are slain. Such is the promise He has made incumbent upon Himself in the Torah, and the Gospel, and the Qur'an. Who is more faithful to his promise than Allah? Rejoice then, in the bargain you have made with Him. That indeed is the might triumph.
প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের প্রাণ ও ধন-সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন।১০৬ তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে এবং মারে ও মরে। তাদের প্রতি তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে(জান্নাতের ওয়াদা) আল্লাহর জিম্মায় একটি পাকাপোক্ত ওয়াদা বিশেষ।১০৭ আর আল্লাহর চাইতে বেশী নিজের ওয়াদা পূরণকারী আর কে আছে? কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে যে কেনা-বেচা করছো সেজন্য আনন্দ করো। এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১০৬) আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে ঈমানের যে ব্যাপারটা স্থিরকৃত হয় তাকে কেনাবেচা বলে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, ঈমান শুধুমাত্র একটা অতি প্রাকৃতিক আকীদা-বিশ্বাস নয়। বরং এটা একটি চুক্তি। এ চুক্তির প্রেক্ষিতে বান্দা তার নিজের প্রাণ ও নিজের ধন-সম্পদ আল্লাহর হাতে বিক্রি করে দেয়। আর এর বিনিময়ে সে আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ওয়াদা কবুল করে নেয় যে, মরার পর পরবর্তী জীবনে তিনি তাকে জান্নাত দান করবেন। এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু অনুধাবন করার জন্য সর্বপ্রথম কেনা-বেচার তাৎপর্য ও স্বরূপ কি তা ভালো ভাবে বুঝে নিতে হবে।
নিরেট সত্যের আলোকে বিচার করলে বলা যায় মানুষের ধন-প্রাণের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ। কারণ তিনিই তার কাছে যা কিছু আছে সব জিনিসের স্রষ্টা। সে যা কিছু ভোগ ও ব্যবহার করেছে তাও তিনিই তাকে দিয়েছেন। কাজেই এদিক দিয়ে তো কেনাবেচার কোন প্রশ্নেই ওঠে না। মানুষের এমন কিছু নেই, যা সে বিক্রি করবে। আবার কোন জিনিস আল্লাহর মালিকানার বাইরেও নেই, যা তিনি কিনবেন। কিন্তু মানুষের মধ্যে এমন একটি জিনিস আছে, যা আল্লাহ পুরোপুরি মানুষের হাতে সোর্পদ করে দিয়েছেন। সেটি হচ্ছে তার ইখতিয়ার অর্থাৎ নিজের স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতা ও স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি (Free will an freedom of choice)। এ ইখতিয়ারের কারণে অবশ্যই প্রকৃত সত্যের কোন পরিবর্তন হয় না। কিন্তু মানুষ এ মর্মে স্বাধীনতা লাভ করে যে, সে চাইলে প্রকৃত সত্যকে মেনে নিতে পারে এবং চাইলে তা অস্বীকার করতে পারে। অন্য কথায় এ ইখতিয়ারের মানে এ নয় যে মানুষ প্রকৃত পক্ষে তার নিজের প্রাণের নিজের বুদ্ধিবৃত্তি ও শারীরিক শক্তির এবং দুনিয়ায় সে যে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা লাভ করেছে, তার মালিক হয়ে গেছে। এ সঙ্গে এ জিনিসগুলো সে যেভাবে চাইবে সেভাবে ব্যবহার করার অধিকার লাভ করেছে, একথাও ঠিক নয়। বরং এর অর্থ কেবল এতটুকুই যে, তাকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, আল্লাহর পক্ষে থেকে কোন প্রকার জোর-জবরদস্তি ছাড়াই সে নিজেরই নিজের সত্তার ও নিজের প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর আল্লাহর মালিকানা ইচ্ছা করলে স্বীকার করতে পারে আবার ইচ্ছা করলে নিজেই নিজের মালিক হয়ে যেতে পারে এবং নিজেই একথা মনে করতে পারে যে, সে আল্লাহ থেকে বেপরোয়া হয়ে নিজের ইখতিয়ার তথা স্বাধীন কর্মক্ষমতার সীমানার মধ্যে নিজের ইচ্ছামত কাজ করার অধিকার রাখে। এখানেই কেনা-বেচার প্রশ্নটা দেখা দেয়। আসলে এ কেনা-বেচা এ অর্থে নয় যে, মানুষের একটি জিনিস আল্লাহ কিনতে চান, বরং প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, যে জিনিসটি আল্লাহর মালিকানাধীন যাকে তিনি আমানত হিসেবে মানুষের হাতে সোর্পদ করেছেন এবং যে ব্যাপারে বিশ্বস্ত থাকার বা অবিশ্বস্ত হবার স্বাধীনতা তিনি মানুষকে দিয়ে রেখেছেন সে ব্যাপারে তিনি মানুষের দাবী করেন, আমার জিনিসকে তুমি স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে (বাধ্য হয়ে নাও)। এ সঙ্গে খেয়ানত করার যে স্বাধীনতা তোমাকে দিয়েছি তা তুমি নিজেই প্রত্যাহার করো। এভাবে যদি তুমি দুনিয়ার বর্তমান অস্থায়ী জীবনে নিজের স্বাধীনতাকে (যা তোমার অর্জিত নয় বরং আমার দেয়া) আমার হাতে বিক্রি করে দাও তাহলে আমি পরবর্তী চিরন্তন জীবনে এর মূল্য জান্নাতের আকারে তোমাকে দান করবো। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কেনা-বেচার এ চুক্তি সম্পাদন করে সে মু’মিন। ঈমান আসলে এ কেনা-বেচার আর এক নাম। আর যে ব্যক্তি এটা অস্বীকার করবে অথবা অঙ্গীকার করার পরও এমন আচরণ করবে যা কেবলমাত্র কেনা-বেচা না করার অবস্থায় করা যেতে পারে সে কাফের। আসলে এ কেনা-বেচাকে পাস কাটিয়ে চলার পারিভাষিক নাম কুফরী। কেনা-বেচার এ তাৎপর্য ও স্বরূপটি অনুধাবন করার পর এবার তার অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করা যাকঃ
এক. এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ মানুষকে দু’টি বড় বড় পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন। প্রথম পরীক্ষাটি হচ্ছে, তাকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেবার পর সে মালিকাকে মালিক মনে করার এবং বিশ্বাসঘাতকতা ও বিদ্রোহের পর্যায়ের নেমে না আসার মতো সৎ আচরণ করে কিনা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নিজের প্রভু ও মালিক আল্লাহর কাছ থেকে আজ নগদ যে মূল্য পাওয়া যাচ্ছে, না বরং মরার পর পরকালীন জীবনে যে মূল্য আদায় করার ওয়াদা তার পক্ষ থেকে করা হয়েছে তার বিনিময়ে নিজের আজকের স্বাধীনতা ও তার যাবতীয় স্বাদ বিক্রি করতে স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে রাজী হয়ে যাবার মত আস্থা তার প্রতি আছে কিনা।
দুইঃ যে ফিকাহর আইনের ভিত্তিতে দুনিয়ার ইসলামী সমাজ গঠিত হয় তার দৃষ্টিতে ঈমান শুধুমাত্র কতিপয় বিশ্বাসের স্বীকৃতির নাম। এ স্বীকৃতির পর নিজের স্বীকৃতি ও অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে মিথ্যুক হবার সুস্পষ্ট প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত শরীয়াতের কোন বিচারক কাউকে অমু’মিন বা ইসলামী মিল্লাত বহির্ভূত ঘোষণা করতে পারে না। কিন্তু আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য ঈমানের তাৎপর্য ও স্বরূপ হচ্ছে, বান্দা তার চিন্তা ও কর্ম উভয়ের স্বাধীনতা ও স্বাধীন ক্ষমতা আল্লাহর হাতে বিক্রি করে দিবে এবং নিজের মালিকানার দাবী পুরোপুরি তার সপক্ষে প্রত্যাহার করবে। কাজেই যদি কোন ব্যক্তি ইসলামের কালেমার স্বীকৃতি দেয় এবং নামায-রোযা ইত্যাদির বিধানও মেনে চলে, কিন্তু নিজেকে নিজের দেহ ও প্রাণের নিজের মন, মস্তিষ্ক ও শারীরিক শক্তির নিজের ধন-সম্পদ, উপায়, উপকরণ ইত্যাদির এবং নিজের অধিকার ও নিয়ন্ত্রণাধীন সমস্ত জিনিসের মালিক মনে করে এবং সেগুলোকে নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করার স্বাধীনতা নিজের জন্য সংরক্ষিত রাখে, তাহলে হয়তো দুনিয়ায় তাকে মু’মিন মনে করা হবে কিন্তু আল্লাহর কাছে সে অবশ্যই অমু’মিন হিসেবে গণ্য হবে। কারণ কুরআনের দৃষ্টিতে কেনা-বেচার ব্যাপারে ইমানের আসল তাৎপর্য ও স্বরূপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সে আল্লাহর সাথে আদতে কোন কেনা-বেচার কাজই করেননি। যেখানে আল্লাহ চান সেখানে ধন প্রাণ নিয়োগ না করা এবং যেখানে তিনি চান না সেখানে ধন প্রাণ নিয়োগ ও ব্যবহার করা-এ দু’টি কার্য ধারাই চূড়ান্তভাবে ফয়সালা করে দেয় যে, ইমানের দাবীদার ব্যক্তি তার ধন প্রাণ আল্লাহর হাতে বিক্রি করেইনি অথবা বিক্রির চুক্তি করার পরও সে বিক্রি করা জিনিসকে যথারীতি নিজের মনে করেছে।
তিনঃ ঈমানের এ তাৎপর্য ও স্বরূপ ইসলামী জীবনাচরণকে কাফেরী জীবনাচরণ থেকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ আলাদা করে দেয়। যে মুসলিম ব্যক্তি সঠিক অর্থে আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে সে জীবনের সকল বিভাগে আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত হয়ে কাজ করে। তার আচরণে কোথাও স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটতে পারে না। তবে কোন সময় সাময়িকভাবে সে গাফলতির শিকার হতে পারে এবং আল্লাহর সাথে নিজের কেনা-বেচার চুক্তির কথা ভুলে গিয়ে স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা অবলম্বন করাও তার পক্ষে সম্ভব। এটা অবশ্যই ভিন্ন ব্যাপার। অনুরূপভাবে ঈমানদারদের সমন্বয়ে গঠিত কোন দল বা সমাজ সমষ্টিগতভাবেও আল্লাহর ইচ্ছা ও তার শরয়ী আইনের বিধিনিষেধ মুক্ত হয়ে কোন নীতি পদ্ধতি রাষ্ট্রীয় নীতি, তামাদ্দুনিক ও সাংস্কৃতিক পদ্ধতি এবং কোন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক আচরণ অবলম্বন করতে পারে না। কোন সাময়িক গাফলতির কারণে যদি সেটা অবলম্বন করেও থাকে তাহলে যখনই সে এ ব্যাপারে জানতে পারবে তখনই স্বাধীন ও স্বৈরাচারী আচরণ ত্যাগ করে পুনরায় বন্দেগীর আচরণ করতে থাকবে। আল্লাহর আনুগত্য মুক্ত হয়ে কাজ করা এবং নিজের ও নিজের সাথে সংশ্লিষ্টদের ব্যাপারে নিজে নিজেই কি করবোনা করবো, সিদ্ধান্ত নেয়া অবশ্যই একটি কুফরী জীবনাচরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। যাদের জীবন যাপন পদ্ধতি এ রকম তারা মুসলমান নামে আখ্যায়িত হোক বা অমুসলিম নামে তাতে কিছু যায় আসে না।
চারঃ এ কেনা-বেচার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহর যে ইচ্ছার আনুগত্য মানুষের জন্য অপরিহার্য হয় তা মানুষের নিজের প্রস্তাবিত বা উদ্ভাবিত নয় বরং আল্লাহ নিজে যেমন ব্যক্ত করেন তেমন। নিজে নিজেই কোন জিনিসকে আল্লাহর ইচ্ছা বলে ধরে নেয়া এবং তার আনুগত্য করতে থাকা মূলত আল্লাহর ইচ্ছা নয় বরং নিজেরই ইচ্ছার আনুগত্য করার শামিল। এটি এ কেনাবেচার চুক্তির সম্পূর্ণ বিরোধী। যে ব্যক্তি ও দল আল্লাহর কিতাব ও তার নবীর হেদায়াত থেকে নিজের সমগ্র জীবনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে একমাত্র তাকেই আল্লাহর সাথে কৃত নিজের কেনা-বেচার চুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করা হবে।
এ হচ্ছে এ কেনা-বেচার অন্তনিহিত বিষয়। এ বিষয়টি অনুধাবন করার পর এ কেনা-বেচার ক্ষেত্রে বর্তমান পার্থিব জীবনের অবসানের পর মূল্য (অর্থাৎ জান্নাত।) দেবার কথা বলা হয়েছে কেন তাও আপনা আপনিই বুঝে আসে। বিক্রেতা নিজের প্রাণ ও ধন-সম্পদ আল্লাহর হাতে বিক্রি করে দেবে কেবলমাত্র এ অঙ্গীকারের বিনিময়েই যে জান্নাত পাওয়া যাবে তা নয়। বরং বিক্রেতা নিজের পার্থিব জীবনে এ বিক্রি করা জিনিসের ওপর নিজের স্বাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার প্রত্যাহার করবে এবং আল্লাহ প্রদত্ত আমানতের রক্ষক হয়ে তার ইচ্ছা অনুযায়ী হস্তক্ষেপ করবে। এরূপ বাস্তব ও সক্রিয় তৎপরতার বিনিময়েই জান্নাত প্রাপ্তি নিশ্চিত হতে পারে। সুতরাং বিক্রেতার পার্থিব জীবনকাল ও শেষ হবার পর যখন প্রমাণিত হবে যে, কেনা-বেচার চুক্তি করার পর সে নিজের পার্থিব জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চুক্তির শর্তসমূহ পুরোপুরি মেনে চলেছে একমাত্র তখনই এ বিক্রি সম্পূর্ণ হবে। এর আগে পর্যন্ত ইনসাফের দৃষ্টিতে সে মূল্য পাওয়ার অধিকারী হতে পারে না।
এ বিষয় গুলো পরিষ্কার ভাবে বুঝে নেবার সাথে সাথে এ বর্ণনার ধারাবাহিকতায় কোন প্রেক্ষাপটে এ বিষয়বস্তুটির অবতারণা হয়েছে তাও জেনে নেয়া উচিত। ওপর থেকে যে ধারাবাহিক ভাষণ চলে আসছিল তাতে এমন সব লোকের কথা ছিল যারা ঈমান আনার অঙ্গীকার করেছিল ঠিকই কিন্তু পরীক্ষার কঠিন সময় সমুপস্থিত হলে তাদের অনেকে গাফলতির কারণে, অনেকে আন্তরিকতার অভাবে এবং অনেকে চূড়ান্ত মুনাফিকীর পথ অবলম্বন করার ফলে আল্লাহর ও তার দ্বীনের জন্য নিজের সময় ধন সম্পদ স্বার্থ ও প্রাণ দিতে ইতস্তত করেছিল। কাজেই এ বিভিন্ন ব্যক্তি ও শ্রেণীর আচরণের সমালোচনা করার পর এখন তাদেরকে পরিষ্কার বলে দেয়া হচ্ছে, তোমরা যে ঈমান গ্রহণ করার অঙ্গীকার করেছো তা নিছক আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ব মেনে নেবার নাম নয়। বরং একমাত্র আল্লাহই যে তোমাদের জান ও তোমাদের ধন-সম্পদের মালিক ও অকাট্য ও নিগূঢ় তত্ত্ব মেনে নেয়া ও এর স্বীকৃতি দেয়ার নামই ঈমান। কাজেই এ অঙ্গীকার করার পর যদি তোমরা এ প্রাণ ও ধন-সম্পদ আল্লাহর হুকুমে কুরবানী করতে ইতস্তত করো এবং অন্যদিকে নিজের দৈহিক ও আত্মিক শক্তিসমূহ এবং নিজের উপায়-উপকরণ সমূহ আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে থাকো তাহলে এ থেকে একথাই প্রমাণিত হবে যে, তোমাদের অঙ্গীকার মিথ্যা। সাচ্চা ঈমানদার একমাত্র তারাই যারা যথার্থই নিজেদের জান-মাল আল্লাহর হাতে বিকিয়ে দিয়েছে এবং তাকেই এ সবের মালিক মনে করেছে। তিনি এগুলো যেখানে ব্যয় করার নির্দেশ দেন সেখানে নির্দ্বিধায় এগুলো ব্যয় করে এবং যেখানে তিনি নিষেধ করেন সেখানে দেহ ও আত্মার সামান্যতম শক্তিও এবং আর্থিক উপকরণের নগন্যতম অংশও ব্যয় করতে রাজী হয় না।
টিকা:১০৭) এ ব্যাপারে অনেক গুলো আপত্তি তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, এখানে যে ওয়াদার কথা বলা হয়েছে তা তাওরাত ও ইঞ্জিলে নেই। কিন্তু ইঞ্জিলের ব্যাপারে এ ধরনের কথা বলার কোন ভিত্তি নেই। বর্তমানে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে যে ইঞ্জিলসমূহ পাওয়া যায় সেগুলোর হযরত ঈসা (আ) এর এমন অনেক গুলো উক্তি পাওয়া যায় যেগুলো এ আয়াতের সমর্থক। যেমনঃ
ধন্য যাহারা ধার্মিকতার জন্য তাড়িত হইয়াছে, কারণ স্বর্গরাজ্য তাহাদেরই। (মথি ৫: ১০)
যে কেহ আপন প্রাণ রক্ষা করে, সে তাহা হারাইবে এবং যে কেহ আমার নিমিত্ত আপন প্রাণ হারায়, সে তাহা রক্ষা করিবে। (মথি ১০: ৩৯)
আর যে কোন ব্যক্তি আমার নামের জন্য বাটী কি ভ্রাতা, কি ভাগিনী কি পিতা ও মাতা, কি সন্তান, কি ক্ষেত্র পরিত্যাগ করিয়াছে, সে তাহার শতগুণ পাইবে এবং অনন্ত জীবনের অধিকারী হইবে। (মথি ১৯: ২৯)
তবে তাওরাত বর্তমানে যে অবস্থায় পাওয়া যায় তাতে অবশ্যই এ বিষয়বস্তুটি পাওয়া যায় না। শুধু এটি কেন, সেখানে তো মৃত্যুর পরবর্তী জীবন, শেষ বিচারের দিন ও পরকালীন পুরস্কার ও শাস্তির ধারণাই অনুপস্থিত। অথচ এ আকীদা সবসময় আল্লাহর সত্য দ্বীনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবেই বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু বর্তমান তাওরাতে এ বিষয়টির অস্তিত্ব না থাকার ফলে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাও ঠিক নয় যে, যথার্থই তাওরাতের এ অস্তিত্ব ছিল না। আসলে ইহুদীরা তাদের অবনতির যুগে এতই বস্তুবাদী ও দুনিয়াবি সমৃদ্ধির মোহে এমন পাগল হয়ে গিয়েছিলো যে, তাদের কাছে নিয়ামত ও পুরস্কার এ দুনিয়ায় লাভ করা ছাড়া তার আর কোন অর্থই ছিলো না। এ কারণে আল্লাহর কিতাবে বন্দেগী ও আনুগত্যের বিনিময়ে তাদেরকে যেসব পুরস্কার দেবার ওয়াদা করা হয়েছিল সে সবকে তারা দুনিয়ার এ মাটিতেই নামিয়ে এনেছিল এবং জান্নাতের প্রতিটি সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যকে তারা তাদের আকাংঙ্খিত ফিলিস্তিনের ওপর প্রয়োগ করেছিল। তাওরাতের বিভিন্ন স্থানে আমরা এ ধরনের বিষয়বস্তু দেখতে পাই। যেমনঃ
হে ইসরায়েল শুন, আমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভু একই সদা প্রভু, তুমি তোমার সমস্ত হৃদয়, তোমার সমস্ত প্রাণ ও তোমার সমস্ত শক্তি দিয়া আপন ঈশ্বর সদা প্রভুকে প্রেম করিবে। (দ্বিতীয় বিবরণ ৬: ৪, ৫)
আরো দেখিঃ তিনি কি তোমার পিতা নহেন, যিনি তোমাকে লাভ করিলেন। তিনিই তোমার নির্মাতা ও স্থিতি কর্তা। (দ্বিতীয় বিবরণ ৩২: ৬)
কিন্তু আল্লাহর সাথে এ সম্পর্কের যে পুরস্কার বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, তোমরা এমন একটি দেশের মালিক হয়ে যাবে যেখানে দুধ ও মধুর নহর প্রবাহিত হচ্ছে অর্থাৎ ফিলিস্তিন। এর আসল কারণ হচ্ছে, তাওরাত বর্তমানে যে অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে তা প্রথমত সম্পূর্ণ নয়, তাছাড়া নির্ভেজাল আল্লাহর বাণী সম্বলিত ও নয়। বরং তার মধ্যে আল্লাহর বানীর সাথে অনেক ব্যাখ্যামূলক বক্তব্য ও সংযোজিত করে দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে ইহুদীদের জাতীয় ঐতিহ্য, বংশ প্রীতি, কুসংস্কার আশা-আকাঙ্ক্ষা ভুল ধারণাও ফিকাহ ভিত্তিক ইজতিহাদের একটি বিরাট অংশ একই ভাষণ ও বানী পরস্পরার মধ্যে এমন ভাবে মিশ্রিত হয়ে গেছে যে, অধিকাংশ স্থানে আল্লাহর আসল কালামকে তার মধ্যে থেকে পৃথক করে বের করে নিয়ে আসা একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। (এ প্রসঙ্গে আরো দেখুন সূরা আলে ইমরানের ২ টীকা।)
ফী জিলালিল কুরআন:
সূরার এটি হচ্ছে শেষ অংশ, শেষ আলোচনা ৷ এতে মুসলিম সমাজের সাথে অমুসলিম সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সম্পর্কের অবশিষ্ট বিষয়গুলো বর্ণনা করা হয়েছে। এ আলোচনা শুরু করা হয়েছে মুসলমানের সাথে তার মালিকের সম্পর্কের মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে । এখানে ইসলামের সে মূল প্রকৃতি বর্ণিত হয়েছে যার ঘোষণা সূরার এ পর্যায়ে দেয়া হয়েছে। এখানে দ্বীনের হুকুম আহকামের বর্ণনা পেশ করা হয়েছে। এর সাথে এই আন্দোলনের দিক ও বৈশিষ্ট্যের আলোচনাও করা হয়েছে। ইসলামী জীবন বিধানে কোনো মানব সন্তানের প্রবেশ যেন একজন ক্রেতা বিক্রেতার মাঝে সম্পাদিত কোনো চুক্তি। এখানে আল্লাহ তায়ালা হচ্ছেন ক্রেতা আর মোমেন হচ্ছে বিক্রেতা ৷ এটা হচ্ছে আল্লাহর সাথে মোমেনের সম্পাদিত একটি আনুগত্যের চুক্তিনামা- এ চুক্তিনামায় স্বাক্ষর দানের পর মোমেনের কোনো জিনিসই তার আর নিজের থাকে না, না তার মাল, না তার জান । এরপর সে তার জীবনকে আল্লাহ তায়ালা ও তার পথে জেহাদ করা থেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। যার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর বিধান সমুন্নত হোক এবং জীবনের সব কয়টি দিক ও বিভাগ আল্লাহর দ্বীনের অনুগত হয়ে থাক । সূরার এ শেষ অংশে মোমেন তার জীবন ও তার সম্পদকে একটি সুনির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে আল্লাহর কাছে বিক্রি করে দিয়েছে আর সে নির্দিষ্ট মূল্যটি হচ্ছে জান্নাত । মূল্যের দিক থেকে তার জান আর মাল তো কোনো অবস্থায়ই জান্নাতের সমান হতে পারে না। আসলে এটাকে বিনিময় মূল্য হিসেবে নির্ধারণ করা মোমেনের ওপর আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ । যেমন এরশাদ হচ্ছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা মোমেনদের কাছ থেকে......... (আয়াত ১১১) যে সব লোক এ ক্রয় বিক্রয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, তারা ছিলো সমাজের কতিপয় বাছাই করা আল্লাহর নেক বান্দাহ। তাদের মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিলো, যা সাধারণত অন্য মানুষের মধ্যে পাওয়া যেতো না। এর কিছু গুণ বৈশিষ্ট্য ছিলো তাদের ব্যক্তি-চরিত্রের সাথে জড়িত, যা দিয়ে তারা আল্লাহর সাথে বেচাকেনার চুক্তি করেছে। এগুলোর কিছু তাদের দৈনন্দিন অভ্যাসের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলো। আবার তাদের এমন কিছু গুণও ছিলো যার সম্পর্ক ছিলো ব্যক্তিগত সীমারেখার বাইরে- এগুলোকেও তারা নিজেদের ওপর করণীয় করে নিয়েছিলো ৷ যেমন আল্লাহর অন্য বান্দাহকে নেক কাজের আদেশ দেয়া, তাদের অন্যায় কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখা । এই গুণটি দ্বারা আল্লাহর দ্বীনকে আল্লাহর যমীনে প্রতিষ্ঠা করা এবং এর দ্বারা নিজেদের জীবনে ও অন্যান্য মানুষদের জীবনে আল্লাহর সীমারেখাকে যথাযথ কায়েম রাখা । এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, (যারা আল্লাহর দরবারে) তাওবা করে (নিষ্ঠার সাথে তার) এবাদাত করে ...... (আয়াত ১১২) কোরআনের বর্ণনার গতি অনুযায়ী পরবর্তী আয়াতে যারা আল্লাহর সাথে এ বেচাকেনার চুক্তি সম্পাদন করেছে, আর যারা আল্লাহর সাথে এমন কোনো ধরনের চুক্তি সম্পাদন করেনি- এ উভয় দলের সম্পর্ককে আলাদা ও বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। এমনকি তারা যদি একান্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও আপনজনও হয়, তাহলেও এদের মধ্যে আর পারস্পরিক কোনো সম্পর্ক থাকবে না। এর কারণ হচ্ছে, এদের উভয়ের লক্ষ্য হচ্ছে ভিন্নমুখী । উদ্দেশ্য ও মনযিল আলাদা আলাদা । যারা এই বন্ধনে একবার আল্লাহর সাথে নিজেদের জড়িয়ে নিয়েছে, তারা হচ্ছে জান্নাতের অধিবাসী। অপরদিকে যারা এখনো এ চুক্তি সম্পাদন করেনি, তারা হচ্ছে জাহান্নামী! এখন এ দু'দলের মাঝে দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় সম্পর্ক, চলাফেরা শেষ হয়ে গেলো ৷ এ থেকে এ কথাটা স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, রক্ত, বংশ ও আত্মীয়তার সম্পর্ক কখনো জান্নাতীদের সাথে জাহান্নামী মানুষের সম্পর্কের সেতুবন্ধ হতে পারে না- এসব বৈষয়িক সম্পর্কের মাঝে এমন কোনো যোগ্যতাই নেই যে, এদের উভয়ের মিলাতে পারে। এ পর্যায়ে আল্লাহর এরশাদ হচ্ছে, নবী ও তার ঈমানদার (সাথীদের) জন্যে এটা মানায় না................. (আয়াত ১১৩-১১৪) মোমেন আনুগত্যের এই চুক্তি শুধু আল্লাহর সাথে করেছে। তাই তার যাবতীয় বন্ধুত্ব শুধু আল্লাহর জন্যেই নির্দিষ্ট । তার সব সম্পর্ক এরই ওপর নির্ভর করে আল্লাহর পক্ষ থেকে একথাটার ঘোষণা- ঈমানদারদের যাবতীয় সন্দেহ যাবতীয় দ্বন্দ্ব থেকে বাচিয়ে দেয়। এই স্পষ্ট ঘোষণা তাদের সব ধরনের গোমরাহী থেকেও মাহফুয করে রাখে ৷ তাদের জন্যে আল্লাহর বন্ধুত্ব ও তার সাহায্যই যথেষ্ট। একবার এই বিষয়টি অর্জিত হয়ে গেলে তাদের সত্যিকার অর্থে আর কোনো জিনিসেরই দরকার হয় না। তিনিই হচ্ছেন আসমান যমীনের সর্বময় বাদশাহ । তিনি ছাড়া আর কারো কোনো কিছুর ক্ষমতাই নেই। আল্লাহ তায়ালা বলছেন-আল্লাহ তায়ালা এমন নন যে, কোনো জাতিকে একবার হেদায়াত দানের পর........ (আয়াত ১১৫-১১৬) আল্লাহর সাথে চুক্তি ও আনুগত্যের এই যখন আসল প্রকৃতি, তখন একবার এই চুক্তি সম্পাদন করে নেয়ার পর আল্লাহর পথে জেহাদ করা থেকে দ্বিধা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়া কিংবা এ পথ থেকে পিছু হটে যাওয়া অবশ্যই একটা বিরাট রকমের ব্যাপার । তারপরও যারা এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব করেছে এবং জেহাদে না গিয়ে পেছনে থেকে গেছে, সে সব মোমেনকে আল্লাহ তায়ালা মাফ করে দিয়েছেন কেননা আল্লাহ তায়ালা তাদের নেক নিয়তের কথা জানতেন! তাদের নিষ্ঠার কথাও তিনি জানতেন । এটা ছিলো তাদের ওপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ । আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌম ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতেই.......(আয়াত ১১৬) এখান থেকে আল্লাহ তায়ালা মদীনার অধিবাসী ও এই শহরের পার্শ্ববর্তী লোকজনদের রসূলের প্রতি আনুগত্যের দায়িত্ব বর্ণনা করছেন। কেননা তারাই ছিলো রসূলের সবচাইতে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি । তাদের সামষ্টিক কর্মকান্ডের ওপর ইসলামের ভিত্তি ছিলো নির্ভরশীল ৷ ইসলামী আন্দোলনেরও কেন্দ্রভুমি ছিলো এটি । জেহাদের ময়দানে তাই এদের পেছনে পড়ে থাকা ছিলো খুবই খারাপ ব্যাপার । তাদের প্রতিটি কদমে এখানে আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করার কথার গুরুত্বও বুঝানো হয়েছে। কেননা আল্লাহর সাথে সম্পাদিত চুক্তির এটাও ছিলো একটি বিশেষ দাবী যে, তারা এ পথে নিজেদের অর্থ ব্যয় করবে। এরশাদ হচ্ছে, মদীনার (মূল) অধিবাসী ও তাদের আশপাশের বেদুইন আরবদের জন্যে ......(আয়াত ১২০-১২১) আল্লাহর পক্ষ থেকে জেহাদের সাধারণ ঘোষণা আসলে দেশের সব মানুষের ওপর জেহাদ ফরয হয়ে যায়। সে অবস্থায় কারো জন্যেই পেছনে পড়ে থাকা বৈধ নয়। তবে এ ধরনের অবস্থা না হলে জেহাদের জন্যে প্রতিটি বস্তি ও দল থেকে একটা গ্রুপ জেহাদের ময়দানে যাবে এবং দ্বীনের জ্ঞান শিখে নিজেদের লোকদের কাছে ফিরে আসবে । আর বাকী লোকেরা সমাজের অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ করবে, যেমন যমীনের উন্নতি করা, ফসলের উৎপাদন করা- পরিশেষে এ উভয় দলের কাজ একীভূত হয়ে উভয়ের উদ্দেশ্যে একটি প্রান্তে এসে মিশে যাবে৷ ঘোষণা হচ্ছে, মোমেনদের কখনো (কোনো অভিযানে) সবার........(আয়াত ১২২) পরবর্তী আয়াতে জেহাদী আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি বর্ণনা করা হয়েছে। এ সময় গোটা আরব উপদ্বীপ ইসলামের সমগ্র বুনিয়াদ ও তার অগ্রগামিতা রোধ করার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছিলো । অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে উপনীত হয়ে পড়েছিলো যে, সবকটি কাফেরের সাথে যুদ্ধ করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো- যেন কুফরী ফেতনা নিঃশেষ হয়ে যায় এবং দ্বীন সার্বিকভাবে আল্লাহর জন্যে নির্ধারিত হয়ে যায়। একইভাবে সব আহলে কেতাবদের সাথেও যুদ্ধের আদেশ দেয়া হয়েছিলো- যাতে করে তারা তোমাদের সামনে নত হয়ে তোমাদের অধীনতার করো- তথা জিযিয়া দিতে বাধ্য হয়ে যায় । এরশাদ হচ্ছে, হে ঈমানদার লোকেরা, কাফেরদের মধ্যে যারা তোমাদের ............... (আয়াত ১২৩) আল্লাহর সাথে আনুগত্যের চুক্তি সম্পাদন করা, তার দাবী তার আন্দোলনের প্রকৃতির বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার পর পরবর্তী আয়াত কটিতে কোরআনের প্রতি মোনাফেকদের আচরণ ও মোমেনদের আচরণ দেখানো হয়েছে। কেননা তাতে একদিকে মোমেনদের আকীদা বিশ্বাস তাদের ব্যবহারিক জীবনের আদেশ নিষেধ নিয়েই নাযিল হয়েছিলো । অপরদিকে এ কথাও বলা হচ্ছিলো যে, মোনাফেকদের জন্যে কোনো রকম দলীল প্রমাণ, ভীতি প্রদর্শন ও বিপদ মুসীবত নাযিল এর কোনেটাই কোনো কাজে আসে না । বলা হচ্ছে, যখনি কোনো (নতুন) সূরা নাযিল হয়, তখন ............ (আয়াত ১২৪-১২৬) শেষ যে দুটো আয়াত দিয়ে সূরার শেষ আলোচনার সমাপ্তি টানা হচ্ছে, তাহলো রসূলের প্রকৃতি ও তার মেযাজ বর্ণনা । মোমেনদের জন্যে তার আগ্রহ, তার দয়া ও স্নেহসুলভ মনোভাব । সর্বশেষ আয়াতটিতে রসূলকে আদেশ দেয়া হয়েছে যেন তিনি সর্বাবস্থায় শুধু আল্লাহর ওপর ভরসা করেন এবং যারা আল্লাহর হেদায়াত গ্রহণ করেনি, তাদের সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলেন । বলা হয়েছে, (হে মানুষরা শোনো) তোমাদের কাছে তোমাদেরই মধ্য থেকে.....(আয়াত ১২৮-১২৯) সূরার এই শেষ অংশের বর্ণনায় সম্ভবত এ কথাটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, দ্বীন ইসলামে জেহাদের মর্যাদা একটি কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । আকীদা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে ইসলাম ও কুফরীর সম্পর্ক সম্পূর্ণ ভিন্নমুখী। মোমেনরা জান মাল দিয়ে রসূলের সাথে যে জান্নাত পাবার চুক্তি করেছে তার পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে যে, তারা দ্বীনকে গোটা দুনিয়ার সামনে পেশ করার জন্যে জেহাদে অবতীর্ণ হয়েছে। তারা এর বিনিময় দুনিয়ায় নয়- আখেরাতে জান্নাতের মাধ্যমে পেতে চায়। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহর সীমা সরহদকে সংরক্ষণ করা। আল্লাহর বান্দাদের সামনে তার সার্বভৌমত্বকে প্রতিষ্ঠা করা। যে ব্যক্তি ও দল এর বিরোধীতা করে সর্বশক্তি দিয়ে তাদের মোকাবেলা করবে । একই ভাবে এই আলোচনার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে এ কথাও জানা যায় যে, বর্তমান সময়ে আল্লাহর আয়াত ও শরীয়তের ব্যাখ্যাতারা কি মানসিক দৈন্যের শিকার হয়ে আছে। তারা চেষ্টা করছে ইসলামী জেহাদের এই আদেশকে একটি সংকীর্ণ সময় ও সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিতে ৷ অথচ আল্লাহ তায়ালার কেতাব ঘোষণা করছে গোমরাহী ও জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে প্রতিটি যামানায় প্রতিটি ভূখন্ডে এই জেহাদ জারী রাখতে এবং এই কেতাব এই হুকুম দিচ্ছে আশেপাশের কাফেরদের সাথে একটি স্থায়ী যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে ৷ কোনো অবস্থায়ই এই স্থায়ী জেহাদ থেকে গাফেল হওয়া যাবে না এবং এ ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে কঠোরতা সৃষ্টি করতে হবে৷ কেননা তাদের সাথে তোমাদের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। তোমরা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও একত্রে বিশ্বাস করো, তারা তা বিশ্বাস করে না। তারা গায়রুল্লাহ্র সার্বভৌমত্ব শুধু তাদের নিজেদের ওপরেই নয়, তোমাদের ওপরও চাপিয়ে দিতে চায়। তারা বান্দাদের অন্য মানুষের গোলামীতে নিমজ্জিত করে দিতে চায়। অথচ সার্বভৌমত্ত্ব সর্বাবস্থায়ই আল্লাহ তায়ালার জন্যে । এই হচ্ছে তাদের একটা বুনিয়াদী যুলুম ও বাড়াবাড়ির কারণে মুসলমানদের সর্বশক্তি দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে হবে। আমি এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানেই শেষ করছি। এবার আমি বিস্তারিত ব্যাখ্যায় অবতীর্ণ হবো। * ১১১ ও ১১২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা ১১২ নং আয়াতে পড়ুন।
English Tafheem:
See Next Ayah For English Explanation.