25/07/2019
দাঁতের রোগ ও প্রতিকার
মানুষের মুখের অন্যতম অংশ হচ্ছে দাঁত, দাঁতের উপরই নির্ভর করে মানুষের কথা বলা, মুখের সৌন্দর্যসহ আরও অনেক কিছু। আর দাঁতের সৌন্দর্য নির্ভর করে দাঁতের সুস্থতার উপর, অসচেতনতা এবং অবহেলার কারণে আমাদের দাঁত নষ্ট হয়ে যায়। দাঁত নষ্ট হওয়ার প্রধান কয়েকটি কারণের মধ্যে অন্যতম হল মাড়ির রোগ এবং অপরটি ডেন্টাল ক্যারিজ বা দন্ত ক্ষয় । আমাদের সকলরেই উচিৎ এসব দাঁতের রোগের কারণ ধরণ এবং প্রতিরোধ সম্পর্কে জানা।
মাড়ির রোগ (জিনজিভাইটিস ও পেরিওন্টাইটিস)
মাড়ির রোগের প্রধান ও অন্যতম কারণ হলো ডেন্টাল প্লাক, ডেন্টাল প্লাক হলো ব্যাকটেরিয়া কিংবা অন্যান্য জীবাণু দ্বারা তৈরি এক ধরণের আঠালো পদার্থ যা দাঁতের চারপাশে লেগে থাকে। এঁকে ব্যাকটেরিয়ান প্লাক ও বলা হয়ে থাকে।
মূলত Streptococcus Mutants, Lactobacilli ব্যাকটেরিয়ার ফলে ডেন্টাল প্লাক সৃষ্টি হয় এবং ডেন্টাল প্লাক ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তৈরি হয়ে থাকে ও এটি দাঁতের সাথে লেগে থাকে, যদি এটি ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে পরিষ্কার না হয় তবে তা ধীরে ধীরে শক্ত হতে থাকে এবং ৯ থেকে ২১ দিনের মধ্যে এটা পাথরের রুপ ধারন করে মাড়ির সঙ্গে শক্তভাবে লেগে থাকে, ডেন্টাল প্লাক পাথরের রুপ ধারন করার পর মাড়িতে ব্যাথা অনুভব ও মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া এবং দাঁত শিরশির করে। এই অবস্থাকে বলা হয় জিনজিভাইটিস বা Inflammation of the gingiva বলা হয়। এই জিনজিভাইটিস হওয়ার পরও যদি সচেতন না হয় তবে পরবর্তীতে মাড়ি লাল হয়ে যাওয়া মাড়ী দিয়ে রক্ত পড়া, মাড়ি ও দাঁতের সংযোগস্থলে পুজ হওয়া, মুখে বিশ্রী গন্ধ, দাঁত নড়বড়ে হয়ে যায় এবং পরে যায়। এই অবস্থাকে পেরিওনটাইটিস বলা হয়ে থাকে, এসব মাড়ির রোগ মুলত যারা দাঁতের প্রতি যত্নশীল না, যাদের আঁকাবাঁকা দাঁত এবং গর্ভবতী মহিলাদের হরমোন পরিবর্তনের কারণে বেশী হয়ে থাকে।
প্রতিকার
খুব সহজেই আমরা ডেন্টাল প্লাক যেন দাঁতের সাথে যুক্ত না হতে পারে সেজন্য সচেতন হতে পারি, যেমনঃ-
যে কোন আঠালো জাতীয় খাবার পর পরই কুলি করার অভ্যাস গড়ে তোলা কারণ আঠালো জাতীয় খাবার ৫মিনিট পরই দাঁতের সাথে বিক্রিয়া করে দাঁতের অংশে লেগে যায় ।
পান, সিগারেট, তামাক ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
সকালে নাস্তার পর ও রাতে ঘুমানোর আগে অবশ্যই নরম ব্রাশ দিয়ে নীচের মাড়ির দাঁত নীচ থেকে উপরে এবং উপরের
মাড়ির দাঁত উপর থেকে নিচে ব্রাশ করতে হবে।
দাঁত ব্রাশ করার পর ও কিছু খাদ্যকণা দুই দাঁতের মাঝখানে আটকে থাকে, সেই খাদ্যকণা গুলো ডেন্টাল ফ্লাসের মাধ্যমে পরিষ্কার করতে হবে।
বছরে অন্তত এক বা দুইবার বিডিএস ডিগ্রীধারী দন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
চিকিৎসা
জিনজিভাইটিস চিকিৎসায় আলট্রাসনিক স্কেলারের মাধ্যমে দাঁত ও মাড়ির সংযোগস্থলে ক্যালকুলাস বা পাথর পরিষ্কার করা উচিৎ।
পেরিওডনটাইটিসের ক্ষেত্রে ও ডেন্টাল স্কেলিং ও রুট প্ল্যানিং করা উচিৎ এবং যেসব দাঁত একেবারেই নড়বড়ে হয়ে যায় সেগুলো ফেলে দিয়ে পুনরায় দাঁত প্রতিষ্ঠাপন করা উচিৎ।
মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে মাউথওয়াশ এবং ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেস্ট ব্যাবহার করুণ।
আঁশযুক্ত টাটকা ফল দাঁত পরিষ্কার ও মাড়ি সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
অনেকেই মনে করেন, দাঁত স্কেলিং করলে দাঁত দুর্বল ও ফাঁকা হয়ে যায়। এটা একদমই ভুল ধারণা বা কুসংস্কার। বর্তমানে অত্যাধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে দাঁতের পাথর বা ক্যালকুলাস দূর করা হয় এবং এতে করে দাত ও মাড়ি আরও মজবুত ও সুস্থ হয় কারণ দাঁতের পাথর বা ক্যালকুলাস দাঁতের কোন অংশ নয় বরং এটি একটি আগাছা যা খাবার থেকে সৃষ্টি।
দন্তক্ষয় রোগ বা ক্যারিজ
ডেন্টাল ক্যারিজ বা দন্ত ক্ষয় দাঁতের একটি জীবাণু জনিত রোগ। এই রোগ মূলত একটি নির্দিষ্ট সময়ে মিষ্টি জাতীয় খাবারের সাথে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ভেঙ্গে অম্ল বা এসিড উৎপন্ন করে। এই এডিস দাঁতের সামান্য গর্তের সৃষ্টি করে। দাঁতের এই গর্ত বা ক্ষয়কেই ডেন্টাল ক্যারিজ বা হয়। ডেন্টাল ক্যারিজের প্রাথমিক অবস্থায় ব্যাবস্থা না নিলে এ গর্ত ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, এর প্রধান লক্ষণগুলো প্রথমে দাঁতের খাবার আটকে থাকা, ঠাণ্ডা গরম ও মিস্টি বা টক জাতীয় খাবার খেলে দাঁত শিরশির করা সহ ব্যাথা অনুভূত হয়, এই ব্যাথা পরবর্তী সার্বক্ষণিক ব্যাথায় পরিণত হয় এবং অসহনীয় হয়ে উঠে। ক্ষয়প্রাপ্ত দাঁতের চিকিৎসা না করা হলে দাঁতটি সম্পূর্ণরুপে নষ্ট হতে মাড়ি ও মুখ ফুলে যায় এবং এমনকি সিস্ট বা টিউমার পর্যন্ত হতে পারে। সুতরাং দাঁত থাকতে দাঁতের যত্ন নেওয়া জরুরী।
ক্যারিজ মুলত চার প্রকার
এনামেল ক্যারিজ
ডেনটিন ক্যারিজ
পাল্প ক্যারিজ
রুট ক্যারিজ
এই ক্যারিজ মুলত শিশু বা বড়দের সবারই হতে পারে। অনেকে মনে করেন শিশুদের দুধ দাঁত বা Deciduous teeth নষ্ট হলে বেশি যত্ন নেওয়ার দকার নেই। কিন্তু দুধ দাঁত সুস্থভাবে না পড়লে স্থায়ী দাঁত সঠিক অবস্থানে আসে না এবং দাঁতের ব্যাথার ফলে খাওয়া দাওয়া কমিয়ে দেয় । জ্বর এবং টনসিলের প্রদাহ হতে পারে। যার ফলে শিশুর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে।
প্রতিকার
যথাসম্ভব মিষ্টি বা চিনি জাতীয় খাবার কম খেতে হবে ।
সুষম খাদ্য গ্রহন করতে হবে ।
অবশ্যই রাতে ঘুমানোর আগে ব্রাশ করতে হবে, কারণ রাতে ঘুমিয়ে থাকার ফলে আমাদের লালা বা saliva কম থাকে এবং তাতে করে খাদ্য কণিকার সাথে ব্যাকটেরিয়া বিক্রিয়া করে সহজেই দাঁতের প্লাক বা ডেন্টাল ক্যারিজ সৃষ্টি করে।
চিকিৎসা
ডেন্টাল ক্যারিজ যখন দাঁতের Enamel ও Dentin অংশে অবস্থান করে তখন ফিলিং এর মাধ্যমে এর স্থায়ী সমাধান সম্ভব এবং সময় ও খরচ দুটোই কম হয়।
যখন ডেন্টাল ক্যারিজ pulp বা মজ্জায় চলে যায় তখন তীব্র ব্যাথা হয় এবং ফিলিং এর মাধ্যমে আর সমাধান সম্ভব হয়না।
দাঁত ব্যাথামুক্ত করার জন্য dental pulp বা মজ্জা অত্যাধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে বের করে পুনরায় Gutta purcha নামক বস্তু দিয়ে সিল করা হয়। এই পদ্ধাতিটি রুট ক্যানেল নামে পরিচিত। রুট ক্যানেল করার পর দাঁতের ক্রাউন বা ক্যাপ বসানোর প্রয়োজন হয়। অন্যথায় এক সময় দাঁত ও ফিলিং দুটোই ভেঙ্গে যায়। এই চিকিৎসায় সময় এবং খরচ দুটোরই প্রয়োজন হয়।
ডেন্টাল ক্যারিজ হওয়ার পর যত্নশীল না হলে দাঁতের সংক্রমণ বেড়ে গেলে সিস্ট বা টিউমার বা অন্যান্য ভাল দাঁত পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে। তাই বেশি সংক্রমনযুক্ত দাঁত ফেলে দিয়ে পুনরায় প্রতিস্থাপন করে নিন। দাঁত তোলার আগে অবশ্যই ডায়াবেটিস বা হার্টের রোগীরা দন্ত বিশেষজ্ঞকে তাদের রোগের বিষয়ে অবহিত করা প্রয়োজন।
আমাদের সমাজে এখনো প্রচলিত আছে দাঁতের পোকা নামের একটি কুসংকার কিংবা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে , দাতে পোকা বলতে আসলে কিছু নেই, এটি মুলত একধরনের ব্যাকটেরিয়ার, যার ফলে দাঁত কালো বা বাদামী রঙ ধারণ করে গর্তের সৃষ্টি করে , এই ব্যাকটেরিয়া খালি চোখে দেখা সম্ভব নয় । কেউ যদি শিশুকাল থেকেই দুই বেলা দাঁত ব্রাশ করার অভ্যাস গড়ে তুলে তার ডেন্টাল ক্যারিজ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
যে বিষয় জেনে রাখা জরুরী
মুখ ও দাঁতের চিকিৎসায় বিডিএস ডিগ্রী ছাড়া কেউ দাঁতের ডাক্তার নয়। চিকিৎসার পূর্বে ডাক্তারের বিডিএস ডিগ্রী এবং বিএমডিসি রেজিঃ আছে কিনা জেনে নেওয়া জরুরী। জেনে রাখা জরুরী যে আমাদের দেশে নাম মাত্র ডিগ্রী ব্যাবহার করে বা ডেন্টিস্ট লিখে মানুষকে প্রতারিত করছে একদল মানুষ। এতে করে অনেক রোগী মারাত্মক ভাবে দাঁত ও মুখের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। মনে রাখতে হবে একটি দাঁত মানেই একটি জীবন, সুতরাং দাঁত নিয়ে অবহেলা করা উচিৎ নয়।
দাঁতের উপকারি খাদ্য
কিছু খাদ্য দাঁতের ও মাড়ির সুস্থতায় সহায়তা করে আর তাই সেই সকল খাবারকে দাঁতের উপকারী খাবার হিসেবে চিহিত করা হয়ে থাকে। যেমনঃ আঁশালো ও শক্ত খাদ্য, গাজর,পেয়ারা, আমড়া, আখ, আনারস, নাশপাতি, অ্যাপেল, নারিকেল, ইত্যাদি। লেবু, আমলকী, কমলা, টমেটো ও বিভিন্ন ধরনের শাক সবজিতে প্রচুত পরিমাণে ভিটামিন “সি” ও অন্যান্য ভিটামিন থাকে, ভিটামিন “সি” দাঁতের ও মাড়ির জন্য উপকারী।
দাঁতের অপকারী খাদ্য
পাউরুটি, কেক, টফি লজেন্স, আইসক্রিম, বিস্কুট, বার্গার ও আঠালো জাতীয় খাবার সমূহ দাঁতের অপকারি খাদ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এসব খাদ্য খাওয়ার পর উত্তমরুপে দাঁত পরিষ্কার করতে হয়।
দাঁতের যত্নে করণীয়
প্রতিদিন রাত্রে ঘুমানো আগে এবং সকালে নাস্তার পর ব্রাশ দিয়ে দাঁতের ভিতরে এবং বাইরে আলাদা ভাবে উপরের দাঁত উপর থেকে নীচে এবং নীচের দাঁত নীচ থেকে উপরে মাজতে হবে।
যে সব জায়গায় ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করা সম্ভব নয়, সেখানে ডেন্টাল ফ্লস ব্যাবহার করতে হবে।
ফ্লোরাইডযুক্ত যে কোন টুথপেস্ট দাঁতের জন্য উপকারী। ২-৩ মাস অন্তর অন্তর টুথপেস্ট ও ব্রান্ড বদলানো ভালো কারণ বিভিন্ন পেস্টে বিভিন্ন ধরনের উপাদান থাকে। ৩ মাস পর পর অবশ্যই ব্রাশ বদলাতে হবে।
কয়লা, গুল, টুথ-পাউডার, ছাই মাটি ডালা ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না ।
অত্যাধিক পান-সুপারী, সিগারেট খাওয়া যাবে না এতে দাঁত ক্ষয় হয়।
হা করে ঘুমানোর অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করবেন, কারণ হা করে ঘুমাবার ফলে মুখ ও দাঁতের রোগ বেড়ে যায়।
সংগ্রহে:
ডেন্টিস্ট
মৃদুল কান্তি দাস