06/07/2021
একটা সাধারন করোনারোগী( আইসিইউ ব্যতীত) সরকারী হাসপাতালে ভর্তি হলে ৭ দিনে তার জন্য প্রায় ১ লক্ষ টাকা খরচ হয়। (যেটা বিনামুল্যে দেয়া হচ্ছে)
বিস্তারিতঃ
কোভিড-১৯ আক্রান্ত একজন রোগী সরকারী হাসপাতালে ৭ দিন ভর্তি থাকায় তার পিছনে খরচের হিসাব
আমি ময়মনসিংহ মেডিকেলের কোভিড-১৯ ইউনিটে কর্মরত আছি। করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করছি গত ২ মাস যাবত। রোগীর চিকিৎসা, ওষুধ প্রদান ও খাবার সহ সব কিছুর ব্যবস্থাপনা সরাসরি দেখেছি। অনেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সরকার কে নিয়ে বিভিন্ন কটুক্তি করেন, ব্যর্থতাই বেশি দেখেন, সমালোচনায় মুখে ফেনা তুলেন। তাদের জন্য আজ একটা হিসেব দেখাবো।
প্রথমেই আসি
১. অক্সিজেন খরচ-
আক্রান্তের ব্যপকতা ও রোগীর অবস্থা অনুযায়ী একজন রোগীর মিনিটে ২ লিটার থেকে ১৫ লিটার অক্সিজেন লাগে। কোন কোন রোগীর হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা দিয়ে মিনিটে ৬০ লিটার অক্সিজেন দেয়া হয়। একজন রোগীর গড়ে মিনিটে ৫ লিটার অক্সিজেন লাগলে ঘন্টায় লাগে ৩০০ লিটার। ২৪ ঘন্টা বা ১ দিনে লাগে ৭২০০ লিটার। যদি রোগী ৭ দিন ভর্তি থাকে তাহলে ৫০৪০০ লিটার। সিলিন্ডার হিসেবে প্রতি লিটার অক্সিজেনের দাম ন্যূনতম ১ টাকা হলে ৭ দিনে ঐ রোগীর পিছনে অক্সিজেন বাবদ খরচ ৫০৪০০ টাকা।
২. অ্যান্টিবায়োটিক-
একটা ভালো মানের অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকসনের(Inj. Moxaclav) দাম ৩০০ টাকা করে দিনে ৩ টা লাগলে ৯০০ টাকা। ৭ দিনে ৬৩০০ টাকা। সাথে মুখে খাওয়ার এন্টিবায়োটিক(Tab. Clarin 500) ৪০ টাকা করে দিনে ২ বারে ৮০ টাকা। ৭ দিনে ৫৬০ টাকা। সর্বমোট এন্টিবায়োটিক বাবদ ৬৮৬০ টাকা। তাছাড়া কোন কোন রোগীকে আরও দামি এন্টিবায়োটিক দিতে হয় যেমন Inj. Meropen যার দাম ১৩০০ টাকা করে দিনে ৩ টা দিতে হয়। মানে সেক্ষেত্রে ১ দিনেই শুধু এন্টিবায়োটিক খরচ ৩৯০০ টাকা। ৭ দিনে কত হবে নিজেই ভাবেন।
৩. এন্টিভাইরাল-
এটার দাম গড়ে ৫০০০ টাকা। ৫ দিনে ৬ টা ডোজ লাগে। ৬ ডোজের দাম ৩০০০০ টাকা।
৪. অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট-
এটার দাম ৩৫০ টাকা প্রায়। দিনে ২ টা করে দিতে হয়। তাহলে ৭ দিনে খরচ আসে ৪৯০০ টাকা।
৫. ভিটামিন-
এ বাবদ ৭ দিনে ১০০ টাকার মত লাগে।
৬. এন্টিহিস্টামিন ও অন্যান্য-
ফেক্সো, মনটিন, ডক্সিভা, স্টেরয়েড, অমিপ্রাজল এ বাবদ রোগীর আরও ৫০০ টাকার মত লাগে।
তাহলে ৭ দিনে একজন রোগীর পিছনে শুধু অক্সিজেন ও ওষুধ বাবদ সরকারের খরচ ৯২৭৬০। তাছাড়া রোগীর খাবার, আবাসন বাবদ খরচ তো আছেই। সব মিলিয়ে সরকারী হাসপাতালে গড়ে একজন রোগীর পিছনে ৭ দিনে খরচ প্রায় গড়ে ১ লাখ টাকা। কোন রোগীর হয়তো কম বা কারো হয়তো আরো বেশি। আমি গড়ে ১ লাখ টাকা খরচ হয় দেখলাম।
ডাক্তারঃ
করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, সার্বিক দেখাশুনা, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রতি ইউনিটে ২৪ ঘন্টা এমবিবিএস ডাক্তার থাকেন যারা বিসিএস ক্যাডার। তাদের সুপারভিশনে থাকেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। যারা দিনে ২ বার ওয়ার্ডে এসে সংকটাপন্ন রোগী দেখাসহ সব রোগীর খোজ খবর নেন, পাশাপাশি ফোনে ২৪ ঘন্টা যোগাযোগ রাখেন। আপনারা জানেন করোনা আক্রান্ত হয়ে অনেক ডাক্তার মারা গিয়েছেন। পিপিই পড়লে মনে হয় কেউ গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, সমস্ত শরীর ঘেমে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। এই অবস্থায় কয়েক মিনিট থাকা দায়, কিন্তু ডাক্তারগন টানা ২-৩ ঘন্টা রাউন্ড দেন। মাস্কগুলো এমনভাবে এয়ার টাইট করে লাগাতে হয় যে মুখে দাগ হয়ে যায় আর অসম্ভব ব্যাথা করে। করোনার স্যাম্পল পরীক্ষা, রিপোর্ট করা, কোভিড পজিটিভ রোগীর সাথে ফোনে কথা বলা, টেলিমেডিসিন সেবা প্রদান, কন্টাক্ট ট্রেসিং, কেইস স্টাডি করা, গবেষনা (IEDCR) সহ সব কিছু করছে ও লিডিং দিচ্ছে ডাক্তার। তাছাড়া রোগী ও স্বজনদের কাউন্সিলিং, রোগী আশঙ্কাজনক হলে আইসিইউ তে পাঠাতে সহযোগিতা করা ইত্যাদি দায়িত্বের বাইরেও অনেক কিছু করতে হয়। এত সব কষ্ট সহ্য করেও চিকিৎসা দিয়ে যান কারন আক্রান্ত হওয়ার পর যুদ্ধটা একান্ত আমাদের, আমরা পিছু হটলে কে আছে রোগীদের জন্য লড়বে। সৃষ্টকর্তার নাম নিয়ে তাই প্রতিটি চিকিৎসক লড়ে যান একটা প্রানের জন্য। অনেকে নিজের পরিবার থেকে আলাদা থাকেন কর্তব্যকালীন সময়ে। অনেক নারী চিকিৎসক নিজের ৩-৪ বছরের বাচ্চা রেখে টানা ১৫ দিন ডিউটি করেন। কিছুদিন আগে একজন গর্ভবতী নারী চিকিৎসক করোনা আক্রান্ত হয়ে গর্ভের বাচ্চাসহ মারা যান। এর চেয়ে বড় আত্মত্যাগ আর কি হতে পারে?
নার্স সহ অন্যান্য হাসপাতাল স্টাফঃ
আমাদের নার্সগন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। দিনে অন্তত ৪ বার করোনা ওয়ার্ডে পিপিই পড়ে ঢুকতে হয় ওষুধ দেয়ার জন্য। প্রায় ২ ঘন্টার উপর লাগে সবাই ওষুধ দিতে। এছাড়া যখনই প্রয়োজন হয় ওয়ার্ডে যান নির্বিঘ্নে। তাছাড়া রোগী ও তার স্বজনদের হাজারো প্রশ্নের উত্তর দেন উনারা।
এছাড়া হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়, ক্লিনার থেকে শুরু করে প্রতিটি কর্মচারী অকুতোভয় সৈনিকের মত নির্ভীকভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
সর্বোপরি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সরকার এত অল্প সময়ে যে সিস্টেম গড়ে তুলেছে তা আমাদের মত দেশের জন্য অকল্পনীয়।
তারপরেও নিন্দুকের তীর্যক মন্তব্যের শেষ নেই।
সরকার, চিকিৎসক, সংস্থ্যা, মন্ত্রণালয় সরকারের সকল বিভাগ নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছে। এটা বিশ্বব্যপি মহামারি। অনেক উন্নত দেশ নাস্তানাবুদ হয়েছে করোনার ছোবলে।
এই করোনা কালীন সময়ে আপনার পরিচিত বা বন্ধু ডাক্তার থাকলে তার কাছ থেকে অবশ্যই চিকিৎসা পেয়েছেন। উপকারটা মনে রাখবেন ও কৃতজ্ঞ থাকুন।
আসুন সরকারের সমালোচনা না করে সরকারকে সহযোগিতা করি।
Doctors are ultimate front line fighter against COVID-19. So respect your doctor.
Lets fight in the name of almighty creator.
Curtesy-
Dr. Sohanur Rahman
MBBS, BCS(37th)