16/05/2025
জীবনের চাপ বাড়ায় উচ্চ রক্তচাপ: বাংলাদেশের একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা
উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বাংলাদেশে একটি নীরব ঘাতকে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (২০১৭-১৮) অনুযায়ী, প্রায় ২০-৩০% প্রাপ্তবয়স্ক এই সমস্যায় ভুগছেন, যাদের অনেকেই জানেন না যে তাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে। আর্থিক চাপ, কাজের চাপ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং শহুরে জীবনযাত্রার মানসিক চাপ এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত যে, দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ সরাসরি উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী।
কীভাবে মানসিক চাপ উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে?
দীর্ঘদিন ধরে মানসিক চাপে থাকলে শরীরের সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম অতিসক্রিয় হয়ে পড়ে এবং অ্যাড্রেনালিন ও কর্টিসল হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। এর ফলে রক্তনালী সংকুচিত হয় (ভ্যাসোকনস্ট্রিকশন) এবং হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, যা সাময়িকভাবে রক্তচাপ বাড়ায়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে মানুষ ক্রমাগত অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপে থাকে, তখন এই সমস্যা স্থায়ী রূপ নেয়। এর ফলে রক্তনালীর প্রাচীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ধমনী শক্ত হয়ে যায় এবং প্রদাহ সৃষ্টি হয়—যা সবই উচ্চ রক্তচাপের মূল কারণ।
এছাড়াও, মানসিক চাপের কারণে মানুষ অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস যেমন—অতিরিক্ত লবণ খাওয়া, ধূমপান, শারীরিক পরিশ্রম না করা এবং অপর্যাপ্ত ঘুম ইত্যাদির দিকে ঝুঁকে পড়ে, যা উচ্চ রক্তচাপকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ঢাকায় ২০২৩ সালে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব অফিস কর্মী উচ্চ চাপের মধ্যে কাজ করেন, তাদের উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় ২.৫ গুণ বেশি।
একটি বাস্তব উদাহরণ: শহুরে জীবনের চাপ
৪৫ বছর বয়সী রহমান সাহেব (ছদ্মনাম) ঢাকার একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা। চাপযুক্ত চাকরি, যানজটে দীর্ঘ সময় কাটানো এবং পারিবারিক দায়িত্ব তাকে ক্রমাগত মানসিক চাপে রাখে। তিনি ব্যায়াম করতেন না, প্রক্রিয়াজাত খাবার খেতেন এবং দিনে মাত্র ৫ ঘণ্টা ঘুমাতেন। একটি ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে তার রক্তচাপ মাপা হলে দেখা যায় ১৬০/১০০ mmHg, যা স্বাভাবিক (১২০/৮০ mmHg) এর চেয়ে অনেক বেশি। ডাক্তাররা তাকে সতর্ক করেন যে, এখনই জীবনযাত্রা পরিবর্তন না করলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে। তার মতো অসংখ্য শহুরে পেশাজীবী আজ বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপের শিকার।
সমাধান: প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ
১. জীবনযাত্রার পরিবর্তন
- খাদ্যাভ্যাস:লবণ কম খাওয়া, কলা, পালং শাকের মতো পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার বাড়ানো এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়ানো।
- ব্যায়াম:দিনে মাত্র ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা রক্তচাপ ৫-৮ mmHg কমাতে পারে।
- মানসিক চাপ কমানো: মেডিটেশন, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম এবং যোগব্যায়াম কর্টিসল হরমোন কমাতে সাহায্য করে।
২. চিকিৎসা সহায়তা
যাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন, তাদের জন্য ডাক্তাররা সাধারণত নিম্নলিখিত ওষুধ দেন:
- এসিই ইনহিবিটর (যেমন: এনালাপ্রিল)
- বিটা-ব্লকার (যেমন: এটেনলল)
- ডাইইউরেটিক (যেমন: হাইড্রোক্লোরোথায়াজাইড)
৩. সরকার ও সমাজের ভূমিকা
বাংলাদেশে নিয়মিত ব্লাড প্রেশার স্ক্রিনিং এর প্রচার বাড়ানো দরকার, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যেখানে সচেতনতা কম। কর্মক্ষেত্রে ওয়েলনেস প্রোগ্রাম চালু করলে রহমান সাহেবের মতো মানুষরা চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।
উপসংহার
উচ্চ রক্তচাপ শুধু একটি শারীরিক সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক সমস্যাও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (২০২২) অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ২৫% হৃদরোগ ও স্ট্রোকের কারণে হয়। তাই, মানসিক চাপ কমিয়ে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, দ্রুত চিকিৎসা সহায়তা নেওয়া এবং সামাজিক সচেতনতা বাড়ালে বাংলাদেশ এই নীরব ঘাতককে পরাজিত করতে পারে।