
20/06/2025
আপনার শিশু যদি ৬ মাস বয়স থেকে -
• একদমই খাবার খেতে না চায়
• শিশুর পেটে ফোলা ভাব থাকে
• শিশুর চেহারা ফ্যাকশে হয়ে যায় এবং
• শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি বা গ্রোথ যদি থেমে যায়
তাহলে আপনার শিশুকে নিয়ে অবশ্যই শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
শিশুদের থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় জন্মের প্রথম ৬ মাস থেকে ২ বছর বয়সের মধ্যে।
থ্যালাসেমিয়া (Thalassemia) একটি জিনগত রক্তের রোগ, যা শিশুর শরীরে স্বাভাবিকভাবে হিমোগ্লোবিন তৈরি হওয়াকে ব্যাহত করে। হিমোগ্লোবিন হলো রক্তের একটি প্রোটিন যা শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন বহন করে। থ্যালাসেমিয়ায় হিমোগ্লোবিনের উৎপাদন কমে যায় বা অস্বাভাবিক হয়, ফলে রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া দেখা দেয়।
🍀 থ্যালাসেমিয়া কীভাবে হয়?
থ্যালাসেমিয়া বংশগত রোগ, অর্থাৎ এটি বাবা-মায়ের কাছ থেকে সন্তানের জিনের মাধ্যমে উত্তরাধিকারসূত্রে আসে। এটি হয় তখনই, যখন পিতা-মাতা উভয়েই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক (carrier) হন।
🍀 থ্যালাসেমিয়ার ধরন
থ্যালাসেমিয়াকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়:
১. আলফা থ্যালাসেমিয়া (Alpha Thalassemia):
রক্তের হিমোগ্লোবিনের আলফা গ্লোবিন চেইনের ঘাটতির কারণে আলফা থ্যালাসেমিয়া হয়। আলফা থ্যালাসেমিয়া রোগের উপ-প্রকার ভাগ গুলো হলো:
• Silent carrier
• Alpha thalassemia trait
• Hemoglobin H disease
• Alpha thalassemia major (Bart's hydrops fetalis – গর্ভকালীন অবস্থায় এই শিশুদের মৃত্যু হয়)
২. বিটা থ্যালাসেমিয়া (Beta Thalassemia):
রক্তের হিমোগ্লোবিনের বিটা চেইনের ঘাটতির কারণে বিটা থ্যালাসেমিয়া হয়। আমাদের দেশে বিটা থ্যালাসেমিয়া সবচেয়ে কমন। বিটা থ্যালাসেমিয়া রোগের উপ-প্রকার ভাগ গুলো হলো:
• থ্যালাসেমিয়া মাইনর (Minor): এরা মূলত বাহক। এদের কোনো শারীরিক উপসর্গ না-ও থাকতে পারে।
• থ্যালাসেমিয়া ইন্টারমিডিয়া (Thalassemia Intermedia): এদের শরীরে মাঝারি ধরনের রক্তস্বল্পতা দেখা যায়।
• থ্যালাসেমিয়া মেজর (Major বা Cooley’s anemia): এদের গুরুতর রক্তস্বল্পতা দেখা যায়। এই ধরনের শিশুর জন্মের কয়েক মাস পরই শরীরে রোগের উপসর্গ দেখা দেয়।
🍀 থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ (Thalassemia Major-এ):
• শিশুর অতিরিক্ত দুর্বলতা ও ক্লান্তি
• শিশুর ত্বক ফ্যাকাসে বা হলদেটে হয়ে যাওয়া
• শিশুর যকৃত ও প্লীহা'র আকার আকৃতি বৃদ্ধি পায় (liver & spleen)
• শিশুর মুখ ও হাড়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়
• শিশু ঠিকভাবে বেড়ে না ওঠা
• শিশুর শরীরে বারবার ইনফেকশন হওয়া
• শিশুর হার্ট বা অন্যান্য অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া (যদি সঠিক চিকিৎসা করা না হয়)
🍀 থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্ণয়:
• Complete Blood Count (CBC)
• Hemoglobin Electrophoresis
• Genetic testing (DNA analysis)
• Ferritin level (লৌহমাত্রা যাচাই)
🍀 থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগের চিকিৎসা:
থ্যালাসেমিয়ার এখনো পূর্ণাঙ্গ নিরাময় নেই। তবে চিকিৎসা করে শিশুদের দীর্ঘ ও তুলনামূলক ভালো জীবনযাপন করানো যায়:
১. নিয়মিত রক্তসঞ্চালন (Blood Transfusion):
থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগীদের প্রতি ২-৪ সপ্তাহ পরপর রক্ত নিতে হয়।
২. লোহা সরানোর চিকিৎসা (Iron Chelation Therapy): রক্ত নিতে নিতে শরীরে অতিরিক্ত লৌহ জমে যায়, তা সরাতে ওষুধ প্রয়োজন (যেমনঃ Deferoxamine, Deferasirox)।
৩. Bone Marrow Transplant (BMT): একমাত্র সম্ভাব্য স্থায়ী চিকিৎসা, তবে এটি জটিল ও ব্যয়বহুল এবং উপযুক্ত ডোনার পাওয়া জরুরি।
🍀 থ্যালাসেমিয়া রোগের প্রতিরোধ:
• বিয়ের আগে নারী পুরুষের থ্যালাসেমিয়া রোগের স্ক্রিনিং করা (যদি দুইজনই বাহক হন, তাহলে বিয়ের আগে পরামর্শ নেয়া)
• বিবাহ পরবর্তীতে গর্ভকালীন জিন পরীক্ষা করা (Prenatal diagnosis)
• থ্যালাসেমিয়া রোগের সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
🍀 উপসংহার:
থ্যালাসেমিয়া একটি গুরুতর, তবে প্রতিরোধযোগ্য রোগ। শিশুর জন্মের আগে সচেতন হলে এই রোগ থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা সম্ভব। থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত শিশুদের প্রতি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সচেতনতা এবং শিশুকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণই শিশুর সুস্থতার নিশ্চয়তা দিতে পারে। অযথা আতঙ্কিত না হয়ে আপনার শিশুর যেকোনো স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবেলায় শিশুকে নিয়ে দ্রুত শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখানো এবং শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
দয়াকরে আপনারা সবাই সচেতন হবেন।
মনে রাখবেন, আপনার সচেতনতা, আপনার সন্তানের জন্য আশীর্বাদ।
পোস্টটি শেয়ার করুন। অসংখ্য বাবা-মায়ের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এই পোষ্টটি পড়া অত্যন্ত জরুরী।
ধন্যবাদ 🙏
Dr. Manik Mazumder MD - Paediatrician
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য), এমডি (শিশু)
নবজাতক, শিশু, কিশোর ও কিশোরী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
নবজাতক, শিশু পুষ্টি ও শিশু নিউরোলজি বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত
কনসালটেন্ট (শিশু)
ময়মনসিংহ।
নবজাতক ও শিশু বিশেষজ্ঞ/Child Specialist
মোবাইল নম্বর: ০১৭১১০৪৯৬২০